হালাল উপার্জন

10
4109

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মো. যাকারিয়া

ভূমিকা:

রিযক অর্থাৎ পার্থিব সহায় সম্বল ও সচ্ছলতা এ জগতের এক অপরিহার্য বস্তু ও বিষয়। এ রিযক ব্যতীত পার্থিব জীবন অচল, অস্পূর্ণ বরং অসম্ভব। কম বেশী সবারই রিযক প্রয়োজন। সবাই এ রিযক অন্বেষণ করে। কেউ বৈধ পন্থায় কেউ বৈধ-অবৈধ উভয় পন্থায়ই রিযকের পিছনে দৌড়ে। জীবনের জন্যই রিযক, কিন্তু এই রিযকের জন্য অনেকের জীবন পর্যন্ত চলে যায়। সবার রিযক সমান নয়, সবাই সমান রিযক উপার্জন করতে পারে না। আল্লাহর হিকমতের দাবিও তাই, কারণ সবার রিযক যদি সমান হয়, সবাই যদি সমান অর্থ-সম্পদের মালিক হয়, তাহলে দুনিয়ার আবাদ ও বিশ্ব পরিচালনা ব্যাহত বরং ভঙ্গুর ও স্থবির হয়ে পড়বে। তাই এর বণ্টন আল্লাহ নিজ দায়িত্বে রেখেছেন, তিনি নিজ হিকমত ও প্রজ্ঞানুযায়ী সবার মাঝে তা বণ্টন করেন। এটা কোন সম্মান বা মর্যাদার মাপকাঠি নয়, আবার হতভাগা বা অশুভ লক্ষণের আলামতও নয়। কী অনুগত কী অবাধ্য, কী মুমিন কী কাফের সকলকেই জোয়ার-ভাঁটার ন্যায় প্রাচুর্য ও অভাব, সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা স্পর্শ করে। এর মাধ্যমে আল্লাহ অবাধ্য ও কাফেরকে অবকাশ দেন, অনুগত ও মুমিনের পরীক্ষা নেন। প্রাচুর্য ও সচ্ছলতার সময় একজন মুমিন যাকাত-সাদকা প্রদান করে আল্লাহ শোকর আদায় করবে, অভাব ও অসচ্ছলতার সময় ঈমান ও ধৈর্যের পরিচয় দেবে। অভাব বা প্রাচুর্য উভয় মুমিনের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলজনক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মুমিনের বিষয়টি আশ্চর্য জনক, তার প্রত্যেকটি বিষয় কল্যাণকর, এটা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো ভাগ্যে নেই, যদি তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, আল্লাহর শোকর আদায় করে, এটা তার জন্য কল্যাণকর, আর যদি তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, ধৈর্য ধারণ করে, এটাও তার জন্য কল্যাণকর।‘ [মুসলিম: ৫৩২২]

অতএব একজন মুমিনের উচিত অভাব-অসচ্ছলতার সময় আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নেয়া, তার উপর তাওয়াক্কুল করা এবং সর্বাবস্থায় তার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। দোয়া ও আনুগত্যসহ তার দিকেই মনোনিবেশ করা। বৈধ ও হালাল পন্থায় রিযক অন্বেষণের আসবাব গ্রহণ করা এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস পোষণ করা। কারণ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তার নিআমত ভোগ করা সম্ভব নয়। অভাবের সময় অনেকে অধৈর্য ও ভেঙ্গে পড়ে, নানা অভিযোগ উত্থাপন করে, কখনো আল্লাহ সম্পর্কে আবার কখনো নিজের সম্পর্কে অযাচিত কথা মুখ থেকে বের করে, তার উপর আল্লাহর অন্যান্য নিআমত ভুলে যায়, যা আদৌ কোন মুমিনের জন্য উচিত নয়। অত্র নিবন্ধে আমি বৈধ পন্থায় রিযক উপার্জনে উদ্বুদ্ধ, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও অভাবের সময় ধৈর্য ধারণের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব।

রিযক হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়:

রিযকের বৃদ্ধি-হ্রাস আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। প্রত্যেকের রিযক আল্লাহর কুদরত ও ফয়সালা দ্বারাই নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর প্রতিটি বস্তুরই ভাণ্ডারসমূহ রয়েছে আমার কাছে এবং আমি তা অবতীর্ণ করি কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণে।’ [সূরা হিজর: ২১]

তিনি আরো বলেন: ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করে দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।‘ [সূরা আনকাবুত: ৬২]

তিনি আরো বলেন: ‘তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক প্রশস্ত করে দেন আর সঙ্কুচিত করে দেন? নিশ্চয় এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।‘ [সূরা যুমার: ৫২]

তাওবা করা:

পার্থিব ধন-দৌলত আল্লাহর এক মহান নিআমত, এ নিআমত নাফরমানি করে অর্জন করা যায় না। কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত পাপ সকল অনিষ্টের মূল। এ কারণেই মানুষ নানা ধরণের মুসিবতে পতিত হয়, যদি সে তাওবা না করে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি মা করে দেন।‘ [সূরা শুরা: ৩০]

অন্যত্র তিনি বলেন: ‘আর অবশ্যই আমি তাদেরকে গুরুতর আযাবের পূর্বে লঘু আযাব আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।‘ [সূরা সাজদাহ: ২১]

প্রত্যেক মুমিনের উচিত সর্বদা তাওবা করা এবং বেশী বেশী নেক আমল করা ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য তলব করা। কারণ গুনাই সবচেয়ে বড় সমস্যা, সবচেয়ে বড় মুসিবত। বান্দা যখন তাওবা করে, আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন এবং তাকে নিশ্চিত সফলতা দান করেন। তিনি বলেন: ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।‘ [সূরা নুর: ৩১]

তিনি অন্যত্র বলেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।‘ [সূরা বাকারা: ২২২]

আর আল্লাহ যাকে ভালবাসেন, তিনি তার মনোবাসনা পুরো করেন এবং ভয় থেকে তাকে তিনি নিরাপত্তা দান করেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন : আমার বান্দার সাথে যে বিদ্বেষ পোষণ করে, আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেই। আমি আমার বান্দার উপর যা কিছু ফরজ করেছি, তা ব্যতীত অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে সে আমার অধিক নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, এক সময় আমি তাকে মহব্বত করি। আমি যখন তাকে মহব্বত করি, তখন আমি তার কার্ণে পরিণত হই, যে কান দিয়ে সে শোনে, আমি তার চোখে পরিণত হই, যে চোখ দিয়ে সে দেখে, আমি তার হাতে পরিণত হই, যে হাত দিয়ে সে ধরে, আমি তার পায়ে পরিণত হই, যে পা দিয়ে সে চলে, সে যদি আমার কাছে প্রার্থনা করে, আমি তাকে দান করি, আর সে যদি আমার কাছে পানাহ চায়, আমি তাকে পানাহ দেই।‘ [বুখারি]

পাপ ও আল্লাহর অবাধ্যতা মানুষকে রিযক থেকে বঞ্চিত করে দেয়, যেমন মুসনাদ ও অন্যান্য গ্রন্থে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: বান্দা তার কৃত পাপের কারণে রিযক থেকে মাহরুম হয়।

সুদ ত্যাগ করা:

সুদ হারাম, সুদি কারবার হারাম, এতে লিপ্ত ব্যক্তি নিজের উপর অভিসম্পাতের দ্বার উম্মুক্ত করল। অচিরে নিঃশেষ করে দেয়া হবে তার সুদের প্রবৃদ্ধি ও বরকত । সে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার উপর আল্লাহর লানত, তার জন্য দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতে শাস্তি অবধারিত। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না। নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত প্রদান করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।‘ [সূরা বাকারা: ২৭৬-২৭৯]

মুসনাদে আহমদে রয়েছে, আব্দুল্লাহ বিন হানজালা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘জেনে-শোনে কোন ব্যক্তির এক দিরহাম সুদ ভক্ষণ করা, ছত্রিশ বার যেনার চেয়েও ভয়াবহ।‘ হায়সামি ‘মাজমা’তে বলেছেন : এ হাদিসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যেনার তেয়াত্তুরটি শাখা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নের শাখা হচ্ছে ব্যক্তির তার মায়ের সাথে যেনা করা।‘ হাকেম এ হাদিসটি বর্ণনা করে সহিহ বলেছেন, আর যাহাজাবি তার সমর্থন করেছেন।
বুখারি রাহিমাহুল্লাহ সামুরা বিন জুনদুব থেকে একটি লম্বা হাদিস বর্ণনা করেন, তাতে রয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যাদেরকে বিভিন্ন ধরণের শাস্তি দেয়া হচ্ছিল, তন্মধ্যে : এক ব্যক্তি রক্তের সমুদ্রে সাতার কাটছিল, আর অপর ব্যক্তি তীরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সামনে রাখা ছিল পাথর, যখনই সাতারু ব্যক্তি তীরের নিকবর্তী এসে হাঁ করে, তীরে দণ্ডায়মান ব্যক্তি তার দিকে পাথর নিক্ষেপ করে, ফলে সে আবার নহরের মাঝখানে ফিরে যায়। পুনারায় যখন নহরের নিকটবর্তী হয়, লোকটি আরেকটি পাথর নিক্ষেপ করে, অনুরূপ করতে ছিল … আল্লাহর নিকট আমরা আশ্রয় প্রার্থনা করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করেন এ ব্যক্তিকে ? তাকে বলা হয় : এ হচ্ছে সুদ খোর।

মুসলিম রহ. জাবের রা. থেকে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ খোর, সুদের কাজে নিয়োজিত, সুদের লেখক ও সাক্ষীদ্বয়ের উপর লানত করেছেন। তিনি আরো বলেছেন : এরা সবাই সমান, অর্থাৎ পাপে।

অভাব ও মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা:

আল্লাহর কুদরত অসীম, তিনি বান্দাদের বিভিন্ন মুসিবত দ্বারা পরীক্ষী-নিরিক্ষা করেন, যাতে রয়েছে অনেক হিকমত, যা একমাত্র তিনিই জানেন, এর মাধ্যমে তিনি বান্দাদের সত্যিকার তাওবা পরীক্ষা করেন, তাদের পাপ মোচন করেন ইত্যাদি। মুমিনদের কর্তব্য এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। আর এ মুসিবতের মধেও আল্লাহর অনুগ্রহ দেখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘বড় মুসিবতের সাথে প্রতিদান বড়ই প্রদান করা হয়। আর আল্লাহ যখন কোন কওমকে ভালবাসেন, তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন। যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তার জন্য সন্তুষ্টি, আর যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তার জন্য অসন্তুষ্টি।‘ [তিরমিযি, তিনি হাদিসটি হাসান বলেছেন]

আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।‘ [সূরা আম্বিয়া: ৩৫]

আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।‘ [সূরা বাকারা: ১৫৫-১৫৬]

মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি’বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।‘ [সূরা আনকাবুত: ২-৩]

 

অতএব, আমাদের উচিত ভাল-মন্দ আল্লাহর তাকদীরের উপর ধৈর্য ধারণ করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। অধিকন্তু এটা ঈমানের ছয়টি রুকনেরও অন্তর্ভুক্ত। যেমন হাদিসে জিবরিলে এসেছে: ‘ঈমান হচ্ছে, তোমার বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর উপর, তার ফেরেশতাদের উপর, তার কিতাবসমূহের উপর, তার রাসূলদের উপর, কিয়ামত দিবসের উপর এবং বিশ্বাস স্থাপন করা ভাল-মন্দ তাকদীরের উপর।‘ [মুসলিম]

অল্পে তুষ্ট থাকা:

তাই আমাদের উচিত অল্পে তুষ্ট থাকা, আল্লাহর বণ্টনকৃত রিযকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা, কারণ সন্তুষ্টি ও শোকর স্বচ্ছলতা ও অধিক নিআমতের লাভের উপায়। হাদিসে এসেছে: ‘তুমি তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তুমি অধিক ইবাদতকারী হয়ে যাবে, অল্পে তুষ্টি থাক তাহলে সবচেয়ে শোকর আদায়কারী হয়ে যাবে, আর তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ কর, মানুষের জন্য তাই পছন্দ কর, তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মুমিন হবে, আর তোমার যে প্রতিবেশী হয় তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার কর, তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মুসলিম হবে। আর হাসা কমিয়ে দাও, কারণ অধিক হাসি অন্তর নির্জীব করে দেয়।‘ [ইবনে মাজাহ, আল-বানি হাদিসটি সহিহ বলেছেন।]

এ হাদিসটির অন্য আরেকটি বর্ণনা: ‘তুমি তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তুমি সবার চেয়ে অধিক ইবাদতকারী হয়ে যাবে, আল্লাহ তোমার জন্য যে রিয্ক বণ্টন করেছে, তাতে তুমি সন্তুষ্টি প্রকাশ কর, তাহলে তুমি সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে, আর মুমিন ও মুসলমানদের জন্য তাই পছন্দ কর, যা তুমি নিজের জন্য ও তোমার পরিবারের জন্য পছন্দ কর, আর যা তুমি নিজের জন্য ও তোমার পরিবারের জন্য অপছন্দ কর, তাদের জন্য তাই অপছন্দ কর, তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মুমিন হবে। তুমি যার প্রতিবেশী হও, তার সাথে সদ্ব্যবহার কর, তাহলে তুমি মুসলিম হয়ে যাবে, খবরদার! তুমি বেশী হাসা পরিত্যাগ কর, কারণ অধিক হাসি অন্তরের অনিষ্ট।‘ [ইবনে মাজাহ, আল-বানি হাদিসটি হাসান বলেছেন]

ইমাম আহমদ প্রমুখ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আল্লাহ তার বান্দাদেরকে প্রদত্ত নিয়ামত দ্বারা পরীক্ষা করেন, যে আল্লাহর বণ্টনকৃত রিযকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তাতে তার জন্য বরকত দেয়া হয় ও প্রসস্ততা দান করা হয়, আর যে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য তাতে বরকত প্রদান করা হয় না এবং তাকে নির্ধারিত রিযকের বেশীও দেয়া হয় না। সহিহ জামে গ্রন্থে ইমাম সুয়ূতী ও আল-বানি হাদিসটি সহিহ বলেছেন।

প্রতেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য আল্লাহর বণ্টকৃত রিযকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তার প্রতি তুমি সন্তুষ্টি প্রকাশ কর, তাহলে তুমিই সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে।‘ [আহমদ ও তিরমিজি]

ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. সূত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ‘সে ব্যক্তিই সফলকাম, যাকে ইসলামের হিদায়াত ও পরিমাণ মত রিযক প্রদান করা হয়েছে, আর সে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।‘ [মুসলিম]

তিরমিজি শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘আল্লাহ তোমার জন্য যে রিয্ক বরাদ্ধ করেছেন, তাতেই তুমি সন্তুষ্ট থাক, তাহলে তুমিই সবচেয়ে ধনী হয়ে যাবে।

সচ্ছলতা কখনো পরীক্ষার বস্তু:

নেককার লোকের অভাব ও পাপী ব্যক্তির সচ্ছলতা দুঃখিত, হতাশাগ্রস্ত ও সন্দিহান হওয়ার কোন কারণ নেই, আল্লাহ কখনো পাপীকে অবকাশ প্রদানের জন্য সচ্ছলতা প্রদান করেন, যেমন হাদিসে রয়েছে: ‘যখন দেখ যে, কোন বান্দা পাপে লিপ্ত, তবুও আল্লাহ পার্থিব জগতে তাকে তার পছন্দনীয় বস্তু প্রদান করছেন, এটা নিশ্চিত ঢিল দেয়া ও অবকাশ প্রদান করা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করেন : (অর্থ) অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা যখন তা ভুলে গেল, আমি তাদের উপর সবকিছুর দরজা খুলে দিলাম। অবশেষে যখন তাদেরকে যা প্রদান করা হয়েছিল তার কারণে তারা উৎফুল্ল হল, আমি হটাৎ তাদের পাকড়াও করলাম, ফলে তখন তারা হতাশ হয়ে গেল।‘ [সূরা আনআম : (৪৪) আহমদ, বায়হাকি ফি শুআবিল ঈমান, তাবরানি ফিল কাবির, হাদিসটি আল-বানি সহিহ বলেছেন]

আসবাব গ্রহণ করা:

কোন মানুষের সাধ্য নেই, আল্লাহ যে রিযক নির্ধারণ করেছেন, তাতে সামান্য রদবদল বা পরিবর্তন করা। কিন্তু এটা ঠিক যে, আল্লাহ যার জন্য যে পরিমাণ রিযকের আসবাব নির্ধারণ করেছেন, তাকে সে পরিমাণই তিনি রিযক প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিয্ক থেকে তোমরা আহার কর। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।‘ [সূরা মুলক: ১৫]

তিনি অন্যত্র বলেন: ‘তাই আল্লাহর কাছে রিয্ক তালাশ কর, তাঁর ইবাদাত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।‘ [সূরা আনকাবুত: ১৭]

রিযকের জন্য আসবাব গ্রহণ বা তার জন্য চেষ্টা-তদবির করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযক নির্ধারিত না হওয়া প্রমাণ করে না। এ পার্থিব জগতের সাধারণ নিয়মে আল্লাহ কাউকে সরাসরি রিযক প্রদান করেন না, এ দুনিয়া দারুল আসবাব বা উপায় অবলম্বনের জগত, সবাইকে তিনি রিযকের জন্য উপায় অবলম্বনের নির্দেশ দেন, যেমন মারইয়াম আলাইহাস সালামকে দিয়েছেন: ‘আর তুমি খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার উপর তাজা পাকা খেজুর ফেলবে।‘ [সূরা মারইয়াম: ২৫]

আল্লাহ চাইলে নাড়া ব্যতীতই তার নিকট খেজুর পড়ত, কিন্তু তিনি তাকে আসবাব গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সকলের কর্তব্য রিযকের আসবাব গ্রহণ করে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা।

তাকওয়া অবলম্বন করা:

রিযকের জন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিত আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করা এবং হালাল রিযকের উপায় অবলম্বন করা ও হারাম থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তার ইচ্ছা ও হিকমতের দাবি অনুসারে প্রত্যেককে রিযক প্রদান করেন। অতএব যার জন্য আল্লাহ যে পরিমাণ রিযক নির্ধারণ করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।‘ [সূরা তালাক: ২-৩]

তিনি আরো বলেন: ‘আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিয্ক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা যমীনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণে যা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।‘ [সূরা শুরা: ২৭]

ইবনে কাসির রহ. বলেছেন : কিন্তু আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে সে পরিমাণ রিযক প্রদান করেন, যাতে তার কল্যাণ নিহিত। এ ব্যাপারে তিনিই বেশী জানেন। অতএব যে সম্পদের উপযুক্ত তাকে তিনি সম্পদ দান করেন। আর যে অভাবের উপযুক্ত তাকে তিনি অভাবে রাখেন। এর দলিল হিসেবে ইমাম ইবনে কাসির উল্লেখ করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আমার কাছে জিবরিল এসে বলে : হে মুহাম্মদ, তোমার রব তোমার কাছে সালাম প্রেরণ করেছেন এবং তিনি বলেছেন : আমার কিছু বান্দা রয়েছে, সচ্ছলতা ব্যতীত যার ঈমান ঠিক থাকবে না, আমি যদি তাকে অভাব দেই, তাহলে সে কুফরি করবে। আবার আমার কিছু বান্দা রয়েছে, অভাব ব্যতীত যার ঈমান ঠিক থাকবে না, আমি যদি তাকে সচ্ছলতা দেই, তাহলে সে কুফরি করবে। আবার আমার কিছু বান্দা রয়েছে অসুস্থতা ব্যতীত যার ঈমান ঠিক থাকবে না, আমি যদি তাকে সুস্থ করি তাহলে সে কুফরি করবে। আবার আমার কিছু বান্দা রয়েছে সুস্থতা ব্যতীত যার ঈমান ঠিক থাকবে না, আমি যদি তাকে অসুস্থ করি, তাহলে সে কুফরি করবে। হাদিসটি দুর্বল, ইবনে জাওজি রহ. যদিও ইলাল গ্রন্থে এ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এর অর্থ সহিহ, আর এ জন্যই ইমাম ইবনে কাসির হাদিসটি উল্লেখ করে কোন মন্তব্য করেননি।

এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে, যার ফলে রিযক বৃদ্ধি পায়, যেমন আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। বুখারি ও মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে তার রিযক বৃদ্ধি ও পশ্চাতে সুখ্যাতি কামনা করে, সে যেন রেহেম তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট ও অবিচ্ছন্ন রাখে।‘ (বুখারি ও মুসলিম)

অনুরূপ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য দান-সদকা করার ফলেও রিযক বৃদ্ধি পায়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, রিযকের প্রসস্ততা বা সচ্ছলতা দ্বারা সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার বরকত, বান্দাকে দেয়া তার সুখ ও শান্তি। অল্প সম্পদে যদি আল্লাহ কাউকে এসব নিআমত দান করেন, তাহলে তিনি প্রকৃত সচ্ছলতা ও প্রসস্ততা দান করেছেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও যমীন থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।‘ [সূরা আরাফ: ৯৬]

দোয়া করা: 

দোয়ার কোন বিকল্প নেই, যে কোন প্রয়োজনে আল্লাহর নিকট দোয়া করা, কখনো আল্লাহর রহমত ও দোয়া কবুলের আশা থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। সহিহ মুসলিমে রয়েছে: ‘তোমাদের প্রত্যেকের দোয়া কবুল হয়, যদি গুনাহ অথবা আত্মীয়তা ছিন্নের দোয়া করা না হয়, এবং যে পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করা না হয়।‘ [মুসলিম]

মুসিবত দুর করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার দোয়া। ইমাম তিরমিযি সুলাইমান থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘দোয়াই একমাত্র তাকদীর পরিবর্তন করতে পারে এবং নেকিই শুধু মানুষের বয়ষ বৃদ্ধি করতে সক্ষম।’ তিরমিজি, হাদিসটি আল-বানি হাসান বলেছেন।
হাদিসে এসেছে, জিন্নুন (ইউনুস আলাইহিস সালাম) এর দোয়া, যার মাধ্যমে তিনি মাছের পেটে আল্লাহকে আহ্বান করেছেন, তা হচ্ছে: কোন মুসলিম মুসিবতে এ দোয়া পড়লে, অবশ্যই আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন ।’ তিরমিযি, হাকেম- তিনি হাদিসটি সহিহ বলেছেন, আর যাহাবি তার সমর্থন করেছেন।
আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বসা ছিলাম, এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছে, সে রুকু করল, সেজদা করল, তাশাহহুদ পড়ল এবং দোয়া করল, সে তার দোয়ায় বলল : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের বললেন : তোমরা জান সে কিসের মাধ্যমে দোয়া করেছে ? তারা বলল : আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেন: যার হাতে আমার নফস, তার শপথ করে বলছি, সে আল্লাহর ইসমে আজমের মাধ্যমে দোয়া করেছে, যার মাধ্যমে দোয়া করলে, দোয়া কবুল হয় এবং যার মাধ্যমে প্রার্থনা করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়’।

নাসায়ী, ইমাম আহমদ, আল-বানি হাদিসটি সহিহ বলেছেন। অতএব প্রত্যেকের উচিত ইউনুস আলাইহিস সালাম দোয়া ও ইসমে আজমের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা।

রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দোয়া করা, সেজদায় দোয়া করা। মুসলিম ও সুনান গ্রন্থে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যখন রাতের অর্ধেক অথবা দুই তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়, আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, অতঃপর বলেন: আছে কেউ প্রশ্নকারী, যাকে দেয়া হবে ? আছে কেউ দোয়াকারী, যার দোয়া কবুল করা হবে ? আছে কেউ ইস্তেগফারকারী, যার গুনা ক্ষমা করা হবে ? এভাবেই ফজর উদিত হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদায় দোয়া করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে বলেন: ‘তোমরা সেজদায় খুব দোয়া কর, কারণ সেখানে দোয়া কবুল করা হয়।‘ [মুসলিম]

তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকার কিছু পদ্ধতি:

এক. নিচের লোকের প্রতি দৃষ্টি দেয়া : ইমাম মুসলিম প্রমুখগণ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের নিচে যারা রয়েছে, তাদের দিকে তোমরা দৃষ্টি প্রদান কর। তোমাদের উপররের লোকের দিকে তাকিয়ে না, তাহলে তোমরা আল্লাহর নিআমতের অকৃতজ্ঞ হবে না।’

ইমাম নববী বলেন : ইবনে জারির প্রমুখগণ বলেছেন : এ হাদিসে সব ধরনের কল্যানের কথা রয়েছে, কারণ মানুষ যখন দুনিয়ার দিক থেকে তার উপরে তাকায়, তখন সে তার ন্যায় নিআমত প্রত্যাশা করে। আর তার নিকট রক্ষিত আল্লাহর নিআমত সে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে, আরো অধিক কামনা করে তার সমকক্ষ বা নিকটবর্তী হওয়ার জন্য, এটাই মানুষের সাবাভিক প্রকৃতি। আর যদি দুনিয়াবী বিষয়ে তার নিচের দিকে তাকায়, তখন তার সামনে আল্লাহর নিআমত বিকশিত হবে, ফলে সে আল্লাহর শোকর আদায় করবে, বিনয়ী হবে ও কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করবে।

দুই. অন্তর থেকে এ ধারণা দূরীভূত করা যে, সচ্ছলতা সম্মানের প্রতিক আর অসচ্ছলতা অসম্মানের প্রতিক। আল্লাহ তাআলা এ ধারণা  খণ্ডণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন: আর মানুষ তো এমন যে, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন, তখন সে বলে, আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’।

তিন. এ বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ মানুষের কল্যানের দিকে লক্ষ্য রেখেই কম দেন বা বেশী দেন। তিনি বলেন: ‘আর আল্লাহ যদি তার বান্দাদের জন্য রিয্ক প্রশস্ত করে দিতেন, তাহলে তারা যমীনে অবশ্যই বিদ্রোহ করত। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণে যা ইচ্ছা নাযিল করেন। নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে পূর্ণ অবগত, সম্যক দ্রষ্টা।‘ [সূরা শুরা: ২৭]

চার. এ জগতে যদি মানুষ রিযক ও সামর্থের ব্যাপারে সমান হয়ে যেত, তাহেল এ পার্থিব জগত অচল হয়ে যেত, অনেক কর্মই বিনষ্ট হতো। এ দিকেই ইশারা করে আল্লাহ বলছেন: ‘তারা কি তোমার রবের রহমত ভাগ বণ্টন করে? আমিই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করে দেই এবং তাদের একজনকে অপর জনের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরকে অধিনস্থ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। আর তারা যা সঞ্চয় করে তোমার রবের রহমত তা অপো উৎকৃষ্ট।‘ [সূরা জুখরুফ: ৩২]

পাঁচ. আমরা যখন এসব অনুধাবন করতে পারলাম, এখন মুসলিমদের জানা উচিত, রিযক আল্লাহর তাকদির, তার ইচ্ছা ও ইলমের উপর নির্ভরশীল, অতএব আল্লাহর বণ্টনে সন্তুষ্ট থাকা এবং তার তাকওয়া অবলম্বন করা, যেমন তিনি বলেছেন: ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।‘ [সূরা তালাক: ২-৩]

মুদ্দাকথা:

সচ্ছলতা অসচ্ছলতা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য একটি পরীক্ষা। এর মাধ্যমে তিনি কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী যাচাই করেন। ধনী ব্যক্তির উচিত তার উপর আল্লাহর নিআমতের শোকর আদায় করা এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দান-সদকা করা। আর ফকীর ব্যক্তির উচিত দৈর্য ধরা ও আল্লাহর প্রশংসা করা।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

10 COMMENTS

  1. অত্যন্ত মূল্যবান একটি পোষ্ট। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আল কোরআন ও সহীহ হাদীসের দলিল ভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের সকলের উচিত কোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে নিজের এবং প্রত্যেকের পারিবারিক জীবন গড়ে তোলা। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন!
    যাজাক আল্লাহু খায়রান।

  2. আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর পোস্টটি করার জন্য। হালাল রুজির জন্য ৪ টি শর্ত আমি জানতাম। দয়া করে শর্তগুলো পোস্ট করলে খুশি হতাম। ধন্যবাদ।

  3. ZazakAllahu khairan… A post which really touches the heart…. So authentic n informative by Quran n Sunnah…. Pls keep posting.

আপনার মন্তব্য লিখুন