ইলম অর্জনে শিশুর অধিকার

2
1898

127

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

ইলম অর্জন, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ, ইহপরকালীন কল্যাণের পথ পথান্তর বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা অর্জন শিশুর একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রদানে, এ বিষয়ে শিশুর যথাযথ পরিচর্যায় মহানবী সা. স্থাপন করেছেন সর্বোচ্চ আদর্শ। আমাদের সালাফে সালেহীনগণও এক্ষেত্রে রেখেছেন উজ্জ্বল উদাহরণ।

মহানবী সা. জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন।‘ [ দ্রঃ: আল মাকাসিদুল হাসানা: ৬৬০] জ্ঞান অন্বেষণ সর্বোত্তম ইবাদত। আর এ ইবাদত চর্চার জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া শুভ শুরু শিশুকাল থেকেই শুরু হয়, শুরু হওয়া আবশ্যক; কেননা শিশুকালে লব্ধ জ্ঞান পাথরে খচিত রেখার মতোই, যা কখনো মুছে যাবার নয়।

আবু হুরায়রা (রা:) হতে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি শিশুকালে কুরআন শিখল, কুরআন তার রক্তমাংসের সাথে মিশে গেল, আর যে ব্যক্তি বৃদ্ধ বয়সে কুরআন শিখল, আর কুরাআন তার কাছ থেকে ছুটে যাওয়া সত্ত্বেও সে লেগে রইল, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ ছোয়াব।” [দায়লামি, হাকেম]

ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন :’যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্বেই কুরআন শিখল তাকে প্রজ্ঞা দিয়ে ভূষিত করা হল। ‘খতিব আল বাগদাদি ইলম শেখানোর ব্যাপারে সালাফে সালেহীনদের উদ্যোগ-আগ্রহের একটি দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন যার কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল: হাসান বলেছেন:’ আমাদের হাতে আপনাদের শিশুদের তুলে দিন, কেননা তারা হল শূন্য হৃদয়, তারা যা শোনে তা সংরক্ষণ করে রাখতে অধিক সক্ষম। সাঈদ ইবনে রাহমা আল আসবাহি বলেন: আমি রাতে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের মজলিসে সবার আগে যেতাম, আমার সঙ্গী-সাথী ছিল যারা কখনো আমার পূর্বে যেতে পারত না। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বৃদ্ধদের সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করতেন। তারা একবার আব্দুল্লাহ ইবুল মুবারককে বললেন: এসব বাচ্চারা আমাদেরকে পরাহত করে দিয়েছে। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন: আপনাদের তুলনায় এরাই আমার অধিক আশার পাত্র। আপনারা আর কয়দিন বাঁচবেন, আর ওরা, আশা করা যায় যে আল্লাহ তাদেরকে দীর্ঘ জীবন দেবেন। সাঈদ বলেন: তাদের মধ্যে আমাকে ছাড়া আর কেউই আজ বেঁচে নেই।‘

ইমাম আ’মাশ বলেন: আমি ইসমাঈল ইবনে রাজাকে দেখেছি, তিনি বাচ্চাদের মকতবে যেতেন, তাদের সাথে কথা বলতেন; যাতে তার কথাগুলো বিস্রুত না হয়।‘ হাসান ইবনে আলী রা. তাঁর ও তাঁর বোনের ছেলেদেরকে বলতেন: ইলম শেখ; কেননা কওমের মধ্যে তোমরা এখন ছোট, আর আগামীকাল তোমরাই হবে বড়। তাই তোমাদের মধ্যে যে মুখস্থ না করে সে যেন লিখে সংরক্ষণ করে।‘ [খতিব আল বগদাদি: আল কিফায়া ফি ইলমির রেওয়ায়া]

আতা ইবনে আবি রাবাহ বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে বলতেন: তোমরা লেখ, আর যে ভাল করে লেখা জানে না তাকে আমরা লিখে দেব, আর যার সাথে খাতা-কলম নেই, তাকে আমরা এগুলো আমাদের কাছ থেকে দেব। [আল মুহাদ্দিসুল ফাযেল: পৃষ্ঠা ৩]

বদিউযযামান হামাদানি তার এক বোনপুত্রকে ইলম তলবে সিরিয়াস হতে বলে চিঠি লিখে বলেন:’ যতদিন ইলম নিয়ে মশগুল থাকবে, মাদ্রাসাকে তোমার থাকার জায়গা বানিয়ে রাখবে, কলমকে সঙ্গী ও খাতাকে বন্ধু বানিয়ে রাখবে ততদিন তুমি আমার সন্তান বলে স্বীকৃতি পাবে। আর যদি এ ব্যাপারে কোনো ত্রুটি হয় তবে আমি তোমার মামা নই, অন্য কাউকে মামা হিসেবে গ্রহণ করো। ওয়াসসালাম। [ আলহিদায়া আল ইসলামিয়া: ২২৮]

লুকমান হাকিম একদা তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন:’ তোমার প্রজ্ঞা অর্জন কতদূর হল? উত্তরে তিনি বললেন: আমার জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি তাতে মাথা ঘামাই না।‘ লুকমান হাকিম বললেন: হে আমার ছেলে! আরেকটি বিষয় বাকি রয়ে গেছে, আর তাহল, তুমি আলেমদের সাথে বসবে, ভিড় ঠেলে হলেও তাদের কাছে যাবে। কেননা আল্লাহ তাআলা হেকমত দ্বারা মৃত হৃদয়গুলোকে জীবিত করেন, যেমনি জীবিত করেন বৃষ্টি বর্ষিয়ে মৃত জমিন। [ মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক: ২/১৬১] তিনি আরো বলেন: হে আমার সন্তান! তুমি তিনটি উদ্দেশ্যে ইলম তলব করো না। আর তিন কারণে ইলম তলব বন্ধ করো না –

() অযাচিত ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ার জন্য ইলম তলব করো না, () গর্ব করার উদ্দেশ্যে ইলম তলব করো না, () লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে ইলম তলব করো না।

() ইলম তলবে অনীহার কারণে ইলম তলব ছেড়ো না, () লোকলজ্জায় তুমি ইলম তলব ছেড়ো না, () অজ্ঞ থাকার প্রতি রাজি হয়ে তুমি ইলম তলব ছেড়ো না।

তিনি আরো বলেন:’ আলেমদের সাথে তুমি ঝগড়া করতে যেও না, এরূপ করলে তাদের কাছে তুমি হালকা হয়ে যাবে। তারা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন। যারা নির্বোধ তাদের সাথেও বিতণ্ডায় যেও না, কেননা এরূপ করলে তারা তোমার সাথে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করবে, তোমাকে গালি দেবে। তুমি বরং সবর করবে, জ্ঞানে যে ব্যক্তি তোমার ঊর্ধ্বে তার জন্য, এবং যে নিচে তার জন্যও, কারণ আলেমদের সারিতে গিয়ে তারাই যুক্ত হতে পারে যারা তাদের জন্য ধৈর্য ধরবে, তাদের সাথে লেগে থাকবে। সুন্দর ও বিনম্রভাবে তাদের ইলম থেকে আহরণ করবে।‘

আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান তার ছেলেদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন: তোমরা ইলম শিক্ষা করো, ইলম শিক্ষা করলে তোমরা যদি মধ্যবর্তী অবস্থানে থাক, তাহলে তোমরা নেতা হয়ে যাবে, আর যদি নিম্নবর্তী অবস্থানে থাক তা হলে বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে।

উপরোল্লিখ উদ্ধৃতিগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান হচ্ছে আমাদের সালাফে সালেহীন শিশুসন্তানদেরকে ইলম শেখাতে কতটুকু গুরুত্ব দিতেন, আগ্রহ-উৎসাহ বহন করতেন।

সালাফে সালেহীনদের পদাঙ্ক অনুসরণ আমাদের ছেলে সন্তানদেরকে যথার্থরূপে ইলম, জ্ঞান, ও প্রজ্ঞা শেখাতে আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

2 COMMENTS

আপনার মন্তব্য লিখুন