নবী (সাঃ) যেভাবে হজ করেছেন পর্ব- ৩

1
1984

সংকলনঃ শাইখ মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দীন আল-আলবানী (রহ)অনুবাদঃ মুফতী নুমান আবুল বাশার, ড. এটিএম ফখরুদ্দীন

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব- ৩ | পর্ব- ৪ | পর্ব- ৫ 

রাসূলুল্লাহ -এর মত ইহরাম বেঁধে ইয়ামান থেকে আলী রা.-এর আগমন

এদিকে আলী (রা.) তাঁর কর্মস্থল ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের উটগুলো নিয়ে আগমন করলেন।[66] তিনি ফাতিমা (রা.) কে তাদের মধ্যে পেলেন যারা হালাল হয়েছেন। তিনি মাথা আঁচড়িয়েছেন, [67] রঙ্গীন পোশাক পরেছেন এবং সুরমা ব্যবহার করেছেন। তিনি ফাতিমা রা. কে এই অবস্থায় দেখে তা অপছন্দ করলেন। তিনি বললেন, তোমাকে এ রকম করার জন্য কে নির্দেশ দিয়েছে? [68] ফাতেমা (রা.) বললেন, আমার পিতা আমাকে এ রকম করার নির্দেশ দিয়েছেন।

জাবের (রা.) বলেন, আলী রা. ইরাকে থাকা অবস্থায় বলতেন, ফাতেমার কৃতকর্মের ওপর উত্তেজিত অবস্থায় আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে গেলাম, ফাতেমা যা রাসূলের বরাত দিয়ে বলেছেন সে সম্পর্কে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলাম। আমি রাসূলকে জানালাম যে, আমি ফাতেমার এ কাজ অপছন্দ করেছি; কিন্তু সে আমাকে বলেছে, আমার পিতা আমাকে এরকম করতে নির্দেশ দিয়েছেন।[69] তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “সে সত্য বলেছে, সে সত্য বলেছে, সে সত্য বলেছে। [70] আমিই তাকে এরকম করতে নির্দেশ দিয়েছি।[71]

জাবের (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ আলী (রা.) কে বললেন, হজের নিয়ত করার সময় তুমি কী বলেছিলে? তিনি বললেন, আমি বলেছি, হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমি এভাবে ইহরাম বাঁধছি যেভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ ইহরাম বেঁধেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমার সাথে হাদী রয়েছে। সুতরাং তুমি হালাল হয়ো না। তুমি হারাম অবস্থায়ই থাকো যেমন আছ। [72]

জাবের (রা.) বলেন, ইয়ামান থেকে আলী (রা.) কর্তৃক আনিত হাদী এবং ‘মদীনা থেকে’ [73]  রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক আনিত হাদীর ‘মোট সংখ্যা ছিল একশত উট। [74]

জাবের (রা.) বলেন, নবী ﷺ ও যাদের সাথে হাদী ছিল, তাঁরা ছাড়া সব মানুষ হালাল হয়ে গেল এবং চুল ছোট করল।

৮ যিলহজ ইহরাম বেঁধে মিনা যাত্রা

অতপর যখন তারবিয়া দিবস (যিলহজের আট তারিখ) হল, তখন তাঁরা ‘তাদের আবাসস্থল বাতহা থেকে’ [75] হজের ইহরাম বেঁধে মিনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। জাবের (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আয়েশার কাছে গেলেন। তিনি  তাঁকে ক্রন্দনরত অবস্থায় পেলেন। তখন তিনি বললেন, তোমার কী হয়েছে? আয়েশা (রা.) বললেন, আমার হায়েয এসে গেছে। লোকজন হালাল হয়ে গিয়েছে; কিন্তু আমি হালাল হতে পারিনি। বায়তুল্লাহর তাওয়াফও করিনি। অথচ সব মানুষ এখন হজে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এটা এমন একটি বিষয়, যা আল্লাহ আদমের কন্যা সন্তানদের ওপর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি গোসল করে নাও। অতপর হজের তালবিয়া পাঠ কর। তারপর তুমি হজ কর এবং হজকারী যা করে তুমিও তা কর; কিন্তু বায়তুল্লাহ্র তাওয়াফ করো না এবং সালাত আদায় করো না। [76] অতপর তিনি তাই করলেন, কিন্তু বায়তুল্লাহ্র তাওয়াফ করলেন না। [77]

আর রাসূলুল্লাহ ﷺ উটের পিঠে আরোহন করলেন।[78] তিনি আমাদেরকে নিয়ে মিনায় যোহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজরের সালাত আদায় করলেন।[79] অতপর তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। এভাবেই সূর্য উদিত হলো।[80] তিনি নামিরা নামক স্থানে তাঁর জন্য একটি পশমের তাবু স্থাপন করার নির্দেশ দিলেন।[81]

আরাফায় যাত্রা ও নামিরাতে অবস্থান

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ রওয়ানা হলেন। কুরাইশদের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না যে, তিনি মাশ’ আরে হারাম (অর্থাৎ) মুযদালিফাতেই [82] অবস্থান করবেন এবং সেখানেই তাঁর অবস্থানস্থল হবে। কেননা কুরাইশরা জাহেলী যুগে এরকম করত।[83] কিন্তু রাসুলূল্লাহ ﷺ মাশ‘আরে হারাম অতিক্রম করে আরাফায় উপনীত হলেন এবং নামিরা নামক স্থানে তাঁর জন্য তাঁবু তৈরি করা অবস্থায় পেলেন। তিনি সেখানে অবতরণ করলেন। অতপর যখন সূর্য হেলে পড়ল, তখন তিনি কসওয়া নামক উটনীটি আনতে বললেন এবং তাতে সওয়ার হয়ে উপত্যকার মধ্যে এসে থামলেন। [84]

আরাফার ভাষণ

অতপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং বললেন,

  • ‘নিশ্চয় তোমাদের রক্ত ও তোমাদের সম্পদ তোমাদের জন্য সম্মানিত। যেমন তোমাদের এই শহরে, তোমাদের এই মাসে, তোমাদের এই দিন সম্মানিত’।
  • ‘জেনে রাখো! নিশ্চয় জাহিলিয়াতের প্রত্যেকটি বিষয় আমার এই দুই পায়ের তলে রাখা হল’।
  • ‘জাহিলী যুগের যাবতীয় রক্তের দাবী রহিত করা হল। আমাদের রক্তের দাবীসমূহের মধ্যে প্রথম রক্তের দাবী যা রহিত করা হল, তা ইবন রবী‘আ ইবনুল-হারিসের রক্তের দাবী। সে সা‘দ গোত্রে দুধ পানরত অবস্থায় ছিল। হুযাইল গোত্র তাকে হত্যা করেছিল’।
  • ‘জাহেলী যুগের সুদ রহিত করা হল। সর্বপ্রথম যে সুদের দাবী রহিত করছি তা হল আববাস ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিবের সুদ। তার পুরোটাই রহিত করা হল’।
  • আর তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহ্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহকে আল্লাহর বাণী দ্বারা হালাল করে নিয়েছ।[85]
  • ‘নিশ্চয় তোমাদের ব্যাপারে তাদের ওপর দায়িত্ব হচ্ছে, তারা যেন  তোমাদের বিছানাসমূহকে এমন কোন ব্যক্তি দ্বারা পদদলিত না করে যাকে তোমরা অপছন্দ কর (অর্থাৎ তারা যেন পরপুরুষদেরকে তাদের কাছে আসার অনুমতি না দেয়)। যদি তারা তা করে, তবে তোমরা তাদেরকে মৃদুভাবে প্রহার কর।’
  • ‘আর তাদের ব্যাপারে তোমাদের উপর দায়িত্ব হচ্ছে, উত্তম পন্থায় তাদের ভরণ-পোষণ ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করা’।
  • ‘আমি তোমাদের মধ্যে এমন এক বিষয় রেখে যাচ্ছি, যা তোমরা আঁকড়ে ধরলে আর কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো, আল্লাহর কিতাব’।
  • ‘আমার ব্যাপারে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে, তখন তোমরা কী বলবে ? তারা বলল, আমরা সাক্ষী দিচ্ছি, নিশ্চয় আপনি আপনার রবের বাণীসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, অর্পিত দায়িত্ব আদায় করেছেন, উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন’।
  • ‘অতপর তিনি তাঁর শাহাদাত অঙ্গুলী আকাশের দিকে তুলে মানুষের দিকে ইশারা করে বললেন, হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন’।

দুই ওয়াক্ত সালাত একসাথে আদায় ও আরাফায় অবস্থান

এরপর বিলাল (রা.) একবার আযান দিলেন। [86] অতপর ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ (সবাইকে নিয়ে) যোহরের সালাত আদায় করলেন। বিলাল রা. পুনরায় ইকামত দিলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ আসরের সালাতও আদায় করলেন। তিনি উভয় সালাতের মাঝখানে অন্য কোন সালাত আদায় করেননি। অতপর রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘কাসওয়া নামক উটনীর’ [87] পিঠে আরোহন করলেন। এভাবে তিনি উকূফের স্থানে এলেন। তাঁর উটনী কসওয়ার পেট পাথরের [88] দিকে ফিরিয়ে রাখলেন। যারা পায়ে হেঁটে তাঁর সাথে এসেছিলেন, তিনি তাঁদের সকলকে তাঁর সামনে রাখলেন এবং কিবলামুখী হলেন।[89] সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই উকূফ করলেন। এমনিভাবে (পশ্চিম আকাশের) হলুদ আভা ফিকে হয়ে গেল এমনকি লালিমাও দূর হয়ে গেল। [90]

আর তিনি বললেন, ‘আমি এখানে উকূফ করলাম; কিন্তু আরাফার পুরো এলাকা উকূফের স্থান।[91]

এরপর তিনি উসামা ইব্‌ন যায়েদ রা. কে তাঁর উটনীর পেছনে বসালেন।

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব- ৩ | পর্ব- ৪ | পর্ব- ৫ 

চলবে……………

Source: IslamHouse.Com

……………………………………………………………………………………………..


[66] মুসলিম, নাসাঈ।
[67] ইবনুল-জারূদ।
[68] আবূ দাউদ, বায়হাকী।
[69] আবূ দাউদ, বায়হাকী।
[70] নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ।
[71] নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ।
[72] নাসাঈ।
[73] নাসাঈ, ইবন মাজা।
[74] দারমী।
[75] বুখারী, মুসলিম।
[76] মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ।
[77] মুসনাদে আহমদ।
[78] এ থেকে বুঝা যায় এসব স্থানে হাঁটার চেয়ে আরোহনই উত্তম; যেমন পুরো রাস্তায় হেঁটে আসার চেয়ে বাহনে আসা উত্তম। দেখুন : আত-তা‘লীক : ১৬।
[79] আবূ দাউদ।
[80] এ থেকে জানা গেল, মিনায় রাত্রিযাপন করা এবং সকালের আগে এস্থান ত্যাগ না করা সুন্নত।
[81] আবূ দাউদ, ইবন মাজা।
[82] আবূ দাউদ, ইবন মাজা।
[83] হজ পালনকারী সাহাবীগণকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ আরাফার ময়দানে অবস্থান করলেন এবং এ-ক্ষেত্রেও মুশরিকদের বিপরীত করলেন, কেননা মুশরিকরা মুযদালিফায় অবস্থান করতো এবং বলতো আমরা হারাম এলাকা ছাড়া অন্য জায়গায় যাব না এবং সেখান থেকে প্রস্থান করব না। উল্লেখ্য, আরাফা হারাম এলাকার বাইরে অবস্থিত।
[84] এ উপত্যকার নাম হচ্ছে ‘উরনা’। এটা আরাফা এলাকার বাইরে অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ এই উরনা উপত্যকা থেকে আরাফার ভাষণ দিয়েছেন।
[85] আল্লাহর বাণীটি হচ্ছে, ﴿فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ﴾ ‘তাহলে তোমরা বিয়ে কর মহিলাদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে’ (নিসা : ৩ )।
[86] দারেমী।
[87] ইবন মাজা।
[88] এ পাথরটি জাবালে রহমতের নিচে বিছানো। জাবালে রহমত অবস্থিত আরাফার মাঝামাঝি স্থানে। ইমাম নাববী রহ. বলেন, এটিই উকূফের মুস্তাহাব স্থান। অনেকে মনে করেন জাবালে রহমতে না ওঠলে উকূফ পূর্ণ হবে না- এটি সঠিক নয়।
[89] অন্য হাদীসে এসেছে, তিনি উকূফ করেছেন, উভয় হাত তুলে দু‘আ করেছেন। হাজ্জাতুন-নবী : ৭৩ পৃষ্ঠা।
[90] সূর্যাস্তের পর আরাফা থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রস্থান মুশরিকদের আচারের সাথে ভিন্নতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই ছিল। কেননা মুশরিকরা সূর্যাস্তের আগেই আরাফা ত্যাগ করতো। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আমাদের আদর্শ তাদের থেকে ভিন্ন।
[91] আবূ দাউদ, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন