স্বনির্ভরতা অর্জনে ইসলাম : একটি পর্যালোচনা – পর্ব ২

1
700

লেখক: ড. হুসাইন আহমাদ | সম্পাদনা: ড. মো: আবদুল কাদের

পর্বঃ ১ | পর্বঃ ২

দান-সদকায় উৎসাহ দান

স্বনির্ভরতা অর্জনে দানশীলতার সুদুরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতা বিকাশে উৎসাহ প্রদান করেছেন। মানুষের চরিত্রের একটা বড় দিক হল সে সবকিছু নিজের কাছে রাখতে চায়। কৃপণতার কারণে ক্রমেই সে সঙ্কুচিত হতে থাকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃপণাতাকে নিকৃষ্ট মানসিক রোগ বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রয়োজনাতিরিক্ত সবকিছু দান করে দেয়ার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। পবিত্র আল-কুরআনে এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে যে, কি ব্যয় করবে? বলে দাও উদ্বৃত সবকিছু।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “তোমাদের সম্পদে ভিক্ষুকও বঞ্চিত জনের অধিকার রয়েছে।[1]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীরা দানশীলতার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার দারিদ্য দূরীকরণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইমাম মুসলিম উল্লেখ করেছেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একটি নও মুসলিম গোত্রের জন্য সাহায্যের কথা বললে সবাই তাদের জন্য ছুটে আসেন; কেউ খাদ্য ও কেউ কাপড় নিয়ে আসেন, আর একজন আনসারী বেশ বড় পরিমাণের অর্থ দান করে।[2] একটি ঘটনার কথাতো সুবিদিত যে, ‘বদরের যুদ্ধবন্দীদেরকে মুসলমানরাই উদারতার সঙ্গে খাদ্য ও বস্ত্র দান করেছিলেন।[3]একইভাবে মুসলমানগণ হুনায়ন ও তায়েফ যুদ্ধের পর হাওয়াজিন গোত্রের ৬০০০ যুদ্ধবন্দীকে পরিধানের কাপড় দান করে ছিলেন।[4] এ প্রসেঙ্গ মদীনার আনসারগণ কর্তৃক সর্বস্বত্যাগী মুহাজিরগণকে নিজেদের জায়গা, জমি, বাগিচা, ঘর ও অর্থ সম্পদ দান করার কথা উল্লেখযোগ্য। [5] সুতারং দানশীলতার মাধ্যমে পরনির্ভরশীল, নিঃস্ব ও অভাবী মানুষ স্বনির্ভরতা অর্জনের অবলম্বন পেতে পারে।

পুঁজি ও মূলধনের ব্যবস্থা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদসহ মুলধন লাভের অবৈধ পন্থাগুলো নিষিদ্ধ করে মূলধন লাভে ইচ্ছুকদেরকে বৈধপন্থায় তাদের মুলধন লাভের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যারা চাষাবাদে উৎসাহী তিনি তাদের মাঝে পতিত জমি বন্টন করেছিলেন। এভাবে রাষ্ট্রাধীন অনাবদী জমিসমূহ আবাদী জমিতে পরিণত করেছিল। ব্যবসা ও বাণিজ্য প্রবণ লোককে নগদ মুলধন যোগাড় করে দেন, তাছাড়া ধনাঢ্য সাহাবীগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে টাকা বিনোয়োগ করতেন অথবা সাময়িক ঋন দিতেন। এতে সমস্যার সমাধান না হলে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মাল থেকে ঋনের ব্যবস্থা করতেন। ফলে যেমন বেকার জনগোষ্ঠী অর্থোপার্জন করার সুযোগ পেয়েছিল, তেমনি অলস মুলধন উৎপাদন খাতে ব্যয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।[6]

আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ীতা

অপরিমিত সম্পদ ব্যয় পরনির্ভশীলতার অন্যতম প্রধান কারণ। । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতাই সম্পদ ব্যয়ে মিতাচারী হবার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা অপব্যয করতে নিষেধ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে: ‘‘প্রাপ্য দেবে আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফিরদেরকে কিন্তু কিছুতেই অপব্যয় করবে না।[7]

আল্লাহ তাওয়ালা আরও বলেন: “অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।[8] ব্যয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা মধ্যম পন্থাবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে: “আর যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।[9] অতএব বলা যায় স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য অপব্যয় না করা ও মিতব্যয়ী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

নিয়ন্ত্রিত ভোগ-লিপ্সা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর লক্ষে সম্পদ অর্জনে মানুষের অতিরিক্ত লিপ্সাকে নিয়ন্ত্রন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি ইহকালের পরিবর্তে পরকালকেই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য বলে বর্ণনা করে পার্থিব জীবনকে আখিরাতের শষ্যক্ষেত্র হিসবে উপস্থাপন করেছেন।

পরকালীন সাফল্যের এ চেতনাবোধ মানুষকে সংযমী হবার প্রেরণা যোগায়। ফলে সবধরনের অনৈতিকতা ও লালসার যন্ত্রণা হতে মানুষ মুক্তি পায়। এ চেতনা তাকে আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে গভীরভাবে সাহায্য করে। তখন সে অন্যের বৈভব-আত্মসাৎকারী না হয়ে বরং কল্যাণকামীরূপে আত্মপ্রকাশ করে। জাগতিক স্বার্থচিন্তা ও পরস্বহরণ মানসিকতা আর থাকে না। পবিত্র কুরআনে এ উদ্দীপক চেতনাবোধের দিকে ইঙ্গিত করে এরশাদ হয়েছে: “তোমাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন তা দিয়ে আখেরাতের বাসস্থান অনুসন্ধান কর।[10] এ চিন্তাধারা সমাজে বিকশিত হলে সম্পাদার্জনের প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। বেড়ে যায় সাহায্য ও সহযোগিতার পরিমাণ, কমে যায়, পরনির্ভরশীলতা ও দারিদ্রতা।

কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা

স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রধান অন্তরায় বেকারত্ব। কোন সমাজে বেকারত্ব  থাকাবস্থায় স্বনির্ভরতা সম্ভব নয়। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের কর্মসংস্থানের অধিকারের কেবল স্বীকৃতি দেননি বরং তা নিশ্চিত ও করেছেন। বস্ত্তত অধিকারের ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান অংশীদার এবং এটি একটি মানবাধিকারও বটে। কোন মানুষকেই তার এ জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে একজন অন্যজনের উপর প্রাধান্যও পেতে পারে না।

মদিনা রাষ্ট্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অধিকার লাভের সুযোগ সকলের জন্য সমভাবে উম্মুক্ত করেছিলেন। এর ফলে সকল মানুষই নিজের দক্ষতায় অর্থ উপার্জন করে বিত্তবান হতে পারত। অবশ্য নিজের অক্ষমতার কারণেও অনেকে/সচ্চলতা হারাত, কিন্তু তাই বলে কোন লোককেই তার মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হতে হত না। স্বীয় দক্ষতার পরীক্ষায় কেউ ব্যর্থ হলে সে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থাদি পাকাপোক্ত দেখতে পেত। ফলে কাউকেউ অপরের দ্বারস্ত হতে হত না। বস্ত্তত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবর্তিত অর্থব্যবস্থা সামাজিক সুবিচারের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

উৎপাদন ক্ষেত্রে মুনাফায় শ্রমিকের অংশ দান

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমজীবি মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্যতা দুরকরণ ও স্বনির্ভর করে তোলার জন্য মুনাফায় শ্রমিকের অধিকারের ঘোষাণা দিয়ে এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেন। [11] তাঁর প্রবর্তিত নীতি অনুযায়ী শ্রমিকের খাওয়া পরা বা বাসস্থান কিছুতেই মালিকের জীবন যাত্রার মানের নিচে নামতে পারবে না। [12] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন: ‘শ্রমিকগণকে তাদের উৎপাদিত পণ্য থেকে অংশ প্রদান কর। কারণ আল্লাহর বান্দাহ এ শ্রমিকদেরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যাবে না।[13] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘তিন ধরণের ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি অভিযোগ করব। তাদের মধ্যে একজন হল সে, যে শ্রমিক খাটিয়ে নিজের কাজ আদায় করে নেয়ার পর শ্রমিকের মজুরী পরিশোধ করে না।[14] শ্রমজীবী মানুষের স্বণির্ভরতা অর্জনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘোষণা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

সুদব্যবস্থা নিষিদ্ধ করণ

সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম সুদ। সুদের কারণেই সমাজের দরিদ্র শ্রেণী আরও দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণী আরও ধনবান হয়, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ মানুষ প্রয়োজনের সময় সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে সুদে ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয়। [15]

সুদের টাকা ফেরত দেয়ার বাধ্য বাধকতার কারণে ঋণ গ্রহীতাকে অনেক সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করে হলেও সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে ঋণগ্রহীতা পরনির্ভশীল ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভবকালীন সময় আরব সমাজে এ ধরণের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের প্রচলন ছিল।

সুদের এই ভয়াবহ ও জঘন্য কুফল থেকে মানবতাকে রক্ষার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সুদকে নিষিদ্ধ করে বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।[16] সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে অর্থবন্টণ ব্যবস্থায় সুসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়। মদীনায় সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সুদজনিত মুদ্রাষ্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মন্দা ও অস্থিতিশীলতা থেকে অর্থ ব্যবস্থা রক্ষা পায়। বিনিয়োগ ও উৎপাদনের সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুদের কারণে সৃষ্ট শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটে। ভোক্তাগণ সুদ জনিত ব্যয় হতে রেহাই পায়, স্বনির্ভরতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুদ উচ্ছেদের ফলে বন্টন ক্ষেত্রে সৃষ্ট জুলুম ও বে-ইনসাফীর অবসান ঘটে।

বস্ত্তত সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা এমননি ধ্বংসাত্বক অর্থ ব্যবস্থা। ভোগবাদী পাশ্চাত্যেও যার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে। মনীষী এরিস্টটল সুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেন : একটা টাকা আর একটা টাকার জন্মদান করতে পারে না। [17] মনীষী প্লেটোও সুদকে সমর্থন করেন নি। [18] মনীষী পেটাস বলেন, ‘‘অর্থ হল বন্ধ্যা এবং এর উপর সুদ ধার্য্য করা অযৌক্তিক। [19]

সুদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসা কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্য্যাদির মাঝে যাবতীয় অসৎ কাজের ভেতর সুদকে সবচেয়ে গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য করেছেন। মূলত সুদের মতো সমাজ বিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর নেই। [20] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদের ব্যাপারে এতই কঠোর ছিলেন যে তিনি বলেন, ‘সুদখোর সুদ দাতা এর লেখক ও সাক্ষী অভিশপ্ত। তারা সকলেই এক পর্যায়ভূক্ত।[21]

জুলুম-শোষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা

স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে শোষণ ও জুলুম বড় অন্তরায়। ইসলাম অর্থনৈতিকভাবে শোষণের হাত থেকে মানবতাকে রক্ষার জন্য সুদ ছাড়াও শোষণের অন্যান্য পথ ও প্রস্থা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা জুয়া, লটারী নিষিদ্ধ করে এরশাদ করেন: “মদ, জুয়া, মূর্তিপুজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্ত্ত, শয়তানের কার্য। সুতারং তোমরা উহা বর্জন কর।[22] ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ওজনে কম দেয়া এক প্রকার জুলুম। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে এরশাদ হচ্ছে: “মাপ পূর্ণ কর এবং যারা পরিমাপে কম দেয়, তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়োনা।[23]

শোষণ ও জুলুমের একটি বড় হাতিয়ার মজুদদারী, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজুদদারকে অভিসপ্ত ঘোষণা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আমদানি কারক রিযিকপ্রাপ্ত, মজুদদার অভসপ্ত।[24]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তিচল্লিশদিন খাদ্য দ্রব্য মজুদ করে রাখবে সে আল্লাহ তায়ালা থেকে সম্পর্ক মুক্ত।[25]

এছাড়াও ইসলাম ঘুষ, রিসওয়াহ, অশ্লীল দ্রব্যের ব্যবসা ও মানুষ শোষণ ও জুলুমের শিকার হয় এমন সর্বপ্রকার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন যে, এসব উপায়ে আর্থিক লেনদেনের ফলে সামাজের একদল লোক অন্যায়ভাবে জাতীয় অর্থের বিরাট অংশ লুটে নিচ্ছে আর ব্যাপক জনগোষ্ঠী নির্মমভাবে শোষিত হচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সবের মাধ্যমে সৃষ্ট শোষণ ও জুলুমের সকল পন্থা বন্ধ করেছেন।

যাকাত ভিক্তিক অর্থ ব্যবস্থার প্রবর্তন

যাকাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র দূর করা। এতে শুধু ব্যক্তি বা সমাজই নয় রাষ্ট্রও সমানভাবে উপকৃত হয়। দারিদ্র মানবতার এক নম্বর শত্রু। যে কোন দেশের ও সমাজের জন্য এটা একটি জটিল সমস্যা। দারিদ্রের ফলে সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। পরিণামে দেখা দেয় মারাত্মক সামাজিক সংঘাত। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধ ঘটে দারিদ্রের জন্য। এ সকল সমস্যার সমাধানকল্পে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যাকাতের বিধান প্রাপ্ত হন।

যাকাত আল্লাহ তা‘আলার হুকুম এবং অন্যতম মৌলিক ফরয। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মুল স্তম্ভ [26] ও ইসলামী  রাষ্ট্রের রাজস্বের অন্যতম উৎস। এটি একটি সমাজকল্যাণ মূলক বিধান। [27] আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি কর্তৃক কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে তার কোন নির্দিষ্ট মালের নির্ধারিত অংশের স্বত্ব অর্পন করাকে যাকাত বলা হয়। পবিত্র কুরআনে বিরাশি স্থানে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। [28] সাধারণত মানুষের ধারণা যাকাত প্রদান করলে সম্পদ কমে যায় অথচ আল্লাহ তাওয়ালা এরশাদ করেন: “মানুষের ধনে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদে যা দিয়ে থাক, আল্লাহর দৃষ্টিতে তাহা ধন সম্পদ বৃদ্ধি করে না, কিন্তু আল্লাহর সমত্তষ্টি লাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাক তা বৃদ্ধি পায়, উহারাই (যাকাত সাদকা প্রদানকারী) সমৃদ্ধিশালী।[29]

যাকাত ব্যবস্থাকে আল্লাহ তাওয়ালা সম্পদাধিকারীর সম্পদের পবিত্রতা এবং তাদের জন্য আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের এক মহামাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যাকাত দানের ফলে যাকাত দাতার অবশিষ্ট ধন ও সেই সঙ্গে তার আত্মার ও পরিশুদ্ধি ঘটে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন: “তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্তনা স্বরপ।[30] যাকাত আদায় ও তার যথাযথ ব্যবহার সমাজে আয় ও সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বলিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনিদিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভূক্ত। এদের মধ্য রয়েছে গরীব, মিসকীন, ঋণগ্রস্থ, মুসাফির এবং ক্ষেত্র বিশেষে নও মুসলিম। কিন্তু বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলক ভাবে যাকাত আদায় করা হয়না এবং তা বিলি বন্টেনেরও ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অথচ যাকাতের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পূর্ণবাসন সম্ভব। কেননা যাকাত স্থায়ীভাবে দারিদ্র বিমোচনের একটি স্থায়ী পদ্ধতি। যাকাতের মাধ্যমে সমাজ থেকে দারিদ্র দূরিকরণের ব্যাপারে ফিকহবিদগণ দ্ব্যর্থহীন মত প্রকাশ করেছেন। দরিদ্র ব্যক্তি যাতে দ্বিতীয়বার যাকাতের অর্থের মুখাপেক্ষী না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় বিধান প্রয়োগের জন্য ফকীহগণ তাকিদ প্রদান করছেন। ইমাম নববী (রঃ) বলেছেন, ফকীর, মিসকীনকে এতটুকু পরিমাণ সম্পদ দিতে হবে যাতে তারা তাদের অভাবের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এবং ধনী ব্যক্তিতে উপনীত হয়। ‘‘ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এ মত সমর্থন করেন।[31]

তার সমর্থক, ফকীহগণ শিল্প ব্যবসায়ে নিয়োজিত প্রার্থীগণকে তাদের স্ব-স্ব কাজে (কুটির শিল্প, কৃষিকাজ, দোকান, দরজীরকাজ, কাঠের কাজ প্রভৃতি) স্বনির্ভর হওয়ার উপযুক্ত পরিমাণ যাকাতের অর্থ প্রদানের কথা বলেছেন। ইমাম মালিক (রঃ) ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রঃ) এবং অন্যান্য ফকীহর মত হলো যে, প্রার্থী ফকির মিসকীনকে নিজসহ পরিবার পরিজনের এক বছরের ভরণ পোষণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ যাকাত দিতে হবে।

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যখন তোমরা ফকির মিসকীনকে কিছু দেবে, তখন তাকে ধনী বানিয়ে দেবে।[32] মূলত যাকাত অভাবী মানুষকে স্বনির্ভর এবং দ্বিতীয়বার যাকাত প্রার্থী না হবার অবস্থায় আনয়ন করতে চায়। একটি বছর স্বচ্ছলভাবে চলার অবলম্বন পাবার পর স্বাবলম্বী হতে আগ্রহী প্রতিটি ব্যক্তিই স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বায়তুল মাল

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বায়তুল মালও প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বায়তুল জনকল্যাণ এবং মৌলিক চাহিদা পূরণ সংক্রান্ত কাজ করত। [33] যা দারিদ্র বিমোচন করে স্বনির্ভরতা অর্জনে সুদুর প্রসারী ভূমিকা রাখে।

বর্তমান বিরাজিত অর্থব্যবস্থা যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষে নানা নামে ও চটকদার শ্লোগানে গড়ে উঠেছে এন.জি.ও বিভিণ্ণ প্রকার সাহায্য সংস্থা। যারা দুঃস্থ, অভাবী, অসহায় মানুষকে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে সুদের উপর ঋণ প্রদান করছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিবর্তে পরনির্ভরশীলতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ ইসলাম স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে যে বাস্তব শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করলে দরিদ্র অভাবীও অসহায় মানুষ অতি সহজে স্বনির্ভর জীবন যাপন করতে পারে। মূলত ইসলাম রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রাধীন ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা, সুদ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে রহিত করণ, যাকাত ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক, মীরাসী আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে।

পুঁজিকে উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজে না লাগায়ে অসল ফেলে রাখা, কর্মক্ষম ব্যক্তি কর্মহীন সময় কাটানোর বিরোধীতা করছে, অপব্যয় নিষেধও মিতবায়ী হতে উৎসাহদান, পতিত জমি আবাদের ব্যবস্থা, দানশীলতা, ভিক্ষুকের হাতকে কর্মের হাতে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের দিক নির্দেশনা প্রদান করছে। এ ক্ষেত্রে জাতিগত স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য সর্বস্তরের মানুষের এ সংক্রান্ত ইসলামী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। ‘‘স্বনির্ভরতা অর্জনে ইসলামঃ একটি পর্যালোচনা’’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে । মানব কল্যাণে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস সামান্যতম কাজে লাগলে ও আমার শ্রম স্বার্থক হবে।

আমিন!!

পর্বঃ ১ | পর্বঃ ২


[1] . আল-কুরআন ৫১: ১৯।
[2] . সহীহ মুসলিম, কিতাবুল, ইলম হাদীস নং ৪৮৩০।
[3] . মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক, কিতাবুল মাগাযী, দারুত তুরাস আল ইসলামী, বৈরুত, খৃ. ১৯৯০, পৃ. ৩০৯।
[4] . মুহাম্মদ ইবনু উমর আল-ওয়াকেদী, কিতাবুল মাগাযী, লন্ডন, খৃ. ১৯৬৬, খ. ২, পৃ.-১৫৪।
[5] . আবুল হাসান আল-বালাজুরী, ফতহুল বুলদান, দারু মাকতাবাতিল হিলাল, বৈরুত, খৃ. ১৯৮৮, পৃ.-২৯।
[6] . শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতিঃ নির্বাচিত প্রবন্ধ, স্কয়ার পাবলিকেশন, রাজশাহী, খৃ. ১৯৯৬, পৃ. ১৬-১৭।
[7] . আল-কুরআন ১৭: ২৬।
[8] . আল-কুরআন ১৭: ২৭।
[9] . আল-কুরআন ২৫: ৬৭।
[10] . আল-কুরআন ২৮: ৭৭।
[11] . ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, ইফাবা, ঢাকা, খৃ. ১৯৮৪, সংস্ক. ৪, পৃ.-১৩৮।
[12] . শামছূল আলম , ইসলামী রাষ্ট্র, ইফাবা, ঢাকা, খৃ. ১৯৯৫, সংস্ক, ৩ পৃ.- ১১৬।
[13] . মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ৮২৫০।
[14] . সহীহুল বুখারী, কিতাবুল বুয়ু’, হাদীস নং ২০৭৫।
[15] . মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন, সুদ, সমাজ, অর্থনীতি, ইসলামিক ইকনমিকস রিচার্স ব্যুরো, ঢাকা খৃ. ১৯৯২, সংস্ক. ১, পৃ. ১৯
[16] . মুফতী মুহাম্মদ শফী, ইসলামের অর্থ বন্টন ব্যবস্থা, অনু. ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, ইফাবা, ঢাকা, খৃ. ১৯৮৩, পৃ.- ২৪।
[17] . Aristotol’s polities, London. ১৯৮৭ চ. ২৩
[18] . Plato, Law’s Book, V. London. ১৯৯০
[19] . Boom Bowark, Capital and Interest. London. 1999. Vol. 1. P. ১০-১১
[20] . শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামী অর্থনীতি, নির্বাচিত প্রবন্ধ, স্কয়ার পাবলিকেশন , রাজশাহী, খৃ. ১৯৯৬, পৃ. ৫১
[21] . সহীহ মুসলিম, কিতাবুল বুয়ু,’ হাদীস নং ১১২৭
[22] . আল-কুরআন ৫: ৯০
[23] . আল-কুরআন ২৬: ১৮১
[24] . বুরহান উদ্দিন, আল-হিদায়া, জাকারিয়া কুতুবখনা, যশহর, পৃ. ৪৫৪।
[25]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪।
[26] . Zohurul Islam. Islamic Economics. IFB. 1997. 1st ED. Page-183
[27] . Salem Azzam. Islam and Contemporary Socicty. Islamic Council of Europe. ১৯৮২. Page-102
[28] .মুহাম্মদ মুসা, যাকাতের তাৎপর্য ও বিধান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, জুলাই সেপ্টেম্বর, খৃ. ১৯৯৬, পৃ. ৫০।
[29] . আল-কুরআন ৩০: ৩৯।
[30] . আল-কুরআন ৯: ১০৩।
[31] . ড. মাহমুদ আহমাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা,  ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, পূ-৩
[32] . প্রাগুক্ত, পৃ.- ৪।
[33] . সাইয়্যেদ হাসান মুসান্না নদভী, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা, ইফাবা, ঢাকা, খৃ. ১৯৮৩, পৃ.- ৩০।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন