প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমাজ সংস্কার

0
2978

লেখক: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

শান্তি-কল্যাণ ও সহযোগিতাপূর্ণ সহাবস্থানের শিক্ষায় মানব চরিত্রকে সংশোধন ও উন্নয়নের জন্য বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আবির্ভূত হন। তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে সংস্কার বাস্তবায়ন করেন তা আজো সারা বিশ্বের শত কোটি মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আর্বিভাব, পূর্বকালীন সময়ের মানুষের অপকর্মের বর্ণনায় ‘বিশ্বনবী গ্রন্থে বলা হয়েছে “তাদের আচরণে শয়তানও লজ্জা পেত!’ সে সময় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে ভয়াবহ ও বিশৃংখল অবস্থা বিরাজ করছিল। ব্যক্তিগত ও ধর্মীও জীবনে ছিল চরম নৈরাজ্য, এজন্য ঐ সময়কে বলা হয় ‘আইয়্যামে জাহিলিয়াত’ বা মূর্খতার যুগ।

ধর্মীয় ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে হতাশা-অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধূলির ধরায় আগমন মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। আল-কোরআনের ভাষায়- “মু’মিনদের প্রতি আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ তিনি তাদের প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল পাঠিয়েছেন যিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন (শিরক কুফর থেকে) এবং তাদেরকে আল্লাহ কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দান করেন।” [আলে-ইমরান : ১৬৪] প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্বনবী, তাই কল্যাণ ও মুক্তির নিশ্চিত পথ দেখানো ছিল তাঁর প্রতিটি কর্ম, বাণী ও অবস্থানগত তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য। সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাঁর তৎপরতা সামষ্টিকভাবেই নিয়ে আসে গুণগত পরিবর্তন ও চমৎকার স্বস্তির পরিবেশ। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কে অবহিত হওয়া আমাদের ঈমানী কর্তব্য।

ইসলাম-পূর্ব যুগে সমাজে গোত্রে গোত্রে কলহ, নিন্দা, হানাহানি ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। কবির লড়াই, উটের দৌড়, পবিত্র মাসের অবমাননা ইত্যাদি বিচিত্র কারণেই সহসা শুরু হয়ে যেত রক্তারক্তি কান্ড। গৃহপালিত পশু, পানির ঝর্ণা, নারী লুণ্ঠন, এমনকি তুচ্ছ ঘটনায় বচসা থেকে বিদ্রোহ এবং বিরাট লড়াই একবার শুরু হলে তা চলত বছরের পর বছর আর যুগ যুগান্তরের পরিক্রমায়। যাকে ‘আইয়্যামুল আরব’ বলা হত। একমাত্র বসুসের যুদ্ধ চলে ৪০ বছর আর এতে মারা যায় ৭০০০০ লোক। আউস, খাজরাজ, হাওয়ালিন ইত্যাদি গোত্রগুলো ছিল সার্বক্ষণিক যুদ্ধে লিপ্ত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ যুদ্ধবাজ জাতিকে শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন। আল্লাহ বলেন- “তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু ; অতঃপর তিনি তোমাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করে দিলেন আর তোমরা হয়ে গেলে পরস্পর ভাই ভাই।” [সূরা আলে-ইমরান : ১০৩]

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্বকালে নৈতিক স্খলন, অনাচার, মদ, জুয়া, সুদ, ব্যভিচার, চুরি, হত্যাকান্ড, নারী হরণ, চরিত্রহনন ইত্যাদিতে সমাজ ছিল কলুষিত। বিধবা-বিমাতা বিয়ে, সুদ আদায়ে অপারগ গ্রহীতার স্ত্রী-সন্তানকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি, বিজয়ী সেনাদেরকে বিজিত গোত্রের নারীদের অবাধে দেহদান ইত্যাদি ছিল এক পৈশাচিক নারকীয় আনন্দের ব্যাপার। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল অপরাধ দমনের জন্য আল-কোরআনের শিক্ষার বাস্তবায়ন করেন। ব্যভিচারের জন্য একশত বেত্রাঘাত, চুরির অপরাধে হাতকাটাসহ মদ, জুয়া, হত্যাকান্ড ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর-কঠিন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ফলে অপরাধমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনের ঘোষণা হল- “তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৩২] আল্লাহ আরো বলেন- “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করল সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে দগ্ধিভূত হবে।” [সূরা আন-নিসাঃ ৯৩] আল-কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা- “চোর-চোরনীর হাত কেটে দাও।” [সূরা আল-মায়েদাঃ ৩৮]

মহান আল্লাহ আরো বলেন- ‘মদ্যপান, জুয়া খেলা, মূর্তি, লটারী, নিশ্চয়ই এগুলো শয়তানের কাজ।’ প্রাচীন আরবে জীবিত শিশু কন্যাকে কবর দেয়া হত। কেননা তখন কন্যা সন্তান জন্মকে কলঙ্কজনক বিষয় মনে করা হত। কোরআনের ভাষায়- “আর যখন তাদেরকে কন্যা সন্তানের সংবাদ দেওয়া হত; তখন ক্ষোভ-অপমানে তাদের মুখমণ্ডল অন্ধকার হয়ে যেত।” [সূরা নাহল: ৫৮]

ইসলামপূর্ব যুগে কন্যা সন্তানের জন্মকে অপমান মনে করা হতো। তারা তাদের কন্যা সন্তানদের মাটির নিচে পুঁতে ফেলত। “তাদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কাল হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়।তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে, তা কতই না নিকৃষ্ট।” [সুরা আন-নাহলঃ ৫৮-৫৯] এ প্রসঙ্গে আল কোরআনের কঠোর উচ্চারণ- “যখন জীবন্ত-প্রোথিতা কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে,’কোন অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছিল’?” [সূরা  আত-তাকবীরঃ ৮-৯] তাই এ ধরনের মানবতা বিরোধী তৎপরতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। মহান আল্লাহর নির্দেশ – “তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৩১]

অন্ধাকার যুগে দাস-দাসীকে পশু, গৃহস্থলী সামগ্রীর ন্যায় বিক্রি করা হতো এবং তাদের প্রতি নিমর্ম ব্যবহার করা হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন এবং অপরাধের কাফ্‌ফারা হিসেবেও তিনি দাস মুক্তির ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। চির নিঃগৃহীত বিলাল, যায়েদ, সালমান ফারসি, সুহায়েল রুমী প্রমুখ (রাঃ)-কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন- “সবচে’ উত্তম দাসমুক্তি হলো সেই গোলামকে আজাদ করা যে সবচে’ দামী এবং তার মালিকের কাছে সবচে’ প্রিয়।” [সহীহ বুখারী, খন্ড ৩, অধ্যায়ঃ ৪৬, হাদীস নংঃ ৪৯৪]

ইসলাম পূর্বকালে নারীকে নরের অধীন ও ভোগের সামগ্রী মনে করা হত। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে স্ত্রীর মর্যাদায় মোহরানা ও উত্তরাধিকারের দাবীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাচীন পন্থীরা মনে করত ‘নারী’ ওরা যেন মানুষ নয় কেবলই মেয়ে মানুষ। উটের দৌড়ের সময় উটের লেজের সাথে মেয়েদেরকে বেঁধে দেয়া হত আর নগ্ন দেহবল্লবীর বিভৎষতা ও আর্ত-চিৎকারে ঐ পিশাচেরা আনন্দ পেত। এহেন অবস্থার পরিবর্তন সাধনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন- “তারা তোমাদের ভূষণ তোমরা তাদের ভূষণ।” [সূরা আল-বাকারাঃ ১৮৭]

বিদায় হজ্জে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “তোমরা নারী জাতির (অধিকারের) ব্যাপারে সতর্ক হও কেননা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ।” [সহীহ আল-বুখারীঃ ১৬২৩, ১৬২৬; সহীহ মুসলিমঃ ৯৮]প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- “মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত।” [সুনানে ইবনে মাজাহ২৭৭১;শাইখ আলবানি হাদীসটি সহীহ বলেছেন] তৎকালে এতিম, মিসকিনদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এতিমের মাল লুটেপুটে খাওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআনের ভাষায় ঘোষণা করেন- “নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে অনাথদের সম্পদ ভোগ করে তারা নিজেদের পাকস্থলীকে অগ্নি দ্বারা পূর্ণ করে।” [সূরা আন-নিসা: ১০]

প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থায় আরবের মানুষের মূল্যবোধও নৈতিকতায় প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন তথা মানুষের ন্যূনতম অধিকারকে স্বীকার করা হত না। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইসলামি জীবনবোধ প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও মানুষের সার্বিক অধিকার-কর্তব্যকে ঈমানের পূর্ণতার সাথে সংশ্লিষ্ট করে। সমাজে উঁচু, নিচু শ্রেণীতে ভেদাভেদ, কৌলিন্যের অংহকার, হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণা ইত্যাদি ছিল প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থার উপাদান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাম্যের নীতির মাধ্যমে নিছক জন্মগত প্রাধান্য ও বৈষম্যের প্রাচীর অতিক্রম করেন। তিনি ঘোষণা করলেন- “প্রত্যেক মানুষ আদম ও হাওয়ার সন্তান। অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের; কালোর উপর সাদার এবং সাদার উপর কালোর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই- শুধুমাত্র তাকওয়া এবং নেক আমল ছাড়া।” [সহীহ আল-বুখারীঃ ১৬২৩, ১৬২৬; সহীহ মুসলিমঃ ৯৮] অন্যদিকে ইসলাম কর্মবিমুখিতাকে সমর্থন করে না। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ছিল,ভিক্ষা করো না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন কিয়ামত উপস্থিত হবে তখন তার (ভিক্ষুকের) মুখমন্ডলে গোশত থাকবে না।” [সহীহ মুসলিমঃ ২২৬৫]

মূলত: মুনাফিকি, মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি নৈতিক ত্রুটি সমূহ ত্যাগ করে পরকালের ভয় অন্তরে লালন করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। বাক-ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতাহীন সমাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গালাগালিকে গলাগলিতে, হাতাহতিকে করমর্দনে রূপান্তরিত করেন। সামাজিক জীবনে পূর্ণশান্তির দিক নির্দেশনা দিয়ে বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন- “তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, সম্ভ্রম পবিত্র” যেমন পবিত্র হজ্জের এই দিন, এই মাস, এই নগরী।” [সহীহ আল-বুখারীঃ ১৬২৩, ১৬২৬; সহীহ মুসলিমঃ ৯৮]

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বনবী, সবার নবী, কেননা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে বিশ্ব ধর্ম তথা সবার ধর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শিরক, কুফর, নিফাক ও বিদআতের স্বর্গরাজ্যে আরব ভূখন্ডে ইসলাম প্রচারের পূর্বে ধর্মীয় রীতিতে ছিল, পৌত্তলিকতা, ইহুদি, নাসারা বা খ্রীষ্টান মতের প্রাধান্য। এছাড়া ছিল “সাবেইন” নামক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, যারা তারকা বা অগ্নি পূজক বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে অল্প সংখ্যক একেশ্বরবাদী-অদৃশ্যে বিশ্বাসী হানিফ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। এরা নিজেদেরকে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অনুসারী বলে মনে করত- যদি ও তা স্পষ্ট নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তৎকালিন সকল মত পথ মানব মুক্তির সহায়ক ছিল না। তাই একজন ত্রাণ কর্তার আগমন ছিল বিশ্ববাসীর অত্যন্ত প্রত্যাশিত বিষয়। ঐতিহাসিক আমির আলীর ভাষায়- “পৃথিবীর ইতিহাসে পরিত্রাণকারী আর্বিভাবের এত বেশি প্রয়োজন এবং উপযুক্ত সময় অন্যত্র কখনো অনুভূত হয়নি।”

সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে আর্বিভূত হন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিবিত্র বিশ্বাস ও বিভক্ত মানবজাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দানের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে আল্লাহ মনোনীত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। আল-কোরআনের ভাষায়: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মনোনীত একমাত্র ধর্ম-ইসলাম।” [সূরা আলে-ইমরান: ১৯] ইসলামের মর্মবাণী হল, তাওহীদ ও রিসালতে বিশ্বাস। পৌত্তলিকতা বা বহুত্ববাদের স্থান ইসলামে নেই। আল-কোরআনের নির্দেশ হল- “আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করো না।” [সূরা আন-নিসাঃ ৩৬] অন্যত্র আল্লাহ বলেন- “আল্লাহ তাঁর সাথে শিরকের অপরাধ ক্ষমা করেননা।” [সূরা আন-নিসাঃ ১১৬]

ইসলাম ধর্ম পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষায়- “সাক্ষ্য দেয়া আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দান করা, হজ্জ পালন করা, রমজান মাসে রোজা রাখা।” [সহীহ বুখারিঃ ৮] প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একমাত্র ধর্মভীরুতা বা তাকওয়াকে মানব মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে স্থির করেছেন। পুরোহিত প্রথা, বৈরাগ্যবাদ ইত্যাদি ভ্রান্ত চেতনা খন্ডন করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কর্মময় জীবনকে পরকাল চিন্তা ও জবাবদিহিতার মানদন্ডে নির্ধারণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনের বাণী দ্বারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন- “যে সামান্য পূণ্য নিয়ে উপস্থিত হবে সে তার প্রতিদান পাবে আর যে বিন্দু মাত্র পাপ করবে সেও তার প্রতিফল ভোগ করবে।” [যিলযাল: ৭-৮] ধর্মীয় সুবিধাবাদের নামে ভন্ডামী, লেজুরবৃত্তি, মিথ্যা, প্রতারণা, কুট-কৌশল, ছল-চাতুরি, বর্ণচোরাভাব ইত্যাদি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধর্মীয় শিক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- “মুনাফিকের আবাসস্থল জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।” [সূরা নিসা : ১৪৫] অন্যদিকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম দর্শনে আল্লাহর ইবাদত ও মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে অভিন্ন মাত্রায় বিবেচনা করা হয়। মহান আল্লাহ বলেন- “তিনিই মানুষের জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন কে সৎকর্ম করে তা পরীক্ষা করার জন্য।” [সূরা মুলক: ২]

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধর্মীয় শিক্ষার আরো একটি দিক হল তিনিই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বনবী। পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের প্রতি বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অংশ। অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্য ও সম্প্রীতি হল ইসলামের অঙ্গীকার। বল প্রয়োগে ইসলাম পালনে বাধ্য করা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ নয়। বরং শান্তি ও সৎচরিত্রের মাধুর্যে অন্যকে কাছে টানা হল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্য। কেননা পবিত্র কোরআনের নীতি হল:  “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” [সূরা বাকারাঃ ২৫৬]

মূলতঃ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কল্যাণকর শিক্ষা আর অনুপম আদর্শের আলোকে আলোকিত মানুষ গড়া হল ইসলামের উদ্দেশ্য এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৎপরতার লক্ষ্য। এজন্যই বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেন- “আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিষ রেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ করলে তোমরা কখনো বিভ্রান্ত হবে না। জিনিষ দু’টি হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব এবং তাঁরই রাসূলের সুন্নাহ।ইসলাম আল্লাহ মনোনীত ধর্ম এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল এ কথায় বিশ্বাস করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। কেননা পবিত্র কোরআনে তাকে খাতামুন নাবিয়্যিন’ বলা হয়েছে। আর সমগ্র কোরআন মজিদই হল খতমে নবুওয়তের প্রমাণ।

পরিশেষে বলা যায় শান্তি ও কল্যাণের পথই হল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর শিক্ষা ও সংস্কারের মূল চেতনা। যুগ ও কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার বিশ্ব মানবতার একমাত্র পাথেয়। তাই জর্জ বার্নাড’শ যথার্থই বলেছেন- “অনাগত আগমীতে সকল ধর্ম ও বিশ্বাস তার কার্যকারীতা হারাবে কিন্তু মুহাম্মদ প্রচারিত বিশ্বাসের মধ্যে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পাবে।”

মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ পরিপূর্ণ রূপে পালন করার শক্তি দান করুন। আমীন!!

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন