সাধারণ ও ইসলামী শিক্ষা: কী এবং কেন?

4
6330

214

লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আলোচনার সুবিধার্থে চলুন প্রথমেই শিক্ষা বলতে কী বুঝায় সে ব্যাপারে সংক্ষেপে ধারণা নেয়া যাক। নিম্নে সাধারণ ও ইসলামী শিক্ষার কিছু সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো।

শিক্ষা কী?

শুরুতেই আগে শিক্ষার সাধারণ ধারণাটি উপস্থাপন করা যাক। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্য প্রসঙ্গগুলোয় আসা যাবে। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ education। আর এর সংজ্ঞায় অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা হয়েছে­ : education means a process of teaching, training and learning, especially in schools, or colleges, to improve knowledge and develop skills.

জন মিল্টন বলেছেন­, Education is the harmonies development of mind, body and soul.

হারম্যান হর্ন লিখেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে মুক্ত সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সাথে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া, যেমনটি প্রমাণিত রয়েছে মানুষের বৃদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশ’।

বিশিষ্ট দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,­ ‘নিজেকে জানার নামই শিক্ষা’।আমেরিকান শিক্ষাবিদ জন ডেউয়ে বলেছেন, ­‘প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ ও মৌলিক মেজাজ প্রবণতা বিন্যাস করার প্রক্রিয়াই শিক্ষা।’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মানবধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,­ ‘মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে শিক্ষা।’কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মানুষের খুশির বা রূহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা।’ [১]

ইসলামী শিক্ষা বলতে কী বুঝায় ?

সালাফে সালেহীন বা পূর্বতন মনীষীবৃন্দ ইসলামী শিক্ষার জন্য কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন নি। তাঁরা নানা শব্দে ইসলামী শিক্ষাকে বুঝিয়েছেন। এ কারণে বর্তমান যুগে ইসলামী শিক্ষার অগ্রপথিক ও কর্ণধার আলিমগণ এর সংজ্ঞা নির্ধারণে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তবে তাঁদের সবার বক্তব্যে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে সাযুজ্য দেখা যায়। আর সবার দৃষ্টিভঙ্গি, বৈশিষ্ট্য ও অভিরুচিগত পার্থক্যের কারণেই সংজ্ঞা নির্ধারণে এ মত ভিন্নতা দেখা দেয়। আলিম, পণ্ডিত ও ইসলামী শিক্ষার গবেষক ও লেখকগণ ইসলামী শিক্ষার কয়েকটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। নিম্নে তার কিছু সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :

আবদুর রহমান নিহলাওয়ী বলেন: ‘ইসলামী শিক্ষা হলো ব্যক্তিক ও সামষ্টিক ব্যবস্থা যা ইসলামকে গ্রহণ এবং তা ব্যক্তি ও গোষ্ঠি জীবন পর্যায়ে প্রয়োগের দিকে নিয়ে যায়। অন্য কথায়, তা হলো, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মানুষের চেতনার উন্নয়ন এবং তার আবেগ ও আচরণকে দীনে ইসলামের ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা।’ [আবদুর রহমান নিহলাওয়ী, উসুলুত তারবিয়্যাতিল ইসলামিয়া, পৃষ্ঠা : ২৭]

শায়খ আমীন মুহাম্মদ আউয বলেন: ‘তা হলো ইসলামী ব্যক্তিত্বের চৈন্তিক, শারীরিক ও সামাজিক সকল দিকের উন্নয়ন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুযায়ী তার আচরণকে সুন্দর করা।’ [শায়খ আমীন মুহাম্মদ আউয, আসালিবুত তারবিয়া ওয়াত তালীম ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা : ৩৪]

জগলূল নাজ্জার বলেন:‘ইসলামী শিক্ষা হলো ইসলামের ব্যাপকতর অর্থে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা। আল্লাহ যেমন ইসলামের ব্যাপকার্থ প্রকাশে বলেন, আল্লাহর কাছে মনোনীত দীন একমাত্র ইসলাম।’ [জগলূল নাজ্জার, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৭৯]

এ ছাড়াও পরিসর বেড়ে যাবার আশংকায় আরও অনেকেরই সংজ্ঞা এখানে তুলে ধরা গেল না। তবে সবগুলোতেই যে কথাটা পাওয়া যায় তা হলো, এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সৎ ব্যক্তি তৈরি, ইসলামী শরী‘আর প্রধান উৎসগুলোর আলোকে দুনিয়া ও আখিরাতের দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানস গঠন নিশ্চিত করা হয়।

সাধারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য:

প্রথমেই দেখা যাক, শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষীরা কে কী বলেছেন।  জন ডিউই বলেছেন, ‌শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলদ্ধি।

প্লেটোর মত হলো: শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে: শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।
এরিস্টোটল বলেছেন: শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।
শিক্ষাবিদ জন লকের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ।
বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন: শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।
কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেল এর মতে: শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি।
কমেনিয়াসের মতে: শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা।
পার্কার বলেছেন: পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্যে যেসব গুণাবলি  নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুণাবলির যথাযথ বিকাশ সাধন।
জীন জ্যাক রুশোর মতে: সৎ অভ্যাসে গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
বার্ট্রান্ড রাসেল এর মন্তব্য হলো:…The education system we must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists.
স্যার পার্সিনান বলেছেন: শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুতি এবং ভালো দেহ ভালো মন গড়ে তোলা।
ডা. হাসান জামান বলেছেন: প্রত্যয় দীপ্ত মহত জীবন সাধনায় সঞ্জিবনী শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
ড. খুরশীদ আহমেদের মতে: স্বকীয় সংস্কৃতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি করা………এবং জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আল্লামা ইকবালের মতে: পূর্ণাংগ মুসলিম তৈরি করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য। [২]

ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্য:

ইসলামী শিক্ষা বলতে আসলে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষাকেই বুঝানো হচ্ছে। আর বলাবাহুল্য যে এ শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বেসর্বা আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। আল্লাহর পরিচয় এবং তাঁর কাছে জবাবদিহিতার ভয় তথা তাকওয়াই পারে মানুষকে মানুষ বানাতে। একজন মুত্তাকী বা আল্লাহভীরু ব্যক্তি লোকসমাজে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যা বলেই গণ্য হোন না কেন, তাঁর হাতে কেউ অনিষ্টের শিকার হবে না। তিনি যেদিকেই যাবেন শুধু আলোই ছড়াবেন। তাঁর হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে পরিবেশ, প্রতিবেশি ও প্রাণীকুল- সবই নিরাপদ থাকবে। তাঁর মহানুভতার কাছে হার মানবে উদ্ধত স্বৈরাচারি থেকে নিয়ে বনের বাঘ ও সরিসৃপরা পর্যন্ত।

মিকদাদ ইয়ালজিন বলেন: ’ইসলামের আনীত আকীদা, মূল্যবোধ ও শিক্ষাদান পদ্ধতির জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের জন্য সব দিক থেকে মুসলিমকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তোলা।’ [মিকদাদ ইয়ালজিন, পৃষ্ঠা : ২০]

আবদুর রহমান নকীব বলেন: ‘ইসলামী শিক্ষা বলতে ওই শিক্ষা ব্যবস্থা যার লক্ষ্য কুরআন ও সুন্নাহর চরিত্র তৈরি করা, যার অল্পেরই তা পেশা হয়ে থাকে।’ [আবদুর রহমান নকীব, ১৭]

দুইয়ের মধ্যে ফারাক:

ইসলামী তথা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহকে জানা, তাঁর একত্ববাদ তথা তাওহীদকে জানা, এককভাবে তাঁর ইবাদত করার পদ্ধতি শেখা। এ লক্ষ্যেই দুনিয়া এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছুকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণেই জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আধুনিক জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য, ওই অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মাধ্যম হিসেবে নশ্বর বস্তুবাদী সুবিধা অর্জন। আর এ দুই উদ্দেশ্যের মাঝে ফারাক ইউসুফ আলাইহিস সালামকে ক্রয় ও গুটিকতক দিরহামের মাঝে যে তফাৎ সে তফাৎ। এ দুটির ফারাক হলো, আল্লাহর যিকর ও তাঁকে ভালোবাসা এবং পানাহার ও পরিধানের মাঝে যতটুকু তফাৎ ঠিক ততটুকু। দ্বিতীয়টি, আল্লাহ্ যাদেরকে ভালোবাসেন অথবা যাদেরকে ভালোবাসেন না, সবাই পেতে পারে। কিন্তু প্রথমটি কেবল আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন তারাই পেয়ে থাকে। এতেই বুঝা যায় কোন জ্ঞান অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য? এবং দুটির মর্যাদার তারতম্য কতটুকু?

হ্যা, মুসলিমকে প্রয়োজনীয় আধুনিক জ্ঞানও শিখতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করাও তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। সুতরাং তার উচিত উল্লেখিত হবে তারতম্যটাকে মাথায় রেখে এ দুটোর ওপরই গুরুত্ব দেয়া। উদাহরণত যদি কোনো ছাত্র গণিত, কৃষিশিক্ষা ও রসায়ন অধ্যয়নে এক ঘন্টা সময় ব্যয় করে তাহলে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ অধ্যয়নে তার ন্যূনতম দুই ঘন্টা সময় ব্যয় করা উচিত। এর বিপরীতটা করা সমীচীন হবে না। অর্থাৎ অগ্রাধিকার দিতে হবে ইসলামী তথা দুনিয়া ও আখিরাত- উভয় জগতের কল্যাণদাতা কুরআন ও সুন্নাহ কেন্দ্রীক জ্ঞানকে। ফরয ইলম অর্জন সবাইকেই করতে হবে। আর বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে হবে কতিপয়কে। অনুরূপ জাগতিক স্বার্থ ও কল্যাণ সংক্রান্ত জ্ঞানেও কিছু লোককে প্রাজ্ঞতা ও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। যারা ফরয ইলম অর্জন করে মানুষের খেদমত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে নিজের মেধা ও শ্রম দেবেন জাগতিক প্রয়োজন পূরণে যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা-আবিস্কারের পেছনে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাই মুসলিমদের সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে অবশ্যই প্রয়োজন পরিমাণ ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইসলামের শিক্ষাশূন্য কোনো ব্যবস্থা মুসলিমের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সাধারণ শিক্ষা সিলেবাস থেকে ইসলামী শিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার কুফল

ছাত্র সে যে স্তরেরই হোক না কেন, ইসলামী শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধু বৈষয়িক শিক্ষায় তার সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করবে, এ চিন্তাও করা যায় না। ইদানীং ইউরোপ ও আমেরিকার অধিবাসী পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের অনুকরণে মুসলিম বিশ্বে যেসব বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে সেগুলোতে এমনই হচ্ছে। এর ফলে ছাত্ররা কল্যাণকর জ্ঞান ও নেক আমল থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ মানবাত্মা নগদের প্রতিই বেশি আগ্রহী; বিশেষত সে নগদটা যদি পার্থিব কিছু হয়। আর বাকির প্রতি বিরাগী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘কখনো না, বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাস। আর তোমরা ছেড়ে দিচ্ছ আখিরাতকে।’ [সূরা কিয়ামাহ, আয়াত : ২০-২১]

এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের হাফেজকে মুখস্তকৃত অংশটাকে বিরতহীনভাবে বারবার পাঠ করার প্রতি জোর তাকিদ দিয়েছেন। যেহেতু কুরআনে কারীম লাগামের জন্য প্রস্তুতকৃত উটের চেয়েও অবাধ্য। আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘তাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি কতই না খারাপ যে বলে অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। বরং তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা কুরআন স্মরণ রেখ। কারণ উট যেমন তার রশি থেকে পালিয়ে যায় কুরআন তার চেয়েও দ্রুত চলে যায় মানুষের বক্ষ থেকে।’ [বুখারী : ৫০৩২; মুসলিম : ১৮৭৭]

হ্যাঁ, পরিপূর্ণভাবে পার্থিব জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করা তাদের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে যাদের জন্য আখেরাতে কোনো প্রাপ্তি নেই, যারা আল্লাহর সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করে না। যারা পার্থিব জীবন নিয়ে যারা সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত। আর মুমিন, যিনি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ প্রত্যাশী, তার তো সে সুযোগ নাই। যেহেতু মুমিন এমন এক ব্যবসায় আশ্বাসী যে ব্যবসাতে লোকসান নাই।

মুসলিমরা জাগতিক জ্ঞান নিয়ে যতই মগ্ন থাকুক না কেন, কল-কারখানা ও পরীক্ষাগারে জাগতিক জ্ঞানের যতই প্রয়োগ ঘটাক না কেন, কোনো অবস্থাতে কোনো সময়ে ফরয ইবাদত আদায়ের ব্যাপারে তাদের গাফেল হওয়ার সুযোগ নেই। আর ইলমে দীন তাদেরকে তাদের ইবাদত-বন্দেগী আদায়ের সঠিক নির্দেশনা প্রদান করে। বিশেষভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা বলতে হয়। সালাত হচ্ছে ইসলামের ভিত্তি। কোনো গবেষণা ল্যাবে অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অথবা অফিস-আদালতে থেকে সালাত পরিত্যাগ করার কোনো সুযোগ নাই।

মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্যই কি শিক্ষা ?

বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রেই হয়তো খেয়াল করেছেন যে দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজের দরজা বা দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় : ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্ব অর্জন’ এবং ‘শেখার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও’। আমি যখনই কোনো বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে পথ অতিক্রম করি, বাক্যদুটি যেন আমাকে ভাবিত, দ্বিধান্বিত এমনকি ব্যথিত করে।

শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি মনুষ্যত্ব অর্জনই হয় তাহলে পশুত্ব ও পাশবিকতার এমন জয়জয়কার কেন চারদিকে? মনুষ্যত্বের এত অভাব কেন সর্বত্র? সেবার জন্যই জন্য শিক্ষিত, সার্টিফিকেটপ্রাপ্তরা বেরিয়ে এসে থাকেন তাহলে কেন সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষ ঠকাবার হরেক আয়োজন? নিরেট সেবাখাতগুলোতেও কেন সেবা হয়ে উঠছে সোনার হরিণ?

বাক্যদ্বয় সঠিক হলে শিক্ষিতের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনাচার না কমে শুধু বেড়েই চলেছে কেন? সামাজিক নানা অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছে কেন? সভ্যতা যত ওপরে উঠছে কেন ততধিক নিচে নামছে মানুষ। আগে মানুষ অন্যায় করে নিজেকে অপরাধী ভাবত, অন্যায়কারীর প্রতি মানুষের বিশ্বাস, সম্মান তলানিতে গিয়ে ঠেকত। কিন্তু এখন কেন তার উল্টো হচ্ছে? দেদারছে অপরাধ করছে আবার দিব্যি বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে অনাচারিরা। সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকের প্রতি অবহেলা ও অনাদর প্রদর্শন করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে অসৎ, প্রতারক ও অশিষ্ট জনদের সালাম ঠুকা হচ্ছে! মনুষ্যত্বহীন মানবদলের জন্য কি নিচের চরণগুলো অবমাননাকর? নাকি নিঠুর সত্যের সাহসী উচ্চারণ ? কুরআনের আলো বঞ্চিত শিক্ষিতদের আচরণে বিরক্ত ও ব্যথিত কবি তাই লিখেন :

মডার্ন যুগের মানুষ

নিজকে সবাই চালাক ভাবে পরকে ভাবে বোকা,
চিন্তা সবার কেমনে দেবে অন্য জনে ধোঁকা।
লৌকিকতার প্রদর্শনী সবার কথায় কাজে,
নিজকে ভাবে সম্মানী আর পরকে ভাবে বাজে।
যত বড় মিথ্যাবাদী তত বড় চতুর,
সত্যবাদী প্যাচে পড়ে হচ্ছে নিয়ত ফতুর।
দিল ভুলানো কথার বাহার মন মাতানো হাসি,
হিংসা মনে বলছে মুখে তোমায় ভালোবাসি।
সামনে এলে কয় জ্বী হুজুর পশ্চাতে কয় শালা,
হায়রে মডার্ন যুগের মানুষ সবার হৃদে তালা!

ফলবতী গাছকে আমরা দেখি মাটির দিকে নুয়ে আসতে, কিন্তু ডিগ্রির বস্তা কাঁধে নুয়ে আসা মানুষগুলোকে বৃথা আস্ফালনে উদ্ধত হতে দেখি কেন? কথায় কথায় অহংকার, চলাফেরা কিংবা পোশাক-আশাকই বাদ যাবে কেন। সবখানেই গর্ব, মেকি আভিজাত্য আর অহংকারের ছাপ। লৌকিকতা, বাগাড়ম্বর ও অপরের প্রতি হেয় ভাব।

ধরুন কোনো বিদ্যালয়ের সামনে একটি দুর্ঘটনায় কোনো শিক্ষার্থী আহত বা নিহত হলো, তারপর কি হবে তা বুঝি সচেতন কোনো নাগরিককেই বলে দিতে হবে না। তুমুল ভাংচুর শুরু হয়ে যাবে। ওই রাস্তা দিয়ে যতগুলো যানবাহন যাবে সবগুলোকেই এ দুর্ঘটনার জন্য শাস্তি পেতে হবে। লাখো কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিচ্ছায় সংঘটিত ঘটনার দায় নিয়ে হাজার হাজার যাত্রীকে এর জন্য দুর্ভোগ সইতে হবে। শুধু দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন হয়? কোনো শিক্ষকের সামান্য ভুল বা বিচ্যুতি হলেও তাদের ভাগ্যে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী কর্তৃক নানা লাঞ্ছনা ও অবমাননাকর উক্তি বা আচরণ বরদাশত করতে হয়।

সংবাদপত্রের পাতা ওল্টালেই রোজ দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনার নিত্যনতুন কৌশলের খবর দেখি। ডিজিটাল যুগে ফাইল আটকানো, মানুষকে ঠকানো ও প্রতারিত করার নানা কলা-কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। ডিজিটাল সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, সুদ-ঘুষ, নারী নির্যাতন, পুরুষ পীড়ন আর কটু-কাটব্য তো এনালগ যুগের মানুষদের দিয়ে হচ্ছে না। হচ্ছে আধুনিক শিক্ষিত সুটেড-বুটেড ভদ্রলোকদের দিয়েই। কৃতিত্বের সঙ্গে এদের উৎরে আসা বিদ্যালয়গুলোর দেয়াল বা দরজায় কি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা অঙ্কিত ছিল না?

যখন কোনো আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী ছিল না, উচ্চতর প্রযুক্তি ছিল না, তখনকার বানানো তাজমহল, পিরামিডগুলো যুগযুগান্তরের বিস্ময় হয়ে এখনো টিকে আছে। অথচ যথারীতি শিক্ষা ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত আধুনিক নির্মাণ কৌশল ও সামগ্রী সজ্জিত এ যুগের স্থাপত্যবিদদের বানানো দালান ভেঙে পড়ে ফি বছর মানুষকে জীবন দিতে হয়। এভারেস্টকে পদানত করা, ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগকে জয় করা এবং মহাকাশে যাত্রা করা মানুষগুলোই পারে না পাশের বাড়ির মানুষকে, পেছনে দৌড়াতে থাকা ইতর প্রাণীটিকে সুখী করতে?

একদিন এক দূরপাল্লার গাড়িতে ভদ্রবেশি যুবক কন্ডাক্টরকে দেখলাম সাদামাটা একজন গ্রাম্য মুরুব্বির সঙ্গে অভব্য ভাষায় তর্ক করতে। মনে মনে ভাবছিলাম অশিক্ষিত দারিদ্রক্লিষ্ট হেলপার কন্ডাক্টরের ভাষা এর চেয়ে ভালো আর কী হবে? কিন্তু খানিক বাদেই সে পাশের সিটের এক যুবক যাত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে জানালো সে ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে! গাড়িটি তার নিজের। ছুটির দিন ছিল বলে সে নিজেই এসেছে কন্ডাক্টরকে রেখে। অকস্মাৎ ওই গ্রাম্য মুরুব্বির তীর্যক মন্তব্য শুনতে পেলাম। ‘বাবা, আমি নিজে অশিক্ষিত হলেও ছেলেটাকে শিক্ষিত করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালছি। কিন্তু এই কি সেই শিক্ষিত মানুষের ভাষা? এর চেয়ে তো আমার মতো চাষাদের আচার-ব্যবহারও ভালো।’ এমন ওজস্বী বাক্য শুনে আমিসহ আশপাশের সিটের ভদ্রলোকেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।

পাশের বাসার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক মেয়ের কিছু কথা শুনে অনেকদিন পর ওই গ্রাম্য মুরুব্বির কথা আবার মনে পড়ল। রাজধানী ঢাকার একটি শীর্ষস্থানীয় নামকরা স্কুলের সাধারণ একজন কর্মকর্তা মাকে সে মুখের ওপর বলে দেয়, ‘আমার স্কুলে আপনি গিয়ে আপনার পরিচয় দেবেন না। আমি তাতে সবার কাছে ছোট হয়ে যাব। আপনি সবার সামনে আমাদের পরীক্ষার হলে স্যারদের ফুটফরমাশ খাটবেন দেখলে আমার মাথা হেঁট হয়ে যাবে।’ নিজের গর্ভধারিনী মাকে এমন কথা বলেছে জেনেই তাকে মন্দ ঠাওরালে অন্যায় হবে। একটু পেছনের ইতিহাসও সংক্ষেপে জানতে হবে। মনুষ্যত্বের পাঠ নিয়ে আমরা কত বড় অমানুষ হচ্ছি তা বুঝাতে এর উল্লেখই যথেষ্ট হতে পারে।

মেয়েটির বাবা মারা গেছেন এক ছেলে এক মেয়ে রেখে। তিনি ছিলেন হাইকোর্টের একজন ডাকসাইটে এ্যাডভোকেট। যুবতী মা তখন এতিম দুই সন্তানকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে যান। দেবর-ভাসুররা অস্বীকার করেন এতিম দুই ভাইপো ভাইজিকে তাদের পিতার হিস্যা দিতে। শ্বশুর মহোদয়ও মুখের ওপর  বলে দেন, ‘তোমাকে কিছু দেয়া নিরাপদ নয়, না জানি কবে কার সঙ্গে ভেগে চলে যাও।’ জনমদুখী এই মাকে তখন তাঁরই গর্ভধারিনী মা বলেন, ‘দেখ সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তোর জীবনসংগ্রামে নামার দরকার নাই। আজকালকার যা ছেলে-মেয়ে, ওরা তোর জন্য কিছু করবে না। বুড়োকালের কথা কল্পনা কর হলেও তুই আমাদের দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দে।’ কিন্তু এতিম দুই সন্তানের কথা ভেবে মা জননী অন্য কারও মায়াজালে জড়ান নি।

ঢাকায় এসে বহু কষ্টে দেশের সেরা ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে বৈধব্য জয়ের মিশনে নামেন। নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের নামি-দামি স্কুলে ভর্তি করান। সুবহে সাদিকের আগে উঠেন। ওদের জন্য সারাদিনের খাবার তৈরি করে কাকডাকা ভোরেই ছোটেন কর্মস্থলে। সন্ধ্যায় কর্মক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে রোজই তাকে চেচামেচি করতে হয় ওদের পেছনে। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নাই। পড়াশোনাতেই নেই মন। স্টাফের সন্তান হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির সুযোগ থাকলেও ছেলেটি নিজের মান-সম্মান যাবে ভেবে মায়ের সেই নামী স্কুলে ভর্তি হয়নি। আর মেয়েটির হয়েছে ভিন্ন গতি। একই ক্লাসে এবার তার দ্বিতীয় পরীক্ষা। এবার এ বার্ষিক পরীক্ষায় ফেলও তার মোটামুটি নিশ্চিত। পড়াশোনার খবর নেই। টিভি দেখা আর প্রসাধন চর্চা চলছে অবিরাম।

পাশের স্কুলে পড়ে বলে মা সহজেই স্যারদের কাছ থেকে মেয়ের পরীক্ষার খাতার খবর নিতে পারেন। ওই স্কুলের অনেক খাতা তাঁর স্কুলের স্যারদেরও অনেক সময় দেখতে হয়। তিনি ভেবেছিলেন মেয়ের পরিচয় দিলে হয়তো কোনো স্যার দয়ার্দ্র হয়ে তাকে পাশ নাম্বার দেবেন। সে বিবেচনায় কেবল মেয়েকে বললেন, ‘মা, আমি কি তোর খাতার খোঁজ-খবর নিয়ে স্যারের কাছে সুপারিশ করব?’ অমনি সে দুধ-কলা দিয়ে পোষা জীবনহরণকারী সাপের মতো ফণা তুলে ওই উত্তর দেয়। আমার স্ত্র্রী মারফত জেনেছি ওই দুখীনি মা সারাদিন কষ্টে কিছু খেতে পারেন নি। লজ্জা, বেদনা ও অপমানে তিনি সারাদিন কেবলই বোবা কান্নায় অতীত হাতড়েছেন।

আশা করি আর বলার দরকার নেই, সন্তানের জনক-জননী বলতেই ওই ব্যথিত মায়ের করুণ রোদন শুনতে পারছেন। হায় আল্লাহ, এ কেমন মনুষ্যত্বের নমুনা! এ কেমন অকৃতজ্ঞতা! এমন কৃতঘ্নতা দেখে পশুরাও বুঝি লজ্জা না পেয়ে পারে না।

পাঠক, এতক্ষণে বুঝি আমাকে আধুনিক শিক্ষাবিরোধী কিংবা প্রযুক্তিবিমুখ সেকেলে ভেবে নিশ্চিত হয়েছেন। আসলে তা নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি শিক্ষানুরাগী এবং প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ। বিদ্যা আহরণেই কাটে আমার দিনমান। আর প্রযুক্তির সঙ্গেই আমার দিবসরাতি। সত্যকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বলেই এসব ঘটনার অবতারণা। সবার অনুভূতিকে জাগ্রত করতেই এ মৃদু করাঘাত। সত্যটা হলো মানুষ যত শিক্ষিতই হোক না কেন, নৈতিকতার উন্মেষ এবং আল্লাহভীতির জাগরণ না ঘটানো গেলে সে শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিতই বানাতে পারে; মানুষ নয়। এভাবে চলতে থাকলে অবস্থার শুধু অবনতিই ঘটবে; উন্নতি নয়।

সহজে কথাটি ব্যাখ্যা করা যাক। চৌদ্দশ বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। মনুষ্যত্ব হারানো আর মানবিক মূল্যবোধ থেকে সরে যাওয়া সে যুগটাকে বিশ্ব ইতিহাসে জাহিলিয়া বা বর্বরতার যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানুষকে কোনো জঘন্য কাজে প্রবৃত্ত হতে দেখলে এখনো মানুষ তাকে জাহেল বর্বর বলে নিন্দা জানায়। কিন্তু সে যুগেরই একদল লোক সহসা বদলে যান। শুধু বদলে যাওয়া কেন, বলতে গেলে পুরো দুনিয়াতেই বদলে দেন। তাঁদের সৌজন্যে মানবেতিসই লিখতে হয় নতুন করে। ধূলির ধরা হয়ে ওঠে অদেখা জান্নাত। তাঁদের ইতিহাস পড়ে এখনো মানুষ বিস্ময়ে থ হয়ে যায়। তাঁদের মনুষ্যত্ব বোধ ও আত্মদানের উপমা তুলে ধরে এখনো মানুষ মানবতা ও মহানুভতার পাঠ গ্রহণ করে।

কিন্তু তা কিসের বদৌলতে? কোন পরশ পাথরের ছোঁয়ায় এ রূপান্তর? সেটি কিন্তু এ শিক্ষার বদৌলতেই সাধিত হয়েছিল। শিক্ষার আলোই তাড়িয়ে দিয়েছিল সব আঁধারকে। তবে সে শিক্ষা যতটা না ছিল ভোগের। তারচে বেশি ছিল ত্যাগের। জাগতিকতা ও বস্তুর আসক্তি শেখায় নি তা। অক্ষম জড়বস্তুর পূজা ত্যাগ করে তা শিখিয়েছিল শক্তির আধার, সব কিছুর একক স্রষ্টা ও নিয়ন্তা আল্লাহর দাস হতে। আর তা ছিল ইসলামী শিক্ষা বা ইলমে ওহী।

ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য :

ইলম আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো জ্ঞান বা শিক্ষা (Knowledge বা Education)। ইসলামী শিক্ষা তথা কুরআনী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা একদল লোককে এর জন্য নিয়োজিত হবার নির্দেশ দেন। ইরশাদ করেন: ‘অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।’ [সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ১২২]

পবিত্র কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিতেও শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন নিচের আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘পরম করুণাময়। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ [সূরা আর-রহমান, আয়াত : ১-৪]

আয়াতে করুণাময় মানুষকে দেয়া তাঁর তিনটি নেয়ামতের কথা বলেছেন। কুরআন শেখানো, মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া। সাধারণভাবে বললে বলা হত মানুষ সৃষ্টি করেছেন তারপর তাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করার আগে কুরআন শিক্ষা দেয়ার কথা বলা থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দয়াময় আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তবে যারা কুরআন তথা কুরআনী শিক্ষা পায় নি তাদের যেন মানুষই গণ্য করেন নি তিনি।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে তিনি তাঁর রাসূলকে যে দায়িত্বগুলো দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাঁর একটি হলো শিক্ষা বিতরণ করা এবং কুরআন শিক্ষা দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে: ‘যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।’ [সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৫১]

একই বিষয়ে অপর সূরায় বলা হয়েছে: ‘তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।’ [সূরা আল-জুমুআ‘, আয়াত : ০২]

সুফয়ান ইবন উয়াইনা রহ. কে ইলমের মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা কি আল্লাহর বাণীর প্রতি লক্ষ্য করো না তিনি তো কী দিয়ে শুরু করেছেন?

‘অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং নিবাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।’ [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত : ১৯]

এ আয়াতে আল্লাহ আমলের কথা বলেছেন ইলমের পরে।

ইলম হলো নূর, যা দিয়ে মানুষ নানা বিষয়ের হাকীকত ও তাৎপর্য দেখতে পায়। এ দৃষ্টি ঠিক চোখের দৃষ্টি নয়। বরং অন্তরচক্ষু। আল্লাহ বলেন: ‘তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের হত এমন হৃদয় যা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এমন কান যা দ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।’ [সূরা আল-হজ্জ, আয়াত : ৪৬]

এ জন্য আল্লাহ মানুষকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। একদল আলিম (জ্ঞানবান) অন্যদল অন্ধ (জ্ঞানহীন)। ইরশাদ ‘যে ব্যক্তি জানে তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা সত্য, সে কি তার মত, যে অন্ধ? বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত : ১৯]

ইলম মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে। আর আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে। আল্লাহ বলেন: ‘আর এমনিভাবে মানুষ, বিচরণশীল প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও রয়েছে নানা বর্ণ। বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।’ [সূরা আল-ফাতির, আয়াত : ২৮]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘বল, ‘তোমরা এতে ঈমান আন বা ঈমান না আন, নিশ্চয় এর পূর্বে যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে যখন এটা পাঠ করা হয় তখন তারা সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে।’ [সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ১০৭]

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান তাকে তিনি দীন সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা দান করেন।’ [বুখারী : ৫৬৪৫; মুসলিম : ২৪৩৬]

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে আসবে একমাত্র কল্যাণ অর্জনের জন্য যা সে শিখবে বা শেখাবে, সে আল্লাহর পথে মুজাহিদের স্তরে। আর যে এ ছাড়া অন্য উদ্দেশে আসবে, সে ওই ব্যক্তির স্তরে যে অন্যের বস্তুর প্রতি তাকায়।’ [ইবন মাজা : ৬৪৭২, হাদীসটি সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।]

প্রয়োজনীয় ইলম সবার জন্যই ফরয। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘ইলম শিক্ষা করা প্রতিটি মানুষের ওপর ফরয।’ [ইবন মাজাহ্‌ : ২২৪]

শুধু তাই নয় আমরা দেখতে পাই, শেষ নবীর ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহীতেই বলা হয় ‘পড়’।

শেষ কথা:

শুধু শিক্ষা অর্জন বা জ্ঞানার্জন করলেই হবে না তা হতে হবে রব বা প্রতিপালক তথা আল্লাহকে সন্তুষ্টির নিমিত্তে। আমাদের গলদ আজ এখানেই। সবাই উপলব্ধি করছি পড়ার গুরুত্ব। সবাই গাইছি শিক্ষা ও বিদ্যার মাহাত্ম্য। অথচ এর সঠিক লক্ষ্যের কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীগুলোর দিকে তাকালেও আমরা এমন ধারণা পাই। আলহামদুলিল্লাহ, মুসলিম ভাই-বোনেরা এখনো একথা স্বীকার করেন যে, ইসলামেই শিক্ষার প্রতি সবচে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আলবৎ ঠিক। একেবারে হক কথা। কিন্তু শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আমরা যত বলছি, এর উদ্দেশ্য ও অর্জন নিয়ে ততটা বলছি না। এর ফলাফল নিয়ে ভাবছি না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপকারী জ্ঞান শেখার এবং সে অনুযায়ী আমলের তাওফীক দিন। আমাদের সকলকে তাঁর দীনের ইলম প্রচারে খাদেম হিসেবে কবুল করুন।

আমীন।


[১] ইন্টারনেটেপ্রাপ্ত বিভিন্ন লেখা থেকে সংগৃহীত

[২]  ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন লেখা থেকে সংগৃহীত

ওয়েব এডিটিং: শাবাব শাহরিয়ার খান

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

4 COMMENTS

  1. hahahahah ….. thats toooooo high class stuff ….. general people will never have access to that …. not mentally nor physically /…

  2. […] বিশিষ্ট দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,­ ‘নিজেকে জানার নামই শিক্ষা’।আমেরিকান শিক্ষাবিদ জন ডেউয়ে বলেছেন, ­‘প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ ও মৌলিক মেজাজ প্রবণতা বিন্যাস করার প্রক্রিয়াই শিক্ষা।’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মানবধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,­ ‘মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে শিক্ষা।’কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মানুষের খুশির বা রূহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা।’ [১] […]

আপনার মন্তব্য লিখুন