ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়

1
3571

অনুবাদক: শিহাব উদ্দিন হোসাইন আহমদ

আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, “জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না।” [বোখারি-৫৬৫১]

আভিধানিক ব্যাখ্যা

তিনি ছিলেন রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবি জারিয়া বিন কুদামাহ (রা.)। অর্থাৎ, যে সকল কারণে রাগ আসে সেগুলো থেকে দূরে থাক। সে ব্যক্তি বারংবার প্রশ্ন করে এ প্রত্যাশা করছিলেন যে, আরো অধিক উপকারী ও ব্যাপক কোন বিষয় রাসূল তাকে জ্ঞাত করাবেন। কিন্তু রাসূল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম অন্য কিছু না বলে একটি উপদেশের উপরেই ক্ষান্ত রইলেন।

হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়

(১) উলে¬খিত হাদিসটি রাসূলের ‘জামিউল কালাম’- এর মধ্য থেকে অন্যতম। সংক্ষিপ্ত শব্দে যাতে ব্যাপক অর্থময় মর্মের বিস্তার করা হয়। বিজ্ঞ আলেমগণ এ হাদিসের সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেননা এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, সূক্ষ্মতা ও গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নবী রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসরণ ও জীবনে পূর্ণ বাস্তাবায়ন করা।
(২) ক্রোধ হল মানুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা। যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এই ক্রোধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্রোধ বিষয়ে মানুষের যেমন বিভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তেমনিভাবে এ বিষয়ে ইসলামেরও দিক নির্দেশনা দিয়েছে নানাভাবে। মানুষের উচিত এ গুলোকে ভালোভাবে অবলোকন করা, এবং সঠিক ও যথাযথ উপায়ে প্রয়োগ করা।

ক্রোধের প্রকার

ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।

(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধ: যেমন আললাহর প্রতি মহব্বত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আললাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আললাহর নিকট পুরস্কৃত হবে। আললাহ তাআলা বলেন: “এটাই বিধান। আর কেউ আললাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম।” [সূরা হজ : ৩০]

(খ) নিন্দনীয় ক্রোধ: এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আললাহর নিকট ঘৃণিত।
(গ) স্বভাবগত ক্রোধ: যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ক্রোধের কতিপয় কারণ

(ক) স্বভাবগত ক্রোধ
(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ
(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ
(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ
(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রƒপ জনিত ক্রোধ

ক্রোধের পরিণাম খুবই অমঙ্গলজনক

(ক) ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
(খ) ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
(গ) ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
(ঘ) ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
(ঙ) ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
(চ) ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক—যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক—এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
(জ) ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।

এই ক্ষতিকর ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়

(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।
(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আললাহর জিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া। তাই যখন মানুষ আললাহর জিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ বলেন: “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল¬াহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে , জেনে রাখ আললাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।” [রা’দ: ২৮]
(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আললাহ বলেন: “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত: আললাহর সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন।” [আলে ইমরান: ১৩৩, ১৩৪]
রাসূল বলেন: “ক্রুদ্ধ হয়ো না, প্রতিদানে তোমার জন্য জান্নাত।” [যাদুদ দায়িয়াহ : ৪৯]
(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।
(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।
(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।
(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিবে। কেননা মানুষ শয়তানের প্রভাবে ক্রোধাক্রান্ত হয়, যখন সে উক্ত বাক্য পাঠ করে তখন শয়তান পিছু হটে যায়, যেমন হাদিসে আছে: “দ্ইু ব্যক্তি রসুলের সামনে একে অন্যকে কটু বাক্য বলছিল। তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি এমন বাণী সম্পর্কে অবগত, যদি সে তা পাঠ করত, তবে তার ক্রোধ দূরীভূত হত। যদি সে আউযু বিল¬লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলত, তবে তার ক্রোধ দূর হয়ে যেত।” [বোখারি: ৫৬৫০]
(৭) মোমিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আললাহর পথে আহ্বায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আললাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন