কিভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায়? পর্ব ১৯

3
3470

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

শুধু তোমারই ইবাদত করি

ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন, আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা ১০৪ টি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। সেই সবগুলো কিতাবের সারাংশ হল কুরআন, আর সম্পূর্ণ কুরআনের সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় সুরা ফাতিহায়। আর সম্পূর্ণ সুরা ফাতিহার সারাংশ হল এই আয়াতঃ “আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” [সুরা ফাতিহা:৪]

আল্লাহর রহমত ও সর্বময় পরম ক্ষমতার বিষয়ে জানার পর, এবং তারই কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেকথা উপলব্ধি করার পর, এই আয়াত টি আমাদের জানিয়ে দেয় আমাদের এই পৃথিবীতে কি করণীও, আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি- শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা আর এই কাজেও তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করা।

 ইবাদতের আন্তরিকতা ও সততা

অন্তরের ইবাদতের একটা অংশ হল শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। মহানবী (সাঃ) বলেন: “মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি সমস্ত অংশীদারদের চাইতে অংশীদারি (শিরক)থেকে অধিক অমুখাপেক্ষী। কেউ যদি এমন কাজ করে, যাতে সে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করে, তাহলে আমি তাকে তার অংশীদারী (শিরক) সহ বর্জন করি’(অর্থাৎ তার আমল্ল নষ্ট করে দেই)।” [বুখারী ২৯৮৫]

আমরা যখন বলি ইয়্যাকা নাবুদু বা আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, তখন আমরা আমাদের ‘ইখলাস’ বা ইবাদতের সততা ও আন্তরিকতার ঘোষণা দেই, এবং নিজেদেরও সেকথা স্মরণ করাই। কাজেই আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিৎ- আমরা যখন কোন ভাল কাজ করি, আমরা কি অন্যদের কাছ থেকে কোন রকম প্রশংসা বা বাহবা আশা করি? আমরা যদি তা না পাই, তাহলে কি মনে মনে কষ্ট পাই বা হতাশ হই? যদি হই তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের সেই ‘ভাল কাজটি’ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছিল না, পাশাপাশি অন্যের জন্যও ছিল। ইবনে কাইয়্যিম বলেছিলেন, এর প্রতিকার হল, এটা বোঝা ও আত্মস্থ করা যে- কারও প্রশংসা আমাদের কোনরকম উপকার করতে পারবে না, কারও নিন্দাও আমাদের কোনরকম ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন, যদি সবাই ভাবে যে আমরা সত্যবাদী, কিন্তু আল্লাহর কাছে আমরা আসলে তার উল্টোটা, সেই ‘সবাই’ কি আমাদের কোন উপকারে আসবে? অথবা কোন ধনী লোকের ব্যপারে যদি সবাই বলে বেড়ায় যে ‘সে ঋণগ্রস্ত, সে আসলে ধনী নয়’, তাহলে কি এতে ঐ ধনী ব্যক্তির সম্পদের কোন ঘাটতি হয়ে যাবে?

উপরন্তু, আমাদের এটা মনে রাখা উচিৎ যে, অন্যরা যদি এটা বুঝতে পারে যে আমরা অন্যের প্রশংসা পাওয়ার জন্য কোন নেক কাজ করছি, তাহলে তারাও আমাদের ব্যপারে মন্দ ধারনাই পোষণ করবে। তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের মনের এই অবস্থা গোপন করব, যখন আমরা অন্যেরা কি ভাববে এটা নিয়েই বেশী চিন্তিত থাকি; অথচ যিনি আমাদের অন্তরের সব খবর জানেন তার ব্যপারেই আমরা গাফেল থাকি?  এই লোক দেখানো আমলই হল ‘রিয়া’।

সবচেয়ে জঘন্য রিয়া হল সেটা যেটাতে মিথ্যাও মিশ্রিত থাকে, যেমন এমন কোন লোক যে এমন আমলের জন্য মানুষের কাছে প্রশংসিত হতে চায় যা সে আসলে করেইনি। আল্লাহ বলেনঃ“যারা স্বীয় কৃতকর্মে কর্মে সন্তুষ্ট এবং যা করেনি তজ্জন্যে প্রশংসা প্রার্থী, এরূপ লোকদের সম্বন্ধে ধারনা করোনা যে, তারা শাস্তি হতে বিমুক্ত বরং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সুরা আল ইমরানঃ১৮৮]

রিয়ার প্রতিকার কি? সবসময়, বারবার নিজেদের নিয়তের ব্যপারে নিজেকে প্রশ্ন করা এবং নিজেকে সংশোধনের সঙ্কল্প করা। আমরা যদি অনেক আমল জনসম্মুখে করি, তাহলে তার সমান অথবা তার চেয়ে বেশী আমল গোপনে কাউকে না বলে করার চেষ্টা করতে হবে। এটা হল এই আয়াতের সারাংশ, এবং এইজন্য আমরা প্রতিদিন এটা পড়িঃ ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা’ঈনআমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

গোপন রিয়া

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শৈশব থেকেই আমাদের ভেতর রিয়ার বীজ বপন করা হয়ে থাকে। কিভাবে? আমাদের বলা হয়, ‘এমন করো না, লোকে কি বলবে?’ অথবা বলা হয়, ‘অমন করো না, তুমি কি চাও লোকে তোমাকে বলুক তুমি আদব কায়দা জান না?’। অথচ বলা উচিৎ ছিল- এটা বা ওটা করোনা কারণ আল্লাহ দেখছেন। কাজেই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমরা বেড়ে উঠেছি রিয়ার মধ্য দিয়েই। লোকজনের অনুপস্থিতিতে আমরা অনেক কিছুই করে ফেলতে পারি, কারণ কেউ তো দেখছে না! এভাবে আমরা আল্লাহর সামনে লজ্জা বোধ করার চেয়ে মানুষের সামনে বেশী লজ্জা বোধ করি।

এই গোপন রিয়া আমাদের অন্তরের গভীরে এত দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে যে, যখন আমরা নির্জনে ইবাদত করি বা নির্জনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করি, তখনও অজান্তেই রিয়া করে ফেলি। কিভাবে? পরবর্তীতে নিজের এমন কাজের জন্য নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে বা এমন আশা করে করে যে – কেউ যদি দেখত তাহলে আমাদের কেমন ভাবত! অথবা, আমরা যখন নিজেদের মহান মৃত্যুর কথা কল্পনা করি যেমন, সেজদারত অবস্থায় মৃত্যু, তখন আরও যদি ভাবি এমন ভাবে মৃত্যু হলে লোকে কি কি ভাল কথা বলাবলি করবে, এমনটি না ভেবে যে আল্লাহর সাথে এমন ভাবে সাক্ষাত হলে কেমন হবে।

আমাদের অন্তরের এমন অবস্থায় আমাদের উচিৎ এই আয়াতটি বেশী বেশী পড়ে অন্তরকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করা, আমাদের নিয়তের ব্যপারে সজাগ থাকা, এবং ইবাদতের সততার গুরুত্ব অনুধাবন করা।

নরম অন্তরের মানুষেরা

যারা সত্যিকার অর্থে এই সুরা ও এই আয়াতের মর্ম বুঝেছেন তাদের উপর এটি সুগভীর প্রভাব ফেলে। মুযাহিম বিন জাফর এর সূত্রে, সুফিয়ান আস-সাওরি নামক একজন মহান তাবি’ই (মহানবী (সাঃ) এর পরের প্রজন্মের মানুষ) একদিন মাগরিব নামজের ইমামতি করছিলেন। তিনি যখন সুরা ফাতিহার এই আয়াতে এসে পৌঁছলেন, তিনি এমন ভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন যে তিনি আর পরবর্তী আয়াত তেলাওয়াত করতে পারছিলেন না। তারপর তিনি আবার প্রথম থেকে এই সুরা পড়া শুরু করলেন।

মোহাম্মদ আল হিমসি বর্ণনা করেছেন  ইবনে আবি আল হাওয়ার নামক আরেকজন সালাফ (সঠিক পথের অনুসারী প্রথম দিকের সত্যনিষ্ঠ মুসলিম) এর কথা, যিনি কাবা শরীফে ঈশার নামাজ পড়ছিলেন। যখন তিনি এই আয়াতে আসলেন “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা’ঈন” তিনি এর পরে আর পড়তে পারছিলেন না, তিনি ভীষণ কাঁদতে লাগলেন। এটা দেখে আল হিমসি তার কাবা ঘর তাওয়াফ করা চালিয়ে গেলেন, এবং যখন তিনি আবার ঘুরতে ঘুরতে আল হাওয়ারির কাছে আসলেন, দেখলেন তিনি তখনও ঐ আয়াতটিই তেলাওয়াত করছেন।

আপনার কি ধারণা তারা অতীতের লোক ছিলেন বলেই এমন করে অনুভব করতে পারতেন? তাহলে এই ভিডিওটি দেখুন।

এটা ছিল শায়খ সউদ আল-সুরাইমের প্রথম বছর যে বছর তিনি পুরো রমজান মাসে তারাবী নামাজের তেলাওয়াত করেন। সাধারণত সেখানে সবচেয়ে বেশী ভিড় থাকে ২৭ রমজানে (লায়লাতুল কদরের আশায়) এবং ২৯ রমজানে কারণ সেদিন কুরআন তেয়ালাওাত খতম দেওয়া হয়। যাই হোক, বিশেষ করে সেই বছর ২৭ রমজানে কুরআন তেলাওয়াত খতম করা হয়েছিল- একারনে মানুষের উপস্থিতি সেদিন এত বেশী হয়েছিল যে তা বিচার দিবসের কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত এ কারনেই শায়খ এত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যখন তিনি তেলাওয়াত করছিলেন – ‘মালিকি ইয়াও মিদ্দীন’ (প্রতিফল দিবসের মালিক)।

শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি – বিনম্রতা

আন্তরিকতা ও সততা হল সেই উপকরণ যার কারনে আমরা নামাজ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে পারি; আর আমরা সত্যিকার অর্থে আন্তরিকও হতে পারব না যদি আল্লাহর কাছে সাহায্য না চাই। একারনে আল্লাহ আমাদেরকে ‘শুধু তোমারই ইবাদত করি’ বলার পরপরই শিখিয়েছেন ‘শুধুমাত্র তোমার সাহায্য প্রার্থনা করি’। হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন: “তোমাদের সকলের জন্য রয়েছে ধ্বংস তাদের ছাড়া যাদের আমি সাহায্য করি, অতএব আমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং আমিই তোমাদের সাহায্য করব।” একারনে পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন- “আমাদের সরলতম পথ দেখাও।[সুরা ফাতিহা:৫]

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ কেমন নিখুঁত ভাবে তার কালাম গুলো সাজিয়েছেন!

ইবনে আল কাইয়্যিম বলেছেন তিনি ইবনে তাইয়মিয়্যাকে বলতে শুনেছেন, ‘ইয়্যাকা না’বুদু’ এবং ‘ইয়্যাকা নাসতা’ঈন’ বা ‘শুধুমাত্র তোমারই বন্দেগী করি’ ও ‘শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’  কথা দুটি মানুষের অহংকার ও দম্ভকে দূর করে দেয়। আমরা যখন বলি ‘আমরা তোমারই সাহায্য চাই’ তখন আমরা স্বীকার করে নেই যে আমাদের সেই ক্ষমতাটি নেই যে আমরা নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করতে পারব এবং আমাদের সকল বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন। আমরা প্রায়ই এমন কথা শুনি বা বলি যে ‘কেউ এত অহঙ্কারী যে কারও কাছে হাত পাতে না’, এমন লোক নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচু মনে করে বা নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারে বলে মনে করে। অপরদিকে এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা স্বীকার করছি যে আমরা অক্ষম, তাই সেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যিনি কারও মুখাপেক্ষী নন।

আল্লাহ যেন আমাদের সততা, আন্তরিকতা ও বিনম্রতার সাথে তাঁরই ইবাদত করতে সাহায্য করেন।
আমীন!!

অন্যান্য পর্ব গুলো এই লিংক থেকে  পড়ুনঃ

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

3 COMMENTS

আপনার মন্তব্য লিখুন