যে কোন ‘আলেম, নেতা বা মুরুব্বীর আনুগত্যই “শর্ত সাপেক্ষ”

1
1492
135লিখেছেন: মেরিনার

বেশ আগে হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত একজন ইহুদী সাংবাদিকের লেখা একটা বই পড়েছিলাম। বইটির নাম: A heart turned East । ঐ সাংবাদিক,  Adam Lebor যখন যুদ্ধরত বসনিয়ায় কর্মরত ছিলেন, সেই অবস্থায় মুসলিমদের সম্বন্ধে তার মনে খুব আগ্রহ জন্মে। তারই সূত্র ধরে মুসলিমদের সাধুবাদ জানিয়ে তার ঐ বই লেখা। তিনি মুসলিমদের যে সমস্ত ব্যাপারে খুব impressed হয়েছিলেন তার একটি ছিল – তারা যে ভাবে জামাতবদ্ধভাবে একত্রে আল্লাহর সামনে হাটু গেড়ে বসে ও সিজদায় যায় (অর্থাৎ আমাদের সালাত, তাকে খুব অবাক ও impressed করেছিল) ! এর বহুদিন পরে আমি চিন্তা করেছিলাম যে, আল্লাহর আদেশে মুসলিমরা তাদের ইমামের কি সাংঘাতিক রকমের আনুগত্যই না করে!! বাইরে থেকে যদি, মুসলিম নয় এমন একজন লোক  ১০, ১৫ বা ২০ লক্ষ লোকের একটা জামাত দেখে – যেমনটা মক্কার মসজিদুল হারামে হজ্জ বা তারাবীর সময় দেখা যায় – তবে তার অবাক হবারই কথা। একজন মানুষের command-এ কিভাবে এতগুলো লোক রুকুতে বা সিজদায় যাচ্ছে – বুঝিবা তাদের নিজস্ব কোন সত্তাই নেই! কিন্তু এই আনুগত্য কি unconditional বা নিঃশর্ত ? মোটেই নয়!

ধরুন কোন ইমাম যদি ক্বিরাত পড়তে গিয়ে সূরা ফাতিহার জায়গায় “মমতাজের মরমী গান” গেয়ে ওঠেন, তা হলে কি হবে ? হয়তো ২/১ বার “লোকমা” দেয়া হবে – তারপরও তিনি ক্ষান্ত না হলে, তাকে পাগল বলে গণ্য করা হবে এবং তিনি ইমামতী করার যোগ্যতা হারাবেন! সম্ভবত তাকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হবে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, আপাতঃদৃষ্টিতে প্রশ্নাতীত মনে হওয়া ঐ সাংঘাতিক আনুগত্যও আসলে conditional বা contingent – আনুগত্য ততক্ষণ, যতক্ষণ তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) আদেশ-নিষেধের আওতার মাঝে থাকছে। এই ধারণাটাকেই শরীয়াহর একটা সাধারণ মূলনীতি হিসেবে এভাবে বলা হয়ে থাকে যে, There is NO obedience, when it comes to disobedience to Allah! সোজা কথায় রাজা-বাদশাহ্, বাবা-মা, স্বামী বা ইমাম – যে কারো প্রতি অনুগত থাকতে গিয়ে আল্লাহর অবাধ্য হওয়া যাবে না। এই একটা মূলনীতি মানলেই আমরা কোন ‘আলেম, হুজুর, পীর, বুজূর্গ বা নেতার অন্ধ অনুকরণ করতে পাতাম না বরং প্রতিনিয়ত check করে দেখতাম যে, ঐ কথিত ‘আলেম, হুজুর, পীর, বুজূর্গ বা নেতার কর্মকান্ড আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের(সা.) আদেশ-নিষেধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না!

এই মূলনীতি বুঝতে আমাদের জন্য একটি আয়াতই যথেষ্ট ছিল – অথচ অনেকেই এই আয়াতটির ঠিক উল্টা প্রয়োগ করে উল্টা কথাটাই বুঝে থাকেন। আয়াতটি হচ্ছে সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত: “হে মু’মিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর, তবে আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী। কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে, তা আল্লাহ ও রাসূলের কাছে উপস্থিত কর । এটাই শ্রেয় এবং পরিণাম এটাই প্রকৃষ্টতর ।”[সূরা নিসা ,৪:৫৯]

 

“উলীল আমর” বা যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী । এই আয়াতে তাদের আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে – কিন্তু আয়তের বাকী অংশ বা পটভূমির উপর চিন্তা-ভাবনা না করে, এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেই অনেকে পীর, বুজুর্গ, আমিরের অন্ধ অনুকলনকে সঠিক সাব্যস্ত করে থাকেন।

আয়াত সংক্রান্ত আলোচনায় যাবার আগে চলুন ঐ আয়াতের শানে নুযুল বা আসবাবুল নুযুল সম্বন্ধে একটু জেনে নিই:

একদল সাহাবী এক “উলীল আমর”-এর অনুসরণ/আনুগত্য বর্জন করেছিলেন। তাদের ঐ বর্জনকে সঠিক প্রমাণের জন্য এই আয়াত নাযিল হয়। তার কারণ উক্ত “উলীল আমর” বা দায়িত্বশীলের নির্দেশ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(সা.) বিপরীত ছিল। তফসীর ইবন কাসীরে ঘটনাটা এসেছে এভাবে:

Al-Bukhari recorded that Ibn `Abbas said that the Ayah,

(Obey Allah and obey the Messenger, and those of you who are in authority.) “Was revealed about Abdullah bin Hudhafah bin Qays binAdi, who the Messenger of Allah sent on a military expedition.” This statement was collected by the Group, with the exception of Ibn Majah At-Tirmidhi said, “Hasan, Gharib”. Imam Ahmad recorded that Ali said, “The Messenger of Allah sent a troop under the command of a man from Al-Ansar. When they left, he became angry with them for some reason and said to them,Has not the Messenger of Allah commanded you to obey me’ They said, Yes.’ He said,Collect some wood,’ and then he started a fire with the wood, saying, I command you to enter the fire.’ The people almost entered the fire, but a young man among them said,You only ran away from the Fire to Allah’s Messenger. Therefore, do not rush until you go back to Allah’s Messenger, and if he commands you to enter it, then enter it.’ When they went back to Allah’s Messenger , they told him what had happened, and the Messenger said,

(Had you entered it, you would never have departed from it. Obedience is only in righteousness.)” This Hadith is recorded in the Two Sahihs.(বুখারী ও মুসলিম)

কুর’আনের এই একটি আয়াত থেকে অনেক গুরুত্বর্পূণ বিষয় বেরিয়ে আসে । আমাদের “হাওয়া” বা desire বর্জন করে আমরা যদি এই একটি আয়াত কি বলতে চায় তা বুঝতে চাইতাম, তবে হয়তো আল্লাহর রহমতে আমরা অনেক ফিতনা থেকে মুক্তি পেতাম। চলুন এই আয়াতের মর্মার্থ আমরা একজন স্কলারের কাছ থেকে শুনি:

প্রথমত

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে আল্লাহ এখানে “আনুগত্য কর” বলে একটা স্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন । শুধু তাঁর ব্যাপারে নয় বরং রাসূল (সা.)-এঁর ব্যাপারেও – বলেছেন:

“আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর” (”কিন্তু যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী” এই অংশের পূর্বে ঐ একই ক্রিয়াপদ [আতিউ] বা আদেশ সরাসরি সংযুক্ত হয়নি । এর ফলে রাসূল (সা.) কে আনুগত্যের এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে অথচ, অন্য যে করো প্রতি আনুগত্যের সাথে কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে ।

দ্বিতীয়ত

এর নিহিতার্থ হচ্ছে এই যে, এক ভাবে চিন্তা করলে রাসূল (সা.)-এঁর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে ভিন্ন কিছূ। এটা সত্যি যে আল্লাহর রাসূলের (সা.) প্রতি আনুগত্য আল্লাহরই প্রতি আনুগত্য। কিন্তু এখানে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে এরকম যে, আল্লাহর কথা বা কুর’আন থেকে তিনি যা উপস্থাপন করেছেন, কেবল সে সব ব্যাপারেই রাসূল (সা.)-কে মেনে চলার চেয়ে এই আনুগত্য ভিন্ন কিছু । (কেউ কেউ যেমনটা দাবী করে থাকেন যে, রাসূলকে মানা কথাটার অর্থ হচ্ছে, কুর’আনের অংশ হিসাবে তিনি আল্লাহর যেসব কথা আমাদের জানিয়ে গেছেন শুধু সেসব মেনে চলা – এখানে সেসব বাকবিতন্ডার দ্বার চিরতরে রূদ্ধ করে দেয়া হয়েছে)।

তৃতীয়ত

যে কোন ব্যাপারে বিতর্ক দেখা দিলে মুসলিমদের সেটাকে কেবলমাত্র দুটি কর্তৃত্বের উৎসের কাছে নিয়ে যেতে আদেশ করা হয়েছে – যেগুলো হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)

সাহাবীগণ এবং তাদের পরবর্তী স্কলারগণ “আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া” বলতে ” আল্লাহর কিতাবের কাছে নিয়ে যাওয়া” বুঝেছেন । আর, “আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে নিয়ে যাওয়া” বলতে তাঁর জীবদ্দশায় সরাসরি তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া এবং তাঁর জীবনাবসানের পর তাঁর “সুন্নাহর কাছে নিয়ে যাওয়া” বুঝানো হয়েছে । এখানে আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের (সা.) সুন্নাহকে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই আয়াতে এমন কথা বলা হয়নি যে, “ব্যাপারটা আল্লাহর কাছে উপস্থিত কর এবং সেখানে যদি কোন উত্তর না পাও, তবে তা আল্লাহর রাসূলের কাছে উপস্থিত কর”।

চতুর্থত

আল্লাহ বলেন যে, সত্যিকার বিশ্বাসী হচ্ছে তারা, যারা তাদের বিতর্ক বা মতপার্থক্যকে কেবল আল্লাহর কাছে উপস্থিত করেন না বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) কাছে উপস্থিত করেন।

পঞ্চমত

একজন বিশ্বাসী জানে যে গুরুত্বর্পূণ জীবন হচ্ছে আখিরাতের জীবন। তাই যখন সে আল্লাহর মুখোমুখি দাঁড়াবে সেই সময়ের জন্য এটাই শ্রেয় যে, একজন বিশ্বাসী যে কোন ঝগড়া মীমাংসার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল উভয়ের কাছে নিয়ে যাবে এবং সে রাসূলের (সা.) সুন্নাহর মর্যাদা অস্বীকার করে না।

ষষ্ঠত

যে কারো উপলদ্ধি করা উচিত যে, এই আয়াতে সকল প্রকারের মতবিরোধ বা ঝগড়াঝাটির কথা বোঝানো হয়েছে – তা ইবাদতের নিয়মাবলীর ব্যাপারে হোক, বা ব্যবসার ব্যাপারে হোক বা অন্যান্য পার্থিব বিষয়েই হোক। কোন কোন স্কলার বলে থাকেন যে, এই আয়াত রাসূল (সা.)-এঁর কোন কোন সহচরের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। নবীর (সা.) সময়কালের পূর্বে সরকারী কর্তৃত্বের ব্যাপারে আরবদের সত্যিকার কোন ধারণা ছিল না। আর সেজন্য তা থেকে ঝগড়াঝাঁটির উৎপত্তি হতো – সে প্রসঙ্গেই আল্লাহ বলেছেন যে, বির্তকিত বিষয়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে উপস্থিত করাই হচ্ছে এর সমাধান।

“কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে” এই বাক্যাংশ সম্বন্ধে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে ইবনুল কাইয়্যিম বলেন যে, এই আরবী বাকাংশ অনির্দিষ্টতাসূচক “কোন বিষয়” শব্দ দু’টি, একটি শর্ত হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে ব্যাপাটো সাধারণভাবে সকল বিষয়ে প্রযোজ্য বলে বোঝা যায় । অন্য কথায় বলতে গেলে ছোট অথবা বড় – তাদের দ্বীন সংক্রান্ত এমন যে বিষয়েই মুসলিমরা মতবিরোধ পোষন করবে, তার সবকিছুকেই বোঝানো হচ্ছে [বা যে কোন কিছুকেই বোঝানো হচ্ছে]।

তারা সেই বিষয়টিকেই আল্লাহর কিতাব ও সুন্নার কাছে নিয়ে যাবে। এর নিহিতার্থ হচ্ছে, ঐ বিষয়ে – যে কোন বিষয়ে – সমাধান অবশ্যই কুর’আন ও সুন্নাহর মাঝে খুঁজে পেতে হবে । এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার যে, আল্লাহ মুসলিমদের সকল বিষয়ের সমাধানের জন্য এই দুটি উৎসের কাছে যেতে বলেছেন, অথচ সেসবের মাঝে তাদের মত বিরোধ সমাধান পাওয়া যাবে না ।

সবশেষে ইবনুল কাইয়্যিম এ ব্যাপারটা দিকে ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেন , “আল্লাহ ও রাসূলের কাছে উপস্থিত কর” – কিন্তু “আল্লাহর কাছে এবং তাঁর রাসূলের কাছে উপস্থিত কর”, এভাবে তিনি কথাটা বলেন নি (অন্য কথায় “কাছে” কথাটা কেবল একবারই ব্যবহৃত হয়েছে)।

তিনি বলেন যে, বাক্যটা এভাবে গঠন করা হয়েছে কেননা আল্লাহর যে সিন্ধান্ত, তাঁর রাসূলের(সা.) সিন্ধান্ত ঠিক তাই । আর আল্লাহর রাসূল (সা.) যে সিন্ধান্ত নেন, তাই হচ্ছে আল্লাহর সিন্ধান্ত । সুতরাং, কোন একটা বিষয়ে মতবিরোধ পোষণ করলে, মুসলিমরা যখন তা সমাধান করার জন্য আল্লাহর (কিতাবের ) কাছে নিয়ে যায়, তখন তারা কার্যত তা তাঁর রাসূলের কাছেই নিয়ে যাচ্ছে – আবার যখন তারা কোন বিষয়কে রাসূলের (সা.) কাছে উপস্থিত করে , তখন তারা আসলে সেটাকে আল্লাহর কাছেই উপস্থিত করল । পবিত্র কুরআনে যে কেউ, যে সমস্ত সূক্ষ্ম ও সুচারু অভিব্যক্তি দেখতে পায় – এটা সেগুলোরই একটি । 
[Page#40~42, The Authority and Importance of Sunnah – Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]

“And do not follow (blindly) any information of which you have no (direct) knowledge. (Using your faculties of perception and conception, you must verify it for yourself. (In the Court of your Lord, ) you will be held accountable for your hearing, sight, and the faculty of reasoning.” [17:36]

 

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন