রমজান মাসের বৈশিষ্ট্যসমূহ

0
2242

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

 রমজান: আরবি বার মাসের একটি মাস। এ মাসটি ইসলাম ধর্মে সম্মানিত। অন্য মাসগুলোর তুলনায় এ মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রয়েছে। যেমন :

১. আল্লাহ তাআলা এ মাসে রোজা পালন করাকে ইসলামের চতুর্থ রুকন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “রমজান মাস এমন মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে;  মানবজাতির জন্য হিদায়েতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে সে যেন রোজা পালন করে।” [২ সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫]

সহীহ বুখারী (৮) ও সহীহ মুসলিম (১৬)-এ ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি খুঁটির উপর নির্মিত। (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (২) সালাত কায়েম (প্রতিষ্ঠা) করা (৩) যাকাত প্রদান করা (৪) রমজান মাসে রোজা পালন করা এবং (৫) বায়তুল্লাহ শরিফের হজ্জ আদায় করা”।

২. আল্লাহ তাআলা এই মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। যেমনটি তিনি ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতে বলেছেন: “রমজান মাস এমন মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে;  মানবজাতির জন্য হিদায়েতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।” [২ সূরা আল-বাক্বারা: ১৮৫]

তিনি আরও বলেছেন:  “নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআনকে) লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি।” [৯৭ সূরা আল-ক্বাদ্‌র:১]

. আল্লাহ তাআলা এ মাসে লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য রজনী রেখেছেন। যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “১. নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। ২. আপনি কি জানেন- লাইলাতুল কদর কি? ৩. লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ৪. এই রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ  (জিবরীল আলাইহিস সালাম) তাঁদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। ৫. ফজরের সূচনা পর্যন্ত শান্তিময়।” [৯৭ আল-কাদর : ১-৫]

তিনি আরও বলেছেন: “নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) এক মুবারকময় (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।” [৪৪ আদ-দুখান: ৩]

আল্লাহ তা‘আলা রমজান মাসকে লাইলাতুল কদর দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আর এই বরকতময় রাতের মর্যাদা বর্ণনায় সূরাতুল কদর নাযিল করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয়েছে। এক বরকতময় মাস। আল্লাহ তোমাদের উপর এ মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে অবাধ্য শয়তানদের শেকলবদ্ধ করা হয়। এ মাসে আল্লাহ এমন একটি রাত রেখেছেন যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হল সে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন নাসা’ঈ (২১০৬) ও ইমাম আহমাদ (৮৭৬৯) এবং শাইখ আলবানী ‘সহীহুত তা্রগীব’ (৯৯৯) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]

আর আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় লাইলাতুল ক্দর বা ভাগ্য রজনীতে নামাজ আদায় করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ  মাফ করে দেয়া হবে।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (১৯১০) ও মুসলিম (৭৬০)]

৪. আল্লাহ তাআলা এই মাসে ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় সিয়াম ও ক্বিয়াম পালন (রোজা ও নামাজ আদায়) করাকে গুনাহ মাফের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমনটি সহীহ বুখারী (২০১৪) ও সহীহ মুসলিম (৭৬০) -এ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় রোজা পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” এবং সহীহ বুখারী (২০০৮) ও সহীহ মুসলিম (১৭৪)-এ আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় নামায আদায় করবে তার অতীতের সব গুনাহ  মাফ করে দেয়া হবে।

মুসলিমগণ এ ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) করেছেন যে, রমজান মাসে রাতের বেলা ক্বিয়াম পালন (নামায আদায় করা) সুন্নত। ইমাম নববী উল্লেখ করেছেন: “রমজান মাসে ক্বিয়াম করার অর্থ হল তারাবীর নামায আদায় করা। অর্থাৎ তারাবীর নামায আদায়ের মাধ্যমে ক্বিয়াম করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়।”

৫. আল্লাহ তাআলা এই মাসে জান্নাতগুলোর দরজা খোলা রাখেন, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ রাখেন এবং শয়তানদেরকে শেকলবদ্ধ করেন। যেমনটি দুই সহীহ গ্রন্থ সহীহ বুখারী (১৮৯৮) ও সহীহ মুসলিম (১০৭৯)-এ আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস হতে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যখন রমজান আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শেকলবদ্ধ করা হয়।

৬. এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে তাঁর বান্দাদের মুক্ত করেন। ইমাম আহমাদ (৫/২৫৬) আবু উমামাহ -এর হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি  ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “প্রতিদিন ইফতারের সময় আল্লাহ কিছু বান্দাকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করেন।”  আল-মুনযিরী বলেছেন হাদিসটির সনদে কোন সমস্যা নেই। আলবানী ‘সহীহুত তারগীব’ (৯৮৭) – গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।

বাযযার (কাশফ ৯৬২) আবু সা’ঈদের হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে প্রতি দিনে ও রাতে কিছু বান্দাকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন। আর নিশ্চয় একজন মুসলিমের প্রতি দিনে ও রাতে কবুল যোগ্য দুআ’ রয়েছে।”

৭. রমজান মাসে সিয়াম পালন পূর্ববর্তী রমজান থেকে কৃত গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়; যদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। যেমনটি প্রমাণিত হয়েছে ‘সহীহ মুসলিম’ (২৩৩)-এ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে অপর জুমা, এক রমজান থেকে অপর রমজান এদের মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের জন্য কাফফারা হয়ে যায়; যদি কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়।

৮. এই মাসে সিয়াম পালন বছরের দশমাস সিয়াম পালন তুল্য। সহীহ মুসলিম (১১৬৪)-এ আবু আইয়ূব আনসারীর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল, এরপর শাওয়াল মাসেও ছয়দিন রোজা রাখল সে যেন সারা বছর রোজা পালন করল।

ইমাম আহমাদ (২১৯০৬) বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল- রমজানের একমাস রোজা দশমাস রোজা রাখার সমতুল্য। আর ঈদুল ফিত্বরের পর (শাওয়াল মাসের) ছয় দিন রোজা রাখলে যেন গোটা বছরের রোজা হয়ে গেল।

৯. এই মাসে যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম যতক্ষণ নামায পড়েন ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল (তারাবী নামায) আদায় করবে সে ব্যক্তি সারা রাত নামায পড়ার সওয়াব পাবে। দলিল হচ্ছে- আবু দাউদ (১৩৭০) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণনা করেন তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে কিয়াম করবে তার জন্য সারারাত কিয়াম করার সওয়াব লেখা হবে।” আলবানী ‘সালাতুত তারাবী’ গ্রন্থ (পৃঃ ১৫) –এ হাদিসকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।

১০. এই মাসে উমরা আদায় করা হজ্জ করার সমতুল্য। ইমাম বুখারী (১৭৮২) ও মুসলিম (১২৫৬) ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন: “কিসে আপনাকে আমাদের সাথে হজ্জ করতে বাধা দিল?” মহিলা বললেন: “আমাদের পানি বহনকারী শুধু দুটো উট ছিল।” তাঁর স্বামী ও পুত্র একটি পানি বহনকারী উটে চড়ে হজ্জে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন: “আর আমাদের পানি বহনের জন্য একটি পানি বহনকারী উট রেখে গিয়েছেন।” তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “তাহলে রমজান এলে আপনি উমরা আদায় করুন। কারণ এ মাসে উমরা করা হজ্জ করার সমতুল্য।

সহীহ মুসলিমের রেওয়ায়েতে আছে: “……আমার সাথে হজ্জ করার সমতুল্য।”

১১.এ মাসে ইতিকাফ করা সুন্নত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে ইতিকাফ করেছেন। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করেছেন।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (১৯২২) ও মুসলিম (১১৭২)]

১২. রমজান মাসে পারস্পারিক কুরআন তেলাওয়াত ও ব্যক্তিগতভাবে বেশি বেশি তেলাওয়াত করা তাগিদপূর্ণ মুস্তাহাব্ব। মুদারাসা বা পারস্পারিক তেলাওয়াত বলতে বুঝায় একজন তেলাওয়াত করা অন্যজন সেটা শুনা। আবার দ্বিতীয়জন তেলাওয়াত করা এবং প্রথমজন সেটা শুনা। এই পারস্পারিক তেলাওয়াত মুস্তাহাব্ব হওয়ার দলীল হলো: “জিবরাইল (আঃ) রমজান মাসে প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং পরস্পর কুরআন তেলাওয়াত করতেন।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (৬) ও মুসলিম (২৩০৮)]

যে কোন সময় কুরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব। আর রমজানে এটি আরো বেশি তাগিদপূর্ণ মুস্তাহাব।

১৩. রমজান মাসে রোজাদারকে ইফতার খাওয়ানো মুস্তাহাব্ব। এর দলীল হচ্ছে- যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ব্যক্তি রোজাদারের সমতুল্য সওয়াব পাবে। কিন্তু সেই রোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি করা হবে না।” [হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী (৮০৭) ও ইবনে মাজাহ (১৭৪৬)। শাইখ আলবানী ‘সহীহুত তিরমিযী’(৬৪৭) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন