বৈচিত্রময় সালাত

6
2390

লেখকঃ রেহনুমা বিনতে আনিস

ক’দিন ধরে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম- আমি একটা টেবিল বানাচ্ছি, সুন্দর কাঠ, একেবারে মসৃন করে কাটা, উন্নতমানের পার্টস, চমৎকার যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করছি। কিন্তু আমার মন উড়ু উড়ু, বার বার কাজ ফেলে অন্যদিকে ছোটে। কিছুক্ষণ পর টেবিল হোল ঠিকই কিন্তু তাকে পায়ের ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ব্যাপার কি? হায় হায়, মনের ভুলে একেকটা পায়ের সাইজ একেকরকম হয়ে গেছে! একবার এই পা কাটি তো আরেকবার ঐ পা কাটি। শেষে টেবিলটা টেবিল না হয়ে পিঁড়িতে রূপান্তরিত হোল। সে এমন এক পিঁড়ি তাতে না যায় বসা আর না যায় টেবিলের মত তরকারী সাজানো।

আমার কেন যেন মনে হয় আমার নামাজগুলো হয় এই টেবিলের মত। নামাজ পড়ি, কিন্তু সেটা হয় দায়সারা গোছের, তাতে যত্নের কোন ছোঁয়া থাকেনা। তাই সে আমাকে আল্লাহর সামনে সম্মানিত করবে কি, তাঁর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েই তার দফারফা হয়ে যায় আর আমার ইজ্জতের বাজে তেরোটা।

চলুন একটু হিসেব করে দেখি আমরা কিভাবে নামাজ পড়ি। নামাজে দাঁড়িয়ে রোবটের মত মুখে সুরা এবং দু’আ পড়া চলতে থাকে আর মনে মনে হিসেব করতে থাকি আজ কার কার সাথে কি কি কথা হোল, কি কি পড়লাম, কোন মুভিটা দেখা হয়নি, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, তরকারীটা আরেকটু শক্ত থাকলে দেখতে আরেকটু ভাল হত, বাচ্চাগুলো এই মূহূর্তে কি করছে- অর্থাৎ পঠিত সুরাগুলোর অর্থ ছাড়া আর সবকিছুই মাথায় থাকে। আমাকে যদি প্রতিদিন লবন মরিচ আর পান্তাভাত দেয়া হয়, অপমানে চোখে ফেটে পানি আসবে। একই খাবার মানুষ প্রতিদিন খেতে পারে? অথচ আমরা বছরের পর বছর স্বল্প ক’টা সুরা একইভাবে ঘ্যানর ঘ্যানর করে যাচ্ছেতাইভাবে নামাজ সমাধা করছি। রোবটের মত একই জিনিস পুণরাবৃত্তি করতে করতে মাঝে মাঝে এটাও সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর হয়ে যায় আমি আসলে কয় রাকাত নামাজ পড়েছি। তখন হিসেব করি প্রথম রাকাতে ভাবছিলাম আমার প্রথম দোকানটার কথা, দ্বিতীয় রাকাতে ভাবছিলাম দ্বিতীয়টার কথা, তৃতীয় রাকাতে তৃতীয়টার কথা, যেহেতু চতুর্থ দোকানটার কথা ভাবা হয়নি তার মানে চার রাকাতের নামাজ আমি তিনরাকাত পড়েছি! অথচ নামাজের সময়টুকু হোল আল্লাহর সাথে আমার একান্ত সাক্ষাতের সময়, এই সময় আমার সমস্ত মনোযোগ যদি আমার শ্রোতার প্রতি নিবদ্ধ না থাকে তাহলে তাঁর কি দায় পড়েছে আমার আবোলতাবোল শুনে সময় নষ্ট করার? আমি নিজেই তো জানিনা আমি তাঁকে কি বলছি, সেক্ষেত্রে তিনি কি করে আমার বক্তব্যে মর্মোদ্ধার করবেন? কি দুঃখজনক ব্যাপারে, যে বৈচিত্র আমি নিজের জন্য পছন্দ করি তা আমার সৃষ্টিকর্তার জন্য উপহার দিতে কার্পণ্য করি, অথচ তা তাঁরই দেয় উপহার!

আমরা অধিকাংশই নামাজ পড়ি শেষ ওয়াক্তে, দুনিয়ার সব কাজ সমাপ্ত করে যখন না গেলেই নয়, সুতরাং নামাজ না হয়ে সেটা হয়ে যায় দৌড় প্রতিযোগিতা। আমরা এর ব্যাখ্যা দেই এভাবে, আমি সব কাজ শেষ করে নামাজ পড়তে যাই যেন আমার ধ্যান পুরোপুরি নামাজের প্রতি নিবিষ্ট থাকে। কিন্তু কোন দাওয়াতে গেলে মেজবান যদি আমাকে এককোণে বসিয়ে রেখে অন্য সবার সাথে কথাবার্তা সেরে শেষমূহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে আমার সাথে কিছু দুর্বোধ্য বাক্যালাপ সেরে সটকে পড়েন, আমি ঠিকই বুঝব তিনি আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা এবং অপমান করলেন। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমি সেই দাওয়াতে খাবারই খাব না! অথচ আমরা আল্লাহর সাথে ঠিক এই ব্যাবহারই তো করছি! এই সামান্য বোধটুকু আমাদের মাঝে কাজ করেনা যে আমার নামাজ পড়া না পড়ায় তাঁর কিছু এসে যায়না, তাঁর মান সম্মানের ন্যূনতম কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়না, কারণ তাঁর আমাকে প্রয়োজনে নেই বরং আমার তাঁকে প্রয়োজন। খুবই স্বাভাবিক আমরা যখন তাঁর সাথে এই বুঝ দেয়া ব্যাবহার করি তখন আমাদের বিপদের সময় তিনি আমাদের নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করার প্রয়োজন অনুভব করবেন না। তখন কিন্তু আমরা রাগে ফেটে পড়ি কেন তিনি আমার বিপদের সময় সাড়া দিতে বিলম্ব করলেন? অথচ তিনি ছাড়া আর কোন সাহায্যকারী নেই!

অনেকসময় আমরা যে ওয়াক্তের নামাজ সে ওয়াক্তে না পড়ে পরবর্তীতে পড়ার জন্য রেখে দেই। অজুহাত থাকে ওজু করার সুব্যাবস্থা ছিলোনা, নামাজের জায়গা ছিলোনা, পোশাক পরিচ্ছদ ঠিক ছিলোনা, লোকজনের সামনে কিভাবে নামাজ পড়ব যেখানে আর কেউ পড়ছেনা ইত্যাদি। অথচ নামাজে ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে বলা হয়েছে এটা বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীর মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। ওজু করা না গেলে তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে; দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে এমনকি ইশারায় নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে; শিশু পেশাব করে দিলে নোংরা হওয়া সত্ত্বেও পোশাক পরিবর্তনের পরিবর্তে শুধু সে স্থানটুকু ধুয়ে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে- কেন? শুধু এজন্যই তো যেন নামাজ পড়া আমাদের জন্য কঠিন না হয়! তবু আমরা নামাজ কাজা করি। আমার এক ছোটভাই বিরাট ব্যাবসায়ী। দেশেবিদেশে ব্যাবসা, মিটিং, ছুটোছুটি লেগেই থাকে। সে বলেছিল, একবার এক ব্যাবসায়িক মিটিংয়ে সে আশা করছিল নামাজের জন্য ব্রেক দেয়া হবে, যেহেতু মিটিং ছিল বাংলাদেশে এবং উপস্থিত ব্যাবসায়ীদের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলিম। কিন্তু শেষ ওয়াক্তেও যখন বিরতি দেয়া হোলনা এবং কেউ এই ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুললেন না তখন সে নিজেই লজ্জা পেল। বাথরুমে যাবার কথা বলে বাইরে গিয়ে নামাজ পড়ে এলো। খুব আক্ষেপ করে বলেছিল সে, ‘এক সময় যারা নামাজ পড়তনা তারা নামাজের ওয়াক্ত হলে লজ্জায় ছাদের ওপর, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকত। আর এখন আমরা মিথ্যা বাহানা দিয়ে নামাজ পড়ি!’ কিন্তু এখানে বড় কথা সে লোকের কথা ভেবে নিজের নামাজ ত্যাগ করেনি যেহেতু ওর নামাজের হিসেব ওকেই দিতে হবে।

এবার চলুন একটি সুন্দর নামাজের কথা বলি। গত তারাবীতে যখনই সম্ভব হত আমরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। একেকদিন একেকভাবে নামাজ হত। যেমন, একরাতে ইমাম সাহেব থিম ঠিক করলেন নবীদের কাহিনী। তারাবীর প্রতি রাকাতে তিনি একেকজন নবীকে নিয়ে কু’রআনের একেকটি অংশের তিলাওয়াত করলেন। মনেই হচ্ছিলোনা নামাজ পড়ছি, এত মজা লাগছিল যে মনে হচ্ছিল অ্যাসর্টেড চকলেট খাচ্ছি, কোনটাতে বাদাম দেয়া, কোনটাতে ক্যারামেল, আর কোনটাতে মধু। ইমাম সাহেব বিতর পড়লেন যেভাবে রাসূল (সা:) পড়তে ভালবাসতেন সেভাবে- প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুয়া কাফিরূন, তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস- চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছিল যেন সাহাবাদের সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছি। ইমাম সাহেব তৃতীয় রাকাতে যখন দু’আ পড়তে শুরু করলেন সবাই আপ্লুত হয়ে পড়ছিল, কারণ কথাগুলো ছিল হৃদয়নিঃসৃত এবং ‘আল্লাহ’ শব্দটির উচ্চারণে এত ভালবাসা মিশ্রিত ছিল মনে হচ্ছিল এই আওয়াজ তাঁর হৃদয়ের গহীন থেকে উত্থিত হয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়ে তুলছিল প্রভুর ভালবাসার তৃষ্ণায়।

এবার আমরা একটু ভেবে দেখি আমরা কতটুকু সময় ব্যায় করি আমাদের নামাজকে এভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করার পেছনে। আমরা প্রতি রাকাতে কতটুকু সময় নিয়ে ভাবি আজ কোন কোন সুরা দিয়ে নামাজ পড়ব, কোন সুরা আমার মনের ভাবাবেগ সবচেয়ে সুন্দরভাবে আমার প্রভুর সামনে তুলে ধরবে, সুরা ফাতিহার পর দুতিনটে অর্থপূর্ণ সুরা দিয়ে সাজাই কি কখনো আমার নামাজের ডালি, কিংবা নতুন কিছু সুরা শিখি নামাজে ব্যাবহার করে নামাজটিকে বৈচিত্রময় করে তোলার জন্য? কখনো কি চেষ্টা করি সুরাগুলোর অর্থ মনে করে করে পড়ার যেন আমার মন আমার মুখ এবং শরীরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমার সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাতে? কখনো কি জানার চেষ্টা করি আমার রাসূল (সা:) কিভাবে নামাজ পড়তেন যেন আমি তাঁকে অনুসরন করতে পারি? কখনো কি মনে পড়ে রুকু এবং সিজদায় দু’আ কবুল হয়, এই দু’টোকে সযত্নে সাজাই ধৈর্য্য স্থৈর্য্য এবং দু’আ দিয়ে? কখনো কি মনে হয় বিভিন্ন নবীরা এবং জ্ঞানি ব্যাক্তিরা যে দু’আ করেছেন তা শিখে নিয়ে নামাজে প্রয়োগ করি আমার প্রভুকে আমার প্রতি ক্ষমা এবং সন্তুষ্টিতে বিগলিত করার জন্য?

কিংবা এমনভাবে ‘আল্লাহ’ শব্দটি উচ্চারণ করি যেন আমার হৃদয় হতে ভালবাসার আর্তনাদের মতই উত্থিত হয় সে ধ্বনি? কখনো কি মনে হয় আজ একটু বেশি যত্ন নিয়ে ওজু করি? আজ একটি সুন্দর পোশাকে আমার সৃষ্টিকর্তার সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাঁর এই উপহারের জন্য? কখনো কি মনে হয় নামাজের শেষে তড়িঘড়ি উঠে না গিয়ে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলি তাঁর সাথে যিনি আমার সকল ভালমন্দ খবর নেয়ার জন্য কান পেতে বসে আছেন নিবিড় ভালবাসার সাথে, শুধু চাইবার অপেক্ষা? কিংবা কখনো কি ইচ্ছে হয় টুক করে একটা সিজদা দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে তিনি আজকের দিনটি আমাকে সময় দিলেন বেঁচে থাকার অথচ আজই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে, যে তিনি আজ আমাকে ট্রাফিক জ্যাম থেকে রক্ষা করেছেন অথচ হাজার হাজার মানুষ এখনো আটকা পড়ে আছে, যে তিনি আজ আমাকে ভাল খাইয়েছেন অথচ হাজার হাজার মানুষ আজ না খেয়ে কাটাবে, যে তিনি আমাকে নামাজ পড়ার সামর্থ্য দিয়েছেন অথচ আজ রাতে হাজার হাজার মানুষ একটিও নামাজ না পড়ে শুতে যাবে?

ভাবি অনেক কিছুই, কিন্তু তবু আমার নামাজগুলো কেন যেন টেবিল না হয়ে শুধু পিঁড়ি হয়ে যায়, কিছুতেই তৃপ্তি আসেনা। যে নামাজ আমাকেই শান্তি দেয়না তা কিভাবে আমার প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে?

তবে একটু যত্নশীল হলে আমরা প্রতিটি নামাজের পরই পেতে পারি অ্যাসর্টেড চকলেটের স্বাদ, শুধু প্রয়োজন ইচ্ছার আর উদ্যোগী হবার অপেক্ষা!

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

6 COMMENTS

  1. কখনো কি মনে হয় নামাজের শেষে তড়িঘড়ি উঠে না
    গিয়ে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলি তাঁর সাথে যিনি আমার সকল ভালমন্দ খবর নেয়ার জন্য
    কান পেতে বসে আছেন নিবিড় ভালবাসার সাথে, শুধু চাইবার
    অপেক্ষা? কিংবা কখনো কি ইচ্ছে হয় টুক করে একটা সিজদা
    দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে তিনি আজকের দিনটি আমাকে সময় দিলেন বেঁচে থাকার অথচ
    আজই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে

    “কান পেতে বসে আছেন” – এই কথাগুলো
    সামঞ্জস্যপূর্ণ না। আপনি হয়তো কান পেতে কথাটি উপমা হিসেবে লিখেছেন, কিন্তু
    এভাবে আল্লাহ তায়ালা’র কথা লেখা মনে হয় ঠিক না। আর “টুক করে
    একটা সিজদা” এখানে টুক করে কথাটা কি বদলে দেয়া যায়? সিজদা করা
    আল্লাহ’র কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় ।এটা ধীর, স্থির, আন্তরিক
    হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

  2. I was crying, by the time I reached the end. MashAllah. It touched my heart. I want to read more of your articles.

  3. Prio admin ai site ti amar ato valo lage je ami ate favorite e rekechi . Asa kori aro sondor sondor post amra pabo . long live admin . i pray for all of you.

আপনার মন্তব্য লিখুন