রাসূলগণের প্রতি ঈমান

0
2988

প্রশ্ন:

রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনা বলতে কী বুঝায়?

উত্তর:

 সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। রাসূলগণের প্রতি ঈমান চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। সেগুলো হচ্ছে:-

এক. সুদৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কওমের জন্য তাদের মধ্য হতে একজনকে রাসূল (বার্তাবাহক) করে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত (উপাসনা) করার এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করার দাওয়াত দেন। সকল রাসূল সত্যবাদী, সত্যায়নকারী, পুণ্যবান, সঠিক পথের দিশারী, তাকওয়াবান ও বিশ্বস্ত। আল্লাহ তাঁদেরকে যা কিছু দিয়ে প্রেরণ করেছেন তারা তা পরিপূর্ণভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কোন অংশ গোপন করেননি বা পরিবর্তন করেননি। নিজে থেকে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করেননি। “রাসূলগণের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌছিয়ে দেয়া।” [সূরা নাহল, আয়াত: ৩৫]

এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, প্রথম রাসূল হতে শেষ রাসূল পর্যন্ত সকলের দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল একটাই- বিশ্বাস-শ্রেণীয়, বচন-শ্রেণীয় ও কর্ম-শ্রেণীয় যাবতীয় ইবাদত বা উপাসনা শুধুমাত্র এক আল্লাহর জন্য পালন করা এবং অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করা। দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই করেছি যে- নেই কোন উপাস্য আমি ব্যতীত; সুতরাং আমারই এবাদত কর।” [সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]

এবং তাঁর বাণী: “আপনার পূর্বে আমি যেসব রসূল প্রেরণ করেছি, তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত আমি কি কোন উপাস্য স্থির করেছিলাম এবাদতের জন্যে?” [সূরা যুখরূফ, আয়াত: ৪৫]

এগুলো ছাড়াও আরো অনেক আয়াতে কারীমা রয়েছে। কিন্তু অবশ্য পালনীয় আমল (ফরজ) ও আইন-কানুন এক রাসূল থেকে অন্য রাসূলেরটা ভিন্ন হতে পারে। এক রাসূলের উম্মতের উপর যে নামায-রোজা ফরজ করা হয়েছে অন্য রাসূলের উম্মতের উপরে সেসব হয়তো ফরজ করা হয়নি। এক রাসূলের উম্মতের উপরে যে বিষয়গুলো হারাম করা হয়েছে অন্য রাসূলের উম্মতের জন্য সেসব বিষয় হয়তো হালাল করা হয়েছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ। যেন আল্লাহ যাচাই করে নিতে পারেন “তোমাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম”। এর পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণী: “আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি শিরআ ও মিনহাজ (আইন ও পথ) দিয়েছি।” [সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮]

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, অর্থাৎ- পথ ও আদর্শ (দিয়েছি)। মুজাহিদ, ইকরিমাসহ মুফাসসিরদের আরো অনেকে একই রকম মত দিয়েছেন। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নবীরা হচ্ছেন- বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মত। তাদের মা আলাদা আলাদা; কিন্তু ধর্ম অভিন্ন।” অর্থাৎ সকল নবীর মূল ধর্মবিশ্বাস এক। সেটা হচ্ছে- তাওহীদ। যে তাওহীদ দিয়ে আল্লাহ তাআলা সকল রাসূলকে প্রেরণ করেছেন এবং সকল কিতাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আদেশ-নিষেধ বা হালাল-হারামের ক্ষেত্রে প্রত্যেক রাসূলের শরিয়ত (অনুশাসন) ভিন্ন ভিন্ন। কারণ বৈমাত্রেয় ভাইদের পিতা এক, কিন্তু মা ভিন্ন হয়ে থাকে।

যে ব্যক্তি কোন একজন রাসূলের রাসূলত্বকে অস্বীকার করল সে যেন সকল রাসূলকে অস্বীকার করল। “নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছে।” [সূরা শুআরা, আয়াত: ১০৫]

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, নূহের সম্প্রদায় সকল রাসূলকে অস্বীকার করেছে। অথচ তারা যে সময়ে নূহ (আলাইহিস সালাম) কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তখন পর্যন্ত নূহ আলাইহিস সালাম ছাড়া আর কোন রাসূল প্রেরিত হননি।

দুই. রাসূলদের মধ্যে যাদের নাম আমরা জানতে পেরেছি তাদের নামসমূহের প্রতি ঈমান আনা। যেমন- মুহাম্মদ, ইব্রাহিম, মূসা, ঈসা, নূহ (আলাইহিমুস সালাম)। আর যাদের নাম জানা যায়নি তাদের প্রতি এজমালিভাবে ঈমান আনা। যেমন কুরআনে এসেছে: “রসূল বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয়ের উপর যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলমানরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহের প্রতি এবং তাঁর পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর পয়গম্বরদের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” [সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮৫]

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: “আমি আপনার পূর্বে অনেক রসূল প্রেরণ করেছি, তাদের কারও কারও ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারও কারও ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করিনি।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৭৮]

আমরা আরও ঈমান রাখি যে, সর্বশেষ রাসূল হচ্ছেন- আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর পরে আর কোন নবী নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন: “মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।” [সূরা আহযাব, আয়াত: ৪০]

সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, “নবী সাল্লাল্লাম আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী (রাঃ) কে খলিফার দায়িত্বে রেখে তাবুক অভিযানে বের হন। তখন আলী (রাঃ) বলেন: আপনি কী আমাকে নারী ও শিশুদের (দুর্বলদের) দায়িত্বশীল বানালেন!! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: মূসা (আঃ) এর প্রতিনিধি হিসেবে হারুন (আঃ) যে মর্যাদা পেয়েছেন আমার প্রতিনিধি হিসেবে তুমি সে মর্যাদা পেয়ে কি সন্তুষ্ট নও!! তবে আমার পরে কোন নবী নেই।

আল্লাহ তাআলা অন্য নবীদের উপর আমাদের নবীকে বেশ কিছু বিশেষত্ব দিয়েছেন। যেমন:-

  • আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমস্ত জিন ও ইনসান এর নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। অথচ পূর্ববর্তী নবীগণ শুধু তাঁদের কওমের নিকট প্রেরিত হত।
  • একমাসের সম পরিমাণ দূরত্বে অবস্থানরত শত্রুর অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করতেন।
  • সমস্ত জমিনকে তাঁর জন্য সিজদার স্থান ও পবিত্র করা হয়েছে।
  • তাঁর জন্য গণিমতের মাল খাওয়া হালাল করা হয়েছে; অথচ তাঁর পূর্বে কারো জন্য তা হালাল ছিল না।
  • মহা শাফায়াত।

এগুলো ছাড়াও আরো অনেক বিশেষত্ব আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন।

তিন. সত্য সংবাদের ভিত্তিতে তাদের ব্যাপারে যা কিছু জানা যায় সেগুলোর প্রতি ঈমান রাখা।

চার. আমাদের নিকট যে রাসূল প্রেরিত হয়েছেন তাঁর শরিয়তের আলোকে আমল করা। তিনি হচ্ছেন সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যিনি সকল মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।” [সূরা নিসা, আয়াত: ৬৫]

জেনে রাখুন, রাসূলদের প্রতি ঈমান আনার বেশ কিছু ভাল ফলাফল রয়েছে। যেমন-

  • বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত ও গুরুত্বের বিষয়টি উপলব্ধি করা। যেহেতু বান্দাকে সরল-সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য এবং ইবাদতের পদ্ধতি বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ রাসূল পাঠিয়েছেন। এককভাবে মানব-মস্তিষ্কের পক্ষে যা উদঘাটন করা সম্ভবপর ছিল না।
  • এই নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
  • রাসূলগণকে ভালোবাসা, তাঁদেরকে সম্মান করা, যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে তাঁদের প্রশংসা করা। যেহেতু তাঁরা আল্লাহর রাসূল, তাঁরা তাঁর ইবাদত করেছেন, তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং উম্মতকে সৎ পরামর্শ দিয়েছেন।

(দেখুন আলামুস সুন্নাহ আল-মানশুরা, পৃষ্ঠা ৯৭-১০২ ও শারহুল উসুল আস্‌ ছালাসা, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৬)

শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন