Home Blog Page 3

সহনশীলতা [ আপনার অন্তরের অবস্থা পরিবর্তন করুন ]

লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর

১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা

  • আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও দয়া: তিনি বলেন: “তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন?[সুরা আন-নুর, ২৪ : ২২]
  • আল্লাহ তাআলা আপনার হৃদয়ের স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণ করছেন, এতটুকুই আপনার জন্য যথেষ্ট।
  • নফসের ওপর বিজয় লাভ করা এবং তার ওপর কঠোর হওয়া। যে বান্দাই নফসের ওপর কঠোর হয়, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সদয় হন। আর যে আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন ৷
  • বড় বড় কাজের জন্য নিজেকে অবসর করে নেওয়া। তুচ্ছ কোনো বিষয়ের সামনে দাঁড়ানোর জন্য বড়দের হাতে কোনো সময় থাকে না।
  • একতা, প্রতিভা এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করা।
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত প্রাপ্তির মাধ্যমে নিজেকে সফল করা।

নবিজি (সা:) বলেন: যে ব্যক্তি তার রাগ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সংযত থাকে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকল সৃষ্টিকুলের মধ্য হতে ডেকে নেবেন এবং তাকে হুরদের মধ্য থেকে তার পছন্দমতো যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেবেন।‘ [সুনানু আবি দাউদ: ৪৭৭৭, সুনানুত তিরমিজি: ২৪৯৩ ]

  • সহনশীলতা ব্যক্তির শক্তিশালী ইচ্ছার প্রমাণ:

নবিজি (সা:) বলেন: প্রকৃত বীর সে নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।‘ [সহিহুল বুখারি: ৬১১৪, সহিহু মুসলিম: ২৬০৯]

  • সনহশীলতা হলো বিপক্ষীয় লোকদেরকে হাতে আনা এবং তাদেরকে বন্ধুতে পরিণত করার সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম।

আল্লাহ তাআলা বলেন:জবাবে তা-ই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন, আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধু।” [সুরা ফুসসিলাত, ৪১ : ৩৪]

সুতরাং নিজেকে নিয়ে ফিকির করার সময় বের করতে হবে এবং নিজের আত্মশুদ্ধির কাজ করতে হবে।

  • মানসিক স্থিরতা লাভ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাও দূর হয়ে যাওয়া। কারণ, হৃদয় তখন ভর্ৎসনা ও ধিক্কার থেকে নিরাপদ থাকে।
  • সহনশীল হওয়া অনেক রোগের চিকিৎসা, যেমন : মিথ্যা, কৃপণতা, রাগ, ভীরুতা, ভয় ও উৎকণ্ঠা।
  • ভালোবাসা বাকি থাকা। যাকে বেশি ভর্ৎসনা করা হয়, তার সঙ্গী কমে যায়।

২. কুরআনের আলো

 

ক্ষমা করুন, সৎকাজের আদেশ করুন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন।” [সুরা আল-আরাফ, ৭ : ১৯৯]

‘ক্ষমা করুন’ বলে নবিজি (সা:)-কে উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে আদেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আপনি মানুষের সাথে লেনদেন ও আচরণে সহজতা অবলম্বন করুন। ইবনে কাসির (রা:) বলেন, ‘এটিই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কথা। এ ব্যাপারে রাসুল (সা:)-এর উদ্দেশে বলা জিবরাইল (রা:)-এর এ কথাও সাক্ষ্য বহন করে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আপনাকে যে আপনার প্রতি জুলুম করে, তাকে ক্ষমা করার আদেশ করেছেন; যে আপনাকে বঞ্চিত করেছে, তাকে দান করার এবং যে আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার আদেশ করেছেন।’

‘সৎ কাজের আদেশ করুন।’ অর্থাৎ সৎ কাজ এবং কথা ও কাজের সর্বোত্তম বিষয়ের ব্যাপারে আদেশ করুন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন।’ অর্থাৎ মূর্খদের মোকাবিলা তাদের অনুরূপ কাজের মাধ্যমে করবেন না; বরং আপনি তাদের ব্যাপারে সহনশীল হোন। কুরতুবি (রা:) বলেন, ‘যদিও এখানে নবিজি -কে আদেশ করা হয়েছে; কিন্তু এটি সকল মানুষের জন্য শিক্ষা।

৩. রাসুল (সা:) আমাদের আদর্শ

রাসুল (সা:) পুরো সমাজের পক্ষ থেকেই বিভিন্ন গালিগালাজের সম্মুখীন হয়েছেন। কবিরা তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিল, কুরাইশ সর্দাররা তাঁকে নিয়ে উপহাস করেছিল এবং অজ্ঞরা তাঁকে পাথর নিক্ষেপ করেছিল। তারা বলেছিল, তিনি জাদুকর, পাগল ইত্যাদি। কিন্তু রাসুল (সা:) উদারতা, ক্ষমা, সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যারা তাঁকে উপেক্ষা করেছিল এবং কষ্ট দিয়েছিল, তাদের জন্য তিনি হিদায়াতের দুআ করেছিলেন। তাদের জন্য ক্ষমা ও রহমতের দুআ করেছিলেন।

বেদুইনকে তাঁর ক্ষমা করে দেওয়ার একটি দৃষ্টান্ত: এক বেদুইন নবিজি (সা:)-এর কাছে এসে অনেক রূঢ় আচরণ করল। সে খুব কঠিনভাবে নবিজি (সা:)-এর চাদর টানতে লাগল। এমনকি এতে তাঁর ঘাড়ে দাগও পড়ে গেল। বেদুইন লোকটি চিৎকার করে বলতে লাগল, “আল্লাহ তাআলা তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, তা থেকে আমাকে কিছু দান করতে আদেশ করো।’ নবিজি (সা:) মুচকি হাসির মাধ্যমে তার উত্তর দিয়েছিলেন। তাঁর পাশে থাকা সাহাবিগণ বেদুইন লোকটির এ কাণ্ড দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। কিন্তু তাঁরা অবাক হয়েছিল নবিজি (সা:)-এর মুচকি হাসি ও লোকটিকে ক্ষমা করে দেওয়া দেখে। সব শেষে নবিজি (সা:) তাঁর সাথিদের আদেশ করলেন, তাঁরা যেন এই লোকটিকে মুসলিমদের বাইতুল মাল থেকে কিছু দিয়ে দেয়।

৪. অমূল্য বাণী

  • ইবনুল কাইয়িম (রা:) বলেন, ‘মাখলুক সহনশীল হয় অজ্ঞতার কারণে এবং ক্ষমা করে দুর্বলতার কারণে। আর আল্লাহ তাআলা সহনশীল তাঁর পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও এবং ক্ষমা করেন পূর্ণ সক্ষমতা সত্ত্বেও। ইলমের সাথে সনহশীলতা এবং সক্ষমতার সাথে ক্ষমার সম্পর্কের চেয়ে সুন্দর কোনো সম্পর্ক নেই।

এ জন্যই পেরেশানি থেকে মুক্তির দুআয় আল্লাহ তাআলার গুণ হিসেবে সহনশীলতার সাথে মহত্ত্বের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার সত্তাগত আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যের একটি হলো সহনশীলতা।

  • আহনাফ (রা:) বলেন, ‘তোমরা ইতর লোকদের মতামতের ব্যাপারে সতর্ক থেকো।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করল, “ইতর লোকদের মতামত কী?’ তিনি বললেন, ‘যারা ক্ষমা ও উপেক্ষাকে লজ্জাজনক মনে করে।’
  • আহনাফ (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার সাথে যে-ই শত্রুতা করে, আমি তার ব্যাপারে তিনটি বৈশিষ্ট্যের যেকোনো একটি গ্রহণ করি: যদি সে আমার চেয়ে উত্তম হয়, আমি তার মর্যাদা বুঝতে পারি। আর যদি সে আমার চেয়ে অনুত্তম কেউ হয়, তাহলে তার থেকে আমার মর্যাদাকে উঁচু করে রাখি। আর যদি আমার সমপর্যায়ের কেউ হয়, তাহলে তার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করি।’
  • আবু বকর বিন আব্দুল্লাহ (রা:) বলেন, ‘জাহান্নামের আগুনের কথা স্মরণ করে ক্রোধের আগুনকে নির্বাপিত করো।’

৫. কিছু চমৎকার কাহিনি

  • ইবনে আব্বাস (রা:) কে জনৈক লোক গালি দিয়েছিল। যখন তাকে হত্যার ফয়সালা করা হলো, তখন তিনি বললেন, “হে ইকরামা, দেখো তো, লোকটির কোনো প্রয়োজন বাকি রয়েছে কি না, যা আমরা পুরো করে দেবো?’ লোকটি এ কথা শুনে মাথা নত করে ফেলল এবং লজ্জিত হলো।
  • মুআবিয়া (রা:) -কে জনৈক লোক অনেক কঠিন কথা বলল। তখন তাঁকে বলা হলো, ‘যদি আপনি তাকে শাস্তি দিতেন!’ তিনি বললেন, ‘আমি লজ্জাবোধ করি যে, আমার কোনো প্রজার অন্যায়ের কারণে আমার সহনশীলতা সংকীর্ণ হয়ে পড়ক।’
  • আবু জার (রা:) -এর এক গোলাম বকরির একটি পা ভেঙে তাঁর কাছে আসলো। তিনি বললেন, ‘এটির পা ভাঙল কে?’ সে বলল, ‘আমি আপনাকে রাগান্বিত করার জন্য ইচ্ছাকৃত এমনটি করেছি। যেন আপনি আমাকে প্রহার করে রাগান্বিত হন।’ তিনি বললেন, ‘আমাকে রাগাবার প্রতি তোমার এত আগ্রহ দেখে অবশ্যই আমি রাগ হয়েছি।’ এরপর তিনি তাকে আজাদ করে দেন।
  • জনৈক লোক আদি বিন হাতিম (রা:)-কে গালি দিলে তিনি চুপ থাকলেন। অতঃপর লোকটি তার কথা শেষ করলে তিনি বললেন, ‘যদি তোমার বলার মতো আর কিছু বাকি থাকে, তাহলে এলাকার যুবকরা আসার আগেই বলে ফেলো। কারণ, যদি তারা দেখে যে, তুমি তাদের সর্দারের ব্যাপারে এসব বলছ, তাহলে তারা অসন্তুষ্ট হবে।’
  • জনৈক লোক আলি বিন হুসাইন (রা:) -এর সামনে এসে তাকে গালি দিল। ফলে আলি বিন হুসাইনের গোলাম তার দিকে লাফিয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও।’ এরপর লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের ব্যাপারে তোমার মাঝে যা লুকিয়ে আছে, তা আরও বেশি। তোমার কি কোনো প্রয়োজন আছে, যা পূর্ণ করে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ এ কথা শুনে লোকটি বেশ লজ্জিত হলো। তিনি নিজের গায়ের একটি কালো কাপড় খুলে রাখলেন এবং তাকে এক দিরহাম দিয়ে দেওয়ার আদেশ করলেন। এরপর লোকটি বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আওলাদে রাসুল।’
  • আবু দারদা (রা:)-এর জনৈক বাঁদি তাঁকে বলল, ‘আমি এক বছর আগ থেকে আপনাকে বিষ পান করিয়েছিলাম; কিন্তু তা আপনার মাঝে কোনো ক্রিয়া করেনি।’ তিনি বললেন, “তুমি কেন এমনটি করেছিলে?’ সে বলল, ‘আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘যাও, আল্লাহর জন্য তুমি মুক্ত।’
  • ইমাম জুহরি (রা:) বলেন, ‘আমি কোনো গোলামকে “আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুক” এ কথা বললেই সে আজাদ।
  • মুআবিয়া (রা:) একটি পশমি বস্ত্র ভাগ করে দামেস্কের জনৈক বৃদ্ধকে তার একটি টুকরো দিলেন। কিন্তু এটি তার পছন্দ হলো না। তাই সে কসম করে বলল, এটি দিয়ে সে মুআবিয়ার মাথায় আঘাত করবে। সে মুআবিয়া (রা:)-এর কাছে এসে নিজের কসমের কথা বর্ণনা করল। মুআবিয়া (রা:) তাকে বললেন, ‘আমি আপনার কসম পুরা করে দেবো; তবুও যেন এক বৃদ্ধ আরেক বৃদ্ধের ওপর সদয় হয়।’

৬. রমাদানে সহনশীলতা

রাসুল (সা:) বলেন: যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে লড়াই (ঝগড়া) করে, তাহলে সে যেন বলে, “আমি রোজাদার।‘ [সহিহুল বুখারি: ১৯০৪]

সহনশীলতা ও ক্ষমা রমাদানের সবচেয়ে সুন্দর চরিত্র। কারণ, এটি তো ক্ষমা ও দয়ারই মাস। যা বান্দাকে তার প্রতি জুলুম বা অন্যায়কারীকে ক্ষমা করতে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং শক্তি থাকা সত্ত্বেও অন্যকে শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। আশা রাখতে হবে যে, সে অন্যকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহ তাআলাও তার সাথে অনুরূপ আচরণ করবেন। আর সাথে সাথে এ কথা স্মরণ রাখবে: “তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেন?” [সুরা আন-নুর, ২৪ : ২২]

৭. সহনশীলতার সূর্য ডুবে গেছে

ফলে মানুষ তাদের রোজাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে:

  • গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে নিজেদের ক্রোধের মাধ্যমে।
  • অধিকার অর্জনে ক্রোধের মাধ্যমে।
  • সরকারি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করে।
  • পরস্পর ঝগড়া করে, যার সমাপ্তি হয়েছে গালি ও তর্কের মাধ্যমে।
  • স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মতানৈক্যের মাধ্যমে, যা অনেক বড় বিবাদে গড়িয়েছে এবং একে অপরকে পরিত্যাগ করেছে।

৮. দুআ

  • হে আল্লাহ, আমাকে সহনশীলতা ও ধৈর্যধারণের শক্তি দান করুন এবং এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদের প্রতি অজ্ঞতাসুলভ আচরণ করা হলে তারা সবর করে। এবং আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদেরকে অজ্ঞরা সম্বোধন করলে তারা বলে, ‘সালাম।’
  • হে আল্লাহ, যে লোকই আমাকে গালি দিয়েছে, আমাকে কষ্ট দিয়েছে অথবা আমার থেকে কষ্ট পেয়েছে, তাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম; আপনিও তাকে ক্ষমা করে দিন।
  • হে আল্লাহ, আমি আপনার বান্দাদের ক্ষমা করে দিলাম; তাই আমার জন্য এমন কোনো পথ বের করে দিন, যার কারণে আপনার বান্দারা আমাকে ক্ষমা করে দেবে।

৯. স্বার্থপর হবেন না

  • কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
  • এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।

১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন আমল দেখার বিষয়

  • ক্রোধ যখন আপনাকে পেয়ে বসবে, সাথে সাথে আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। আর বলবেন যে, ‘আমি রোজাদার, আমি রোজাদার।’
  • নিজের ব্যক্তিগত কারণে কারও থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন না। বরং যখন কাউকে আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখবেন, তখন এই ক্রোধকে কাজে লাগাবেন। সুতরাং নিজের জন্য কখনো রাগ করবেন না; বরং রাগের পুরো শক্তি আল্লাহর জন্য ব্যয় করবেন।
  • অজ্ঞদের ওপর দয়া করুন। আর তা এভাবে যে, তাদের অনুরূপ উত্তর প্রদান করবেন না। তাহলে আপনি আল্লাহর এ সকল বান্দার অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন, যাদের প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন: রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, “সালাম।[সুরা আল-ফুরকান, ২৫ : ৬৩]

উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ৯৫ – ১০৩

বইঃ দ্বীনে অবিচল থাকার কতিপয় উপায় -ফ্রি ডাউনলোড

লেখকঃ মক্তব তাওয়িয়াতুল জালিয়াত আলজুলফি | পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৭ | ফাইল সাইজঃ ২.৮৫ MB |

কিভাবে দীনের উপর অবিচল থাকবেন এই বিষয় খুব চমৎকার কিছু টিপস দিয়েছেন লেখক।

দ্বীনে অবিচল থাকার কতিপয় উপায় – QA Server
দ্বীনে অবিচল থাকার কতিপয় উপায় – QA Server

দ্বীনে অবিচল থাকার কতিপয় উপায় – Mediafire
দ্বীনে অবিচল থাকার কতিপয় উপায় – Mediafire

This book is published from: F.G.O. Al- Zulfi 11932 P.O Box: 182, Saudi Arabia.

 

মুসলমানদের ১৫ টি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী

লেখক : আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী | অনুবাদ : সাইফুল্লাহ আহমাদ | ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার

 

ইসলামী শরীয়ত হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবনকে গঠন করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে এসব দিকের মধ্যে গুনাবলি শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। তাইতো আকীদা ও আখলাকের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ]

সুতরাং উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহী ও প্রতিফলন। চরিত্র ব্যতীত ঈমান প্রতিফলিত হয় না বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে প্রেরণের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি তো কেবল চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দিতে প্রেরিত হয়েছি।”  ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা উত্তম ও সুন্দরতম চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।” [সূরা আল, কালাম : ৪]

কোথায় এ চরিত্র বর্তমান বস্তুবাদী মতবাদ ও মানবতাবাদী মানুষের মনগড়া চিন্তা চেতনায় ?

যেখানে চরিত্রের দিককে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা শুধু সুবিদাবাদী নীতিমালা ও বস্তুবাদী স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও তা অন্যদের উপর জুলুম বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়। অন্য সব জাতির সম্পদ লুন্ঠন ও মানুষের সম্মান হানীর মাধ্যমে অর্জিত হয়।

একজন মুসলমানের উপর তার আচার-আচরণে আল্লাহর সাথে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে, অন্য মানুষের সাথে, এমনকি নিজের সাথে কি ধরনের আচরণ করা উচিত ইসলাম তার এক অভিনব চকমপ্রদ চিত্র অংকন করে দিয়েছে। যখনই একজন মুসলমান বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলামী চরিত্রের অনুসরণ করে তখনই সে অভিষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চ মর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে, যখনই একজন মুসলমান ইসলামের চরিত্র ও শিষ্টাচার হতে দূরে সরে যায় সে বাস্তবে ইসলামের প্রকৃত প্রাণ চাঞ্চল্য, নিয়ম-নীতির ভিত্তি হতে দূরে সরে যায়। সে যান্ত্রিক মানুষের মত হয়ে যায়, যার কোন অনুভূতি এবং আত্মা নেই।

ইসলামে ইবাদতসমূহ চরিত্রের সাথে কঠোরভাবে সংযুক্ত। যে কোন ইবাদত একটি উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না তার কোন মূল্য নেই। আল্লাহর সামনে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় নামায একজন মানুষকে অশ্লীল অপছন্দ কাজসমূহ হতে রক্ষা করে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে এর প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল, অপছন্দনীয় কাজ হতে নিষেধ করে।” [ সূরা আল-আনকাবুত :৪৫ ]

অনুরূপভাবে রোযা তাক্কওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রের অন্যতম, যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার।” [ সূরা আল বাকারা : ১৮৩ ]

  • রোযাঃ অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ না করে অস্থিরতা না দেখায়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে দেয় আমি রোযাদার। বুখারী ও মুসলিম
  • যাকাতঃ অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,“তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন।” [সূরা তাওবাহ ১০৩ আয়াত ]
  • হজ্জঃ আর হজ্জ হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা আত্মশুদ্ধি এবং হিংসা বিদ্ধেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ হজ্জের মধ্যে না করে।” [সূরা আল বাকারাহ : ১৯৭ ]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল, সে তার পাপ রাশি হতে তার মা যেদিন জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এল।” [বুখারী ও মুসলিম]

ইসলামী চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহ

১) সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল ইসলামী চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন,“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” [ সূরা আত-তাওবাহ : ১১৯]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” [মুসলিম]

২) আমানতদারিতা:

মুসলমানদের সে সব ইসলামী চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” [সূরা আন নিসা : ৫৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদীনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের। কিন্তু ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

৩) অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলামী মহান চরিত্রের অন্যতম হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।” [সূরা ইসরা : ৩৪]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।

৪) বিনয়:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইদের সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” [সূরা আল হিজর : ৮৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” [মুসলিম।]

৫) মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের অন্যতম। আর এটা তাদের অধিকার মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকার স্থান হল আল্লাহর হকের পরে।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা : ৩৫ আয়াত]

আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন : “তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [ সূরা আল ইসরা : ২৪ ]

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল মানুষের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

৬) আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত ও অভিশাপের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

৭) প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা : ৩৬]

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ ‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করতেছিল এমনকি আমি ধারণা করেনিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী পাক কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফের হয়।

৮) মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মেহমানের আতিথেয়তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী, “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

৯) সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তাআলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দান কারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।”   [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।”  [মুসলিম]

১০) ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয়। অনুরূপভাবে মানুষদের ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।”   [সূরা আশ শুরা : ৪৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ] তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।”  [আহমাদ]

১১) মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্র যা ভালবাসা সৌহার্দ প্রসার ও মানুষের পারষ্পারিক সহযোগিতার প্রাণের দিকে নিয়ে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন: “তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সাদকাহ, সৎকর্ম ও মানুষের মাঝে সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসব করে অচিরেই আমরা তাকে মহা প্রতিদান প্রদান করব।” [সূরা আন নিসা : ১১৪]

১২) লজ্জা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম আরেকটি চরিত্র হচ্ছে লজ্জা। এটা এমন একটি চরিত্র যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহবান করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হতে বারণ করে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে। ফলে মুসলমান লজ্জা করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এবং নিজের থেকেও সে লজ্জা করে। লজ্জা অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,‘লজ্জা ঈমানের বিশেষ অংশ।’ [বুখারী ও মুসলিম] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

১৩) দয়া ও করুণা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে দয়া বা করুণা। এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মত অথবা এর চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী, গভীর অনুভূতি সম্পন্ন উজ্জল অনুগ্রহের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “অত:পর সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয় যারা ঈমান এনেছে পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্য্য ও করুণার উপদেশ দিয়েছে। তারা হচ্ছে দক্ষিণ পন্থার অনুসারী।”  [সূরা আল-বালাদ : ১৭- ১৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মত। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।”  [মুসলিম]

১৪) ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা:

ন্যায় পরায়ণতা ইসলামী চরিত্রের আরেকটি অংশ। এ চরিত্র আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচনের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ইহসান ও নিকটাত্মীয়দের দান করতে নির্দেশ দেন।”  [সূরা আল নাহাল : ৯০]

আল্লাহ তাআলা বলেন, “ইনসাফ কর, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।” [সূরা আল মায়িদা : ৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট নূরের মিম্বরের উপর বসবে। তারা হল সে সব লোক, যারা বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রে এবং যে দায়িত্বই পেয়েছে তাতে ইনসাফ করে।”

১৫) চারিত্রিক পবিত্রতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। এ চরিত্র মানুষের সম্মান সংরক্ষণ এবং বংশে সংমিশ্রন না হওয়ার দিকে পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :“যাদের বিবাহের সামর্থ নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।” [ সুরা আন নূর-৩৩ ]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, “তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন যেন খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্র“তি দেয় তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থান হেজাফত কর।” [ হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন ]

ইসলামের এ সব চরিত্রে এমন কিছু নেই যা ঘৃণা করা যায়। বরং এসব এমন সম্মান যোগ্য মহৎ চারিত্রাবলী যা প্রত্যেক নিষ্কলুষ স্বভাবের অধিকারীর সমর্থন লাভ করে। মুসলমানগণ যদি এ মহৎ চরিত্র ধারণ করত তাহলে সর্বস্থান থেকে তাদের নিকট মানুষ আগমন করত এবং দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে তারা প্রবেশ করত যেভাবে প্রথম যুগের মুসলমানদের লেন-দেন ও চরিত্রের কারণে সে সময়ের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছিল।

  সমাপ্ত

যাকাত না দেওয়ার পরিণাম

লেখক: আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস

যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ঈমান ও ছালাতের পরেই যাকাতের স্থান। মহান আল্লাহ পৃথিবীর মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য যাকাত ফরয করেছেন। পবিত্র কুরআনে ৩২ জায়গায় যাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। যাকাত না দিলে সম্পদ শুধু ধনীদের কাছে জমা হয়। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং ধনীরা ও সূদখোররা জোঁকের মত সমাজের রক্ত শোষণ করে নিজে বড় হয়, আর সমাজকে রক্তহীন করে দেয়। তাই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ-

আবূ হুরায়রা (রা:) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন: প্রত্যেক সোনা-রূপার মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করে না, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য বহু পাত তৈরী করা হবে এবং সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পাঁজর কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হবে, তখনই তা গরম করা হবে (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) সেই দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। সকল বান্দার বিচার নিষ্পতি না হওয়া পর্যন্ত তার এ অবস্থা চলতে থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।

জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! উট সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন: কোন উটের মালিক যে তার হক্ব আদায় করবে না। আর তার হক্ব সমূহের মধ্যে পানি পানের তারিখে তার দুধ দোহন করা এবং অন্যদের দান করাও এক হক্ব। যখন ক্বিয়ামতের দিন আসবে তখন এক প্রশস্ত বিশাল ময়দানে তাকে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল উট যা একটি বাচ্চাকেও হারাবে না- পূর্ণভাবে তাকে ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে ও মুখ দ্বারা কামড়াতে থাকবে। এভাবে যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এরূপ করা হবে এমন দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান, যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ জান্নাতে অথবা জাহান্নামের দিকে দেখতে পাবে।

জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গরু ও ছাগল সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন: প্রত্যেক গরু ও ছাগলের মালিক যে তার হক্ব (যাকাত) আদায় করবে না, ক্বিয়ামতের দিনে তাকে এক ধুধু মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল গরু ও ছাগল তাকে শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে ও ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে। অথচ সেদিন তার একটি গরু বা ছাগলও শিং বাঁকা, শিং হীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি গরু-ছাগলকেও সে হারাবে না। যখনই তার প্রথম দল অতিক্রম করবে, তখনই শেষ দল এসে পৌঁছবে। (এরূপ করা হবে) সে দিনে, যে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। যাবৎ না আল্লাহর বান্দাদের বিচার-মীমাংসা শেষ হয়। অতঃপর সে তার পথ হয় জান্নাতে, না হয় জাহান্নামে দেখতে পাবে।

অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ঘোড়া সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন: ঘোড়া তিন প্রকার। ঘোড়া কারো জন্য পাপের কারণ, কারো জন্য আবরণস্বরূপ আর কারো জন্য ছওয়াবের বিষয়। (১) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য পাপের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে লোক দেখানো অহংকার ও মুসলমানদের প্রতি শত্রুতার উদ্দেশ্যে। (২) যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে আবরণ স্বরূপ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে লালন-পালন করেছে আল্লাহর রাস্তায় এবং তার সম্পর্কে ও তার পিঠে আল্লাহর হক্ব সম্পর্কে ভুলেনি। এই ঘোড়া তার মান-সম্মানের জন্য আবরণ স্বরূপ। আর (৩) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য ছওয়াবের কারণ তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে কোন চারণভূমিতে বা ঘাসের বাগানে শুধু আল্লাহর রাস্তায় মুসলমানদের দেশ রক্ষার জন্য। তখন তার সে ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানের যা কিছু খাবে, সে পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে এবং তার গোবর ও প্রস্রাব পরিমাণও নেকী লেখা হবে। যদি তা আপন রশি ছিড়ে একটি অথবা দু’টি মাঠও বিচরণ করে তাহ’লে তার পদচিহ্ন ও গোবর পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে। এছাড়া তার মালিক যদি তাকে কোন নদীর কিনারে নিয়ে যায়, আর সেটা নদী হ’তে পানি পান করে, অথচ মালিকের ইচ্ছা ছিল না তাকে পানি পান করানোর। তবুও ঐ পানি পরিমাণ নেকী তার জন্য লেখা হবে।

জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! গাধা সম্পর্কে কী হবে? তিনি বললেন: গাধার বিষয়ে আমার নিকট শুধু এই স্বতন্ত্র ও ব্যাপকার্থক আয়াতটি নাযিল হয়েছে ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সেদিন সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।

[যিলযাল ৯৯/৭-৮; মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭৩; বাংলা মিশকাত হা/১৬৮১]

আল্লাহর দেয়া সম্পদের যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষ পার্থিব জীবনে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে, তেমনি পরকালীন জীবনে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতের অফুরন্ত সুখ লাভে ধন্য হবে। তাই আমাদের সকলের উচিত সোনা-রূপা ও গবাদি পশুসহ সকল সম্পদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করা এবং মহান আল্লাহ নির্দেশিত পথে খরচ করা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন।

আমীন!!

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

বই – প্রোডাক্টিভ রামাদান – Productive Ramadan – ফ্রী ডাউনলোড

 

বই: প্রোডাক্টিভ রামাদান (Productive Ramadan)

লেখক: উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস

প্রকাশনায়: মাকতাবাতুল আসলাফ

অনুবাদক: মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ, নাফিস নাওয়ার সহ আরও অনেকে

সংকলন ও সম্পাদনা: মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

পৃষ্ঠা সংখ্যা: 196

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: রামাদান মাস হচ্ছে মুসলিম জাতির আমলি বসন্ত। প্রত্যেক প্র্যাক্টিসিং মুসলিম এই মাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে। এই মাসে আমলের সওয়াব অন্য মাসগুলোর আমলের তুলনায় অনেক বেশি। তাই আমাদের সবারই লক্ষ্য থাকে এ মাসে বেশি বেশি আমল করা, আরো বেশি প্রোডাক্টিভ থাকা।

এমাসে আমাদের কাজকর্ম, পড়াশুনা, পারিবারিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদির পাশাপাশি অর্ধেক দিন সিয়ামরত অবস্থায় এবং বাকি অর্ধেক সময়ে রাতের ইবাদত এবং কুরআন তিলাওয়াতও করতে হয়। এটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। রামাদান মাসে কীভাবে এত এত চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে আরো বেশি প্রোডাক্টিভ থাকা যায়, সে বিষয়েই কিছু কার্যকর পরামর্শ দেয়া হবে এ বইয়ে। রামাদানের প্রস্তুতি, লক্ষ্য, পরিকল্পনা ও রুটিন বানাতে এ বই আপনাদের জন্য সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ। রামাদানে আমলে মনোযোগী হওয়ার, কুরআন পড়ার ও দুআ করার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে এ বইয়ে। শুধু তাই নয়, রামাদানের খাদ্যাভ্যাস ও ফিটনেস ধরে রাখার উপায়, একাডেমিক পরীক্ষার ব্যস্ততা সামলে আমল করার উপায়ও বাতলে দেয়া হয়েছে এ সংকলনে।

সবশেষে, রামাদানের পরেও কুরআনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ও সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ বই। আশা করি, বইটি রামাদানের প্রস্তুতির জন্য ও প্রোডাক্টিভভাবে রামাদান কাটানোর জন্য কার্যকর একটি গাইডবুক হবে ইনশাআল্লাহ।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – প্রোডাক্টিভ রামাদান – QA Server
বই – প্রোডাক্টিভ রামাদান – QA Server
বই – প্রোডাক্টিভ রামাদান – 4Shared
বই – প্রোডাক্টিভ রামাদান – 4Shared

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

মোবাইলে কুরআন পড়ার কিছু অসাধারণ অ্যাপস

iQuran-Pro-Full-Aplication-For-Android

 

এই প্রবন্ধে কয়েকটি অসাধারণ অ্যাপের পরিচয় দেওয়া হয়েছে যা আপনার অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোন ডিভাইসে কুরআন পড়ার অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। এই অ্যাপগুলি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন সুন্দর ইউজার ইন্টারফেস, অডিও তিলাওয়াত, তাফসীর এবং অনুবাদ প্রদান করে। প্রবন্ধটি প্রতিটি অ্যাপের বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধাগুলি তুলে ধরে, যাতে পাঠকরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেরা অ্যাপটি বেছে নিতে পারেন। সুতরাং, এই অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে আপনার কুরআন তিলাওয়াতের অভিজ্ঞতা আরও ঘনিষ্ঠ ও অর্থবহ করে তুলুন।

Al Quran (Tafsir & by Word)

Al Quran (Tafsir & by Word) is a Quran study tool for all. It provides verse by verse audio playback with repeat functions, Tafsir ibn kathir, Color Coded Tajweed, word by word Analysis and Translations, Index of Quran, note taking, custom bookmarks with sync, basic Notes with sync, powerful search, several simultaneous translations, multiple themes and fonts and much more.

Download or Search with app name on Play Store.

 

কুরআন মাজিদ

Download – Search with app name on Play Store.

Quran For Android

Play Store Link – https://play.google.com/store/apps/details?id=com.quran.labs.androidquran

MP3 Quran

Play Store Link – https://play.google.com/store/apps/details?id=com.fantasy.MP3Quran

Quran Central

Play Store Link – https://play.google.com/store/apps/details?id=com.qurancentral

 

রামাদান : তাওবা ও গুনাহ মাফের সুবর্ণ সুযােগ

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

এই মােবারক মাস মুমিনদের জন্য যে-সকল কল্যাণ বয়ে আনে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে আল্লাহর কাছে তাওবা করার, তাঁর অভিমুখী হওয়ার এবং অতীতের সমস্ত গুনাহের কথা স্মরণ করে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার অবারিত সুযােগ।

এ মাসে তাওবার দরজা সব সময় খােলা থাকে। আল্লাহর দান ও দয়া বর্ষিত হতে থাকে। পাপীদের অভয় দিয়ে ঘােষণা করা হতে থাকে—আছে কি কোনাে তাওবাকারী? আছে কি কোনাে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী? আল্লাহ তাআলা বলেন—

হে রাসূল, আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, তােমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়াে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।[1]

এই মাস তাওবা ও ক্ষমার মাস। বদান্যতা ও অনুগ্রহের মাস। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অন্যান্য মাসের চেয়ে অধিক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে তাওবা ও ক্ষমার চিত্র তুলে ধরে

আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন—

আল্লাহ তাআলা রাতের বেলা স্বীয় হাত প্রসারিত করেন—যেন দিনের অপরাধীরা তাওবা করতে পারে। অনুরুপ দিনের বেলা স্বীয় হাত প্রসারিত করেন—যেন রাতের অপরাধীরা তাওবা করতে পারে। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে।[2]

বস্তুত আমাদের অপরাধ অগণন; কিন্তু তার ক্ষমা অপরিসীম। আমাদের গুনাহ অসংখ্য; কিন্তু তাঁর করুণার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। আমাদের পদস্থলন যত্রতত্র; কিন্তু তার ক্ষমার চাদর সর্বত্র।

আল্লাহ তাআলা বলেন—

(মুত্তাকী তারাই) যারা কোনাে পাপ কাজ করে ফেললে অথবা নিজের ওপর যুলুম করলে, আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর তিনি ছাড়া পাপ ক্ষমা করতে পারে এমন কে আছে? | তারা যে ভুল করে ফেলে, জেনে-শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না।[3]

তারা কখনাে পাপের ওপর অটল থাকে না। ভুল করলে ভুল স্বীকার করে। পাপ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মন্দ কাজ করলে অনুতপ্ত হয়। ফলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) থেকে আবু হুরায়রা রাসূল রাযিয়াল্লাহু আনহুর সহীহসূত্রে প্রমাণিত, তিনি বলেন

ওই ব্যক্তি অপদস্থ হােক—যে রামাদান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারে না।[4]

মুমিনের জন্য রামাদান একটি সুবর্ণ সুযােগ। এই সুযােগ সব সময় আসে না। অনেকের জীবনে হয়তাে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে না। সুতরাং, পাপ ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী কোনাে প্রচেষ্টাকারী আছে কি?

বান্দা যদি আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পারে এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে তবে তার প্রতি বছরের পাপ প্রতি বছরেই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সারা বছরের পাপরাশি রামাদানের কল্যাণে ভস্মিভূত হয়ে যাবে।

মাবু যর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হাদীসে কুদসীতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত যাছে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেছেন—

হে আমার বান্দারা, তােমরা দিন-রাত পাপাচার করাে। আমি তােমাদের পাপাচার ক্ষমা করি। সুতরাং, তােমরা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাে। আমি তােমাদের ক্ষমা করে দেব।[5]

অপরাধপ্রবণতা মানুষের সহজাত। তবে অপরাধ করার পর মানুষ দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যায়। এক শ্রেণি তাওবা-ইসতিগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং সফল হয়। আরেক শ্রেণি পাপের ওপর অটল থাকে এবং অজ্ঞতা বা অহঙ্কারবশত তাওবা-ইসতিগফার থেকে বিরত থাকে। এই দ্বিতীয় শ্রেণির পাপীরাই হতভাগ্য।

সরল পথে চলার সৌভাগ্য বঞ্চিত।

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একটি হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন—

হে আদম-সন্তান, তুমি যতদিন আমাকে ক্ষমার আশায় ডেকে যাবে, আমি ততদিন তােমাকে ক্ষমা করতে থাকব। তােমার অপরাধ যত বেশিই হােক না কেন—আমি তাতে পরােয়া করব না।[6]

সুতরাং, হে সিয়াম পালনকারী, এই মাস আমাদের বিশুদ্ধ তাওবার মাস। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য গনীমতসরূপ। আমরা কি এই গনীমত লাভের জন্য প্রতিযােগিতা করব না?

গত বছর যারা আমাদের সাথে সিয়াম পালন করেছে এবং তারাবীহর সালাতে অংশ নিয়েছে তাদের অনেকেই হয়তাে এ বছর আমাদের মাঝে নেই। নেক আমলগুলাে পুঁজি করে এবং দুঃসহ স্মৃতিগুলাে আমাদের জন্য ফেলে রেখে তারা মহান পালনকর্তার সান্নিধ্যে গমন করেছেন। বস্তুত তিনি বড়ই ত্বরিৎ হিসেব গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য যে, সিয়াম কবুলের গুরত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ হলাে, বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে তাওবা করা। যে-অপরাধের জন্য তাওবা করা হয়েছে সেটার পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সংকল্প করা এবং আল্লাহর যে-সকল হক আদায়ে অলসতা হয়েছে, সে-ব্যাপারে অনুতপ্ত হওয়া।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

তিনিই ওই সত্তা, যিনি তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং পাপসমূহ ক্ষমা করেন। তােমরা যা করাে, তা তিনি জানেন।[7]

আল্লাহর রাসূল বলেন—

ওই সত্তার শপথ—যার হাতে আমার প্রাণ! যদি তােমরা কোনাে পাপ না করতে, তাহলে আল্লাহ তােমাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতেন এবং তােমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতি নিয়ে আসতেন, যারা পাপ করবে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন।[8]

কেউ যদি রামাদান মাসেও ক্ষমা না চায়, তাহলে কবে ক্ষমা চাইবে? রামাদানে যদি আল্লাহর দিকে ফিরে না আসে, তবে কবে ফিরে আসবে?

রামাদানে অনেক সিয়াম পালনকারীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যথাসম্ভব সৎকাজ করার চেষ্টা করে। অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকে; কিন্তু রামাদান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার আগের মতাে হয়ে যায়। রামাদানে অর্জিত পুণ্যগুলাে নষ্ট করে ফেলে। সংকল্পগুলাে ভঙ্গ করে ফেলে। বাকি জীবনটা এভাবে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

তােমরা ওই মহিলার মতাে হয়াে না, যে পরিশ্রম করে সুতা পাকাবার পর টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলে [9]

আমাদের অনেক সালাফ রামাদানের সিয়াম শেষ হয়ে গেলে তার বিচ্ছেদে কাঁদতেন। নিজেদের গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতাপের অশ্রু ঝরাতেন। কারণ, তাদের চিন্তা ছিল স্বচ্ছ। হৃদয় ছিল পবিত্র এবং মন ছিল কলুষমুক্ত।

হে আল্লাহ, তুমি তােমার সৎ বান্দাদের যেভাবে সাহায্য করেছ, আমাদেরও ঠিক সেভাবেই সাহায্য করাে এবং আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করাে।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৯২ – ৯৬


[1] সূরা যুমার, আয়াত : ৫৩
[2] সহীহ মুসলিম : ৫০৮৩
[3] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৫
[4] আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬; হাদীসটি তিরমিযীতেও এসেছে
[5] সহীহ মুসলিম : ২৫৭৭
[6] জামি তিরমিযী : ৩৫৪০
[7] সূরা শূরা, আয়াত : ২৫
[8] সহীহ মুসলিম : ২৭৪৯
[9] সূরা নাহল, আয়াত : ৯২

হৃদয়ের সিয়াম

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন।[1]

উল্লেখ্য যে, হৃদয়ের হিদায়াতই হচ্ছে সমস্ত হিদায়াতের মূল। সফল ও নিরাপদ জীবনের উৎস। সকল কাজের পাপ-পুণ্যের নিক্তি। সর্বোপরি সকল সৎকাজ ও নেক আমলের তাওফীক লাভের প্রধান কারণ। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সাঃ) বলেন—

জেনে রাখাে, মানবদেহে এমন একটি মুদগা’ তথা মাংসপিন্ড রয়েছে। এই পিণ্ডটি সুষ্ঠু হলে সমগ্র দেহ শুষ্ঠ হয়; আর তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; জেনে রাখাে, তা হলাে ‘কলব’ তথা অন্তর।[2]

সুতরাং, অন্তরের পরিশুদ্ধি হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার চাবিকাঠি। আর কারও অন্তর অকেজো হয়ে গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য! মহান আল্লাহ বলেন—

এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার অনুধাবন করার মতাে অন্তর রয়েছে অথবা সে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে।[3]

প্রতিটি মাখলুকের অন্তর রয়েছে। তবে সব অন্তর এক নয়। কিছু অন্তর জীবিত; ঈমান, ইয়াকীন ও তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। আর কিছু অন্তর মৃত, রুগ্ন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুনাহগার ও আত্মার ব্যাধিগ্রস্ত লােকদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-

তাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রত, আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।[4]

তিনি আরও বলেন—

এবং তারা বলে, আমাদের হৃদয় আবৃত; বরং তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেছেন। ফলে তারা খুব কমই ঈমান আনে।[5]

তারা কি কুরআনের মর্ম-বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? [6]

তারা বলে, তুমি যে-বিষয়ের প্রতি আমাদের আহ্বান করছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আবৃত, আমাদের কানে রয়েছে বধিরতা এবং তােমার ও আমাদের মধ্যে রয়েছে অন্তরাল। অতএব, তুমি তােমার কাজ করাে এবং আমরা আমাদের কাজ করি। [7]

এসকল আয়াতে সুস্পষ্ট যে, মানুষের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত ও তালাবন্ধ হয়। অতঃপর একপর্যায়ে তা মরে যায়।

আল্লাহর দুশমনদের দেহে অন্তর রয়েছে, কিন্তু সেই অন্তর মৃত। মহান আল্লাহ বলেন—

তাদের অন্তর রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না।[8]

এজন্যই নবীজি (সাঃ) এই দুআটি বেশি বেশি পড়তেন—

হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে তােমার দ্বীনের ওপর সুদৃঢ় রাখাে[9]

মুমিনের অন্তর রামাদানে সিয়াম পালন করে। আর অন্তরের সিয়াম হচ্ছে, যাবতীয় শিরক ও ঈমান বিধ্বংসী কাজ থেকে তাওবা করে নিজেকে পবিত্র করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রবৃত্তির অনিষ্ট হতে নিজেকে রক্ষা করা।

এ মাসে আল্লাহর মহব্বত ও ভালােবাসায় আবাদ হয় মুমিনের অন্তর। আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলীর সাহায্যে তাঁর পরিচয় লাভ করে—যেভাবে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন পবিত্র কুরআনে। অন্তরচক্ষু দিয়ে তাঁর নিখিল সৃষ্টি ও বস্তুজগৎ অবলােকন করে—যেভাবে অবলােকনের আদেশ করেছেন তাঁর কিতাবে।

প্রকৃত মুমিনের অন্তর হয় ঈমানের নূর ও রিসালাতের চিরন্তন আলােয় উদ্ভাসিত। ফলে ঐশী জ্ঞান ও আল্লাহপ্রদত্ত বিদ্যার পরশে সে হয়ে ওঠে একজন ‘আলােকিত মানব’। আর এই আলাের সাথে তখন যুক্ত হয় অন্য একটি আলাে—সৃষ্টি ও প্রকৃতিগত বিশ্বাসের আলাে—যা জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ লাভ করে থাকে।

তার মাঝে তখন উভয় আলাের চমৎকার সমন্বয় ঘটে। কুরআনের ভাষায়—

জ্যোতির ওপর জ্যোতি! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে; আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন এবং তিনি সব বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞাত।[10]

একজন মুমিন বান্দার অন্তর হচ্ছে প্রদীপ সদৃশ। কুরআন তিলাওয়াতের ফলে এই প্রদীপের আলাে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। আর কুরআনের অর্থ ও মর্ম উপলব্ধির কারণে তার ঈমান হয় আরও প্রবল; বিশ্বাস হয় আরও উন্নত।

সিয়াম মুমিনের অন্তরকে অহংকার মুক্ত রাখে। কারণ, অহংকার মানুষের অন্তর কলুষিত করে। অহংকারী ব্যক্তি নির্বোধ, উভ্রান্ত ও অতি আমুদে হয়। হাদীসে কুদসীতে এসেছে—

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অহংকার হচ্ছে আমার চাদর এবং বড়ত্ব হচ্ছে আমার পােশাক। সুতরাং, যে-ব্যক্তি এ দুয়ের কোনােটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।[11]

নবীজি (সাঃ) বলেন: ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হবে, আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করতে করতে তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করবেন। আর যে-ব্যক্তি আল্লাহর ওপর অহংকার প্রদর্শন করবে, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন এবং একপর্যায়ে তাকে সবচেয়ে অপদস্থ করবেন।’ [12]

সিয়াম মানুষকে অহমিকা থেকে বিরত রাখে। অহমিকা মানে নিজেকে সবচেয়ে যােগ্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অন্যদের চেয়ে উত্তম মনে করা। রাসূল (সাঃ) বলেন—

তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে। এক. কৃপণতা অবলম্বন। দুই. প্রবৃত্তির অনুসরণ। তিন. অহমিকা প্রদর্শন।[13]

অহমিকা হচ্ছে একটি রােগ। আর এই রােগের চিকিৎসা হলাে, সর্বদা নিজের দোষ-ত্রুটি এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় করা যাবতীয় গুনাহের কথা স্মরণ করা। কুরআনের এই আয়াতটি বারবার পড়া—

মূসা বললেন, তাদের (সমস্ত কৃতকর্মের) খবর আমার পালনকর্তার নিকট লিখিত রয়েছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না।[14]

সিয়াম পালনকারী মুমিনের অন্তর সদা হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত থাকে। কেননা, হিংসা নেকী ধ্বংস করে। অন্তর তমসাচ্ছন্ন করে; অধিকন্তু এই হিংসাই স্রষ্টার নৈকট্যলাভের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মহান আল্লাহ বলেন—

তাহলে কি তারা মানুষকে এই জন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদের স্বীয় অনুগ্রহে কিছু দান করেছেন?[15]

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি (সাঃ) বলেন—

পরস্পর হিংসা কোরাে না। বিদ্বেষ ছড়িয়াে না। শত্রুতা পােষণ কোরাে না। একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ কোরাে না এবং অপর ভাইয়ের দামের ওপর দাম বাড়িয়ে কোনাে বস্তু ক্ৰয় কোরাে না।[16]

রাসূল : একদা এক ব্যক্তি সম্পর্কে তিনবার বলেন যে, এই লােকটি জান্নাতী। অতঃপর যখন তার আমল সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয় তখন সে বলে, প্রতি রাতে ঘুমানাের পূর্বে আমি সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ ও অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ঘৃণাবােধ অন্তর থেকে দূর করি। এরপর ঘুমাই।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং ঈমানের ওপর সদা অটল ও অবিচল রাখুন। আমীন।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৫৫ – ৬০


[1] সূরা তাগাবুন, আয়াত : ১১
[2] সহীহ বুখারী : ৫২
[3] সূরা কাফ, আয়াত : ৩৭
[4] সূরা বাকারা, আয়াত : ১০
[5] সূরা বাকারা, আয়াত : ৮৮
[6] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২৪
[7] সূরা হা-মীম, আয়াত : ০৫
[8] সূরা আরাফ, আয়াত : ১৭৯
[9] জামি তিরমিযী : ৩৫২২
[10] সূরা নূর, আয়াত : ৩৫
[11] সুনানু আবি দাউদ : ৪০৯০, ভিন্ন শব্দে সহীহ মুসলিম : ২৬২০
[12] মুসনাদে আহমাদ : ১১৭২৪
[13] মিশকাতুল মাসাবীহ : ৫১২২
[14] সূরা তহা, আয়াত : ৫২
[15] সূরা নিসা, আয়াত : ৫৪
[16] সহীহ মুসলিম: ২৫৬৪

চোখের সিয়াম

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

চোখের সিয়াম হচ্ছে কু-দৃষ্টি ও যত্রতত্র দৃষ্টিপাত থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।[1]

আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।[2]

আয়াতদ্বয় থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, চক্ষু মানুষের অন্তর পরিচালনা করে এবং এই চক্ষু-ই হচ্ছে আত্মার প্রবেশদ্বার।

একবার নবীজি (সাঃ) আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন—

হে আলী, কোনাে নারীকে একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখবে না। কেননা, প্রথমবার অনিচ্ছায় দৃষ্টি পড়ে গেছে বিধায় সমস্যা নেই; কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখা জায়িয হবে না।[3]

দৃষ্টির হিফাযত না করার দশটি ক্ষতি রয়েছে—

এক. কোনাে কাজে মন বসে না। সব সময় একপ্রকার অস্বস্তি অনুভব হয়। অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লােকও স্থিরতা ও কাজের মনােবল হারায়।

দুই. কাউকে দেখার পর তাকে না পাওয়ার বেদনা হৃদয়কে অনবরত দংশন করতে থাকে। এই হতাশা ও অতৃপ্তি তখন দু-চোখের ঘুম কেড়ে নেয়।

তিন. সালাত, সিয়াম কিংবা কুরআন তিলাওয়াত—কোনাে কিছুতেই আত্মতৃপ্তি আসে না। যিকিরে আত্মপ্রশান্তি অনুভব হয় না। এক কথায়, ইবাদাতের মাঝে যে ঈমানী স্বাদ, তা সম্পূর্ণ মাটি হয়ে যায়।

চার. এর দ্বারা বড় বড় গুনাহের সূত্রপাত হয়। অশ্লীলতা ও ব্যভিচারসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অনেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিও নেশা ও মাদকের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। ধর্ষণ, হত্যা ও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

সালাফদের কেউ একজন বলেন, আমি পবিত্র কুরআনের হাফিয ছিলাম। একবার কোনাে এক নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করি। ফলে চল্লিশ বৎসরে উপনীত হওয়ার পর আমি কুরআন ভুলে যাই। (আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন)

দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক উপকারিতা হচ্ছে, অন্তরে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভূত হতে থাকে।

সালাফগণ বলেন, দৃষ্টি হচ্ছে একজন কমান্ডারের মতাে; যখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, মুহূর্তে শিকার করে আনবে; কিন্তু যখন তাকে আটকে রাখা হবে, সে আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হবে। দৃষ্টিকে উন্মুক্তভাবে ছেড়ে দিলে অন্তরের দূষণ অনিবার্য। সালাফগণ আরও বলেন, যদি তুমি দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করাে, তবে সে তােমাকে লাঞ্ছিত করবে। যখনই তাকে বন্ধনমুক্ত করবে, সে তােমাকে ভােগান্তিতে ফেলবে ইহকালে কিংবা পরকালে।

শাহ কিরমানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে-ব্যক্তি চক্ষুকে অবনত রাখবে, অন্তরকে তাকওয়ায় সুসজ্জিত করবে, চাল-চলন ও বেশভূষায় সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করবে—সে অবশ্যই আল্লাহপ্রদত্ত ‘অন্তর্দৃষ্টি’লাভে ধন্য হবে। অতঃপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেন—

নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শনাবলী।[4]

দৃষ্টির হিফাযত করার পাঁচটি সুফল রয়েছে—

এক.মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর আনুগত্যের গুণ অর্জিত হয়। আর এটাই দুনিয়া। ও আখিরাতে সফলতার একমাত্র পুঁজি।

দুই. অন্তর গুনাহমুক্ত থাকে, চিত্ত প্রফুল্ল থাকে এবং সর্বক্ষণ অন্তরে একপ্রকার তৃপ্তি ও আত্মপ্রশান্তি বিরাজ করে।

তিন. যাবতীয় ফিতনা ও জটিলতা থেকে মুক্ত থাকা যায়।

চার. আল্লাহর পক্ষ হতে ইলম, মারিফাত ও তাকওয়া লাভের পাশাপাশি সৎকাজের তাওফীক নসীব হয়।

পাঁচ. সত্যবাদী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য ও অনুগ্রহলাভের উপায় এটি। এর মাধ্যমে তাদের অন্তরজগত আরও আলােকিত হয়।

যখন রামাদান মাস আমাদের দুআরে কড়া নাড়ে তখন আমাদের উচিত আপন আপন চক্ষুর হিফাযত করা। তাকে গুনাহমুক্ত রাখা। আর এটিই হচ্ছে ‘চোখের সিয়াম’। সিয়াম পালনার্থে ক্ষুধার্ত থাকার ফলে চোখের অনেক উপকার হয়। যেমন—এক. চোখের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দুই. অসৎ মনােবাসনা ও অপাত্রে দৃষ্টির কু-চাহিদা লােপ পায়।

নির্বোধ লােকেরা রাস্তায় চলার সময় এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করে। ফলে তারা শয়তানের খেলার বস্তু ও ক্রীড়নকে পরিণত হয়। শয়তান তাদের নানান গুনাহ ও অপরাধকর্মে লিপ্ত করে।

অনেকেই আছে যারা বাহ্যিকভাবে সিয়াম পালন করে, কিন্তু চক্ষু নিয়ন্ত্রণ না করার ফলে তাদের কল্প-জগতে হরদম অপকর্মের চিত্র ভাসতে থাকে।

প্রিয় ভাইয়েরা, আসুন আমরা সিয়াম পালনের পাশাপাশি নিজের আত্মা ও চক্ষুকেও গুনাহমুক্ত রাখি।

মহান আল্লাহ বলেন—

এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদের দেবেন জান্নাত ও রেশমী পােশাক। তারা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। তারা সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না।[5]

শান্তি বর্ষিত হােক তার প্রতি—যে সিয়াম অবস্থায় একমাত্র রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজের দৃষ্টির হিফাযত করে।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৬৬ – ৬৯


[1] সূরা নূর, আয়াত : ৩০
[2] সূরা নুর, আয়াত : ৩১
[3] সুনানু আবি দাউদ : ২১৪৯
[4] সূরা হিজর, আয়াত : ৭৫
[5] সূরা দাহর, আয়াত :১২-১৩

Ramadan Tips: রমাদান শুরুর আগেই ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেলুন

mall

রমাদানের প্রস্তুতিমূলক টিপস্‌: রমাদান শুরুর আগেই ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেলুন

আমাদের অধিকাংশই রমাদানের শেষ ১০ দিনে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি! অথচ এই ১০ দিন হলো ইবাদাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব এবং তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যেই রয়েছে অশেষ বরকত এবং পুণ্যময় লাইলাতুল ক্বাদ্‌র। তাই রমাদান মাসে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত না হয়ে রমাদান শুরুর আগেই ঈদের বাজার সেরে ফেলুন। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনে পুরো রমাদানকে এবং বিশেষ করে, শেষের ১০ দিনকে ইবাদাত দিয়ে সাজান।

আসুন রমজানের প্রস্তুতি শুরু করি এখন থেকেই

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

এই রামাদান পরিনত করুন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রামাদ্বানে। এই ‘রামাদ্বান রিসোর্সেস পোস্ট’-এ আছে  গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, লেকচার, বই, অন্যান্য দরকারী তথ্য যা আপনার রামাদ্বান প্রস্তুতিতে সাহায্য করবে যাতে আপনি কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী অনেক বেশি সৎ আমল করতে পারেন এবং সর্বোচ্চ উপকার  পেতে পারেন এই পবিত্র মাস থেকে।রামাদানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেকে পরিণত করুন মহান আল্লাহর একজন নিবেদিত বান্দা হিসেবে। রামাদানকে ব্যবহার করুন আগের চেয়ে আরও ভালো, আরও বেশি বেশি ইবাদাত চর্চা করার মাধ্যম হিসেবে। হেলাফেলায় এ মাস যেন চলে না যায় খেয়াল রাখুন।  ইনশা’আল্লাহ।

হয়োনা তুমি রমজানের আবেদ

লেখক : মুহাম্মদ বিন হামাদ আল-হামূদ আন নাজদী

হয়োনা তুমি রমজানের আবেদ

আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বন্ধু। আমরা সবাই তার প্রিয় বান্দা হতে চাই। কিন্তু কীভাবে? ক্ষণিকের তরে ইবাদত করলে কীভাবে তুমি আল্লাহর প্রিয় হবে? মাহে রমজান ইবাদতের মৌসুম বটে, কিন্তু তার মানে কী রমজান চলে যাওয়ার সাথে সাথে ইবাদত ফুরিয়ে যাবে? দীর্ঘ এক মাস যাবত যে সকল আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছে, তা সারা বছরই বাকী থাকে। এমনকি যতদিন জীবিত থাকে ততদিনই অবশিষ্ট থাকে। প্রকৃত মুমিন মৃত্যু পর্যন্ত আমল করতে থাকে।

জনৈক বুযুর্গকে বলা হলো অনেক মানুষকে শুধুমাত্র রমজানে ইবাদত করতে দেখা যায়। তিনি বলেন : সে জাতি বড়ই হতভাগ্য, যারা কেবলমাত্র রমজানেই আল্লাহর হক সম্পর্কে সচেতন থাকে। যে ব্যক্তি সারা বছর ঠিকমত ইবাদত করে সে-ই প্রকৃত সফল নেককার। এরশাদ হচ্ছে : “তুমি মৃত্যু আসা পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করতে থাক”। [সূরা হিজর : ৯৯]

ইমাম ইবনে রজব রহ. বলেন : মাস, বছর, দিন-রাত, মৃত্যু ও আমলের সময় নির্ধারক। আস্তে আস্তে এগুলো নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যে সত্ত্বা এগুলোর অস্তিত্ব দান করেছেন তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। তিনি সর্বযুগে সব সময় একক ও অদ্বিতীয়। বান্দার ইবাদত সম্পর্কে সর্বদা তিনি সচেতন। প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে বান্দা আল্লাহ তাআলার কোন না কোন নেয়ামতে ডুবে থাকে। মুমিন বান্দার জীবনে এমন কোন মূহুর্ত অতিবাহিত হয় না, যে সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত কোন না কোন দায়িত্ব না থাকে। খাঁটি মুমিন সর্বদা আশা ও ভয়ের মাঝে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে তার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রেমিক কখনও বিরক্ত বোধ করে না। তাছাড়া রবের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য ব্যতীত বান্দার চাওয়া পাওয়ার আর কিইবা থাকতে পারে?

আল্লাহর আনুগত্য ব্যতীত যে সময়টুকু অতিবাহিত হয়েছে তা বিফল। তাঁর জিকির থেকে বিমুখ থাকার সময়টুকু আক্ষেপ ও অনুশোচনার কারণ। শত আফসোস ঐ সময়ের উপর, যা আল্লাহর আনুগত্যের বাইরে নষ্ট হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন আমল শুরু করলে, তা রীতিমত করার চেষ্টা করতেন। আয়েশা রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ও অন্যান্য মাসে রাত্রিকালীন নামাজ এগার রাকাআতের বেশি পড়তেন না। অতএব বুঝা গেল, তিনি অন্যান্য মাসেও কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন।

মাহে রমজানে কোন আমল বা অজিফা ছুটে গেলে তা শাওয়ালে কাজা করে নিতেন। একবার তিনি রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতে পারেননি। পরে তা শাওয়াল মাসের প্রথম দশ দিনে আদায় করে নিয়েছেন।বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ মুসলিম শরীফে আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসে ৬টি রোজা রাখবে, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল।

মাহে রমজানের পর রোজা রাখার তাৎপর্য

আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, শাওয়াল মাসে রোজা রাখার তাৎপর্য অনেক। রমজানের পর রোজা রাখা রমজানের রোজা কবুল হওয়ার আলামত স্বরূপ। কেননা আল্লাহ তাআলা কোন বান্দার আমল কবুল করলে, তাকে পরেও অনুরূপ আমল করার তৌফিক দিয়ে থাকেন। নেক আমলের প্রতিদান বিভিন্নরূপ। তার মধ্যে একটি হলো পুনঃরায় নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা। তাই নামাজ রোজা ও অন্যান্য ইবাদত বাকি এগার মাসেও চালু রাখা চাই। কেননা যিনি রমজানের রব, বাকি এগার মাসের রব তিনিই।

তিনি আরো বলেন, তবে ইবাদতের মোকাবেলায় গুনাহের কাজ করলে নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। অতএব, কোন ব্যক্তি রমজানের পরপরই হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে গেলে, তার সিয়াম স্বীয় মুখের উপর নিক্ষেপ করা হয়। এবং রহমতের দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়।গুনাহের পর ভাল কাজ করা কতইনা উৎকৃষ্ট আমল। কিন্তু তার চেয়ে আরো উৎকৃষ্ট আমল হলো নেক কাজের পর আরেকটি নেক কাজে মশগুল হওয়া। অতএব, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর, যাতে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত হকের উপর অটল থাকার তৌফিক দান করেন। সাথে সাথে অন্তর বিপথে যাওয়া থেকে পরিত্রাণ চাও। কেননা আনুগত্যের সম্মানের পর নাফরমানির বেইজ্জতি কতইনা নিকৃষ্ট।

হে তওবাকারী যুবসমাজ!

গুনাহ একবার ছেড়ে দিয়ে আবার সেদিকে ফিরে যেও না। যদি তোমরা ভাল কাজের উপর ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পার, তাহলে প্রবৃত্তির অস্থায়ী আনন্দের পরিবর্তে স্থায়ী ঈমানি স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোন পার্থিব স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা বিনিময়ে তাকে তার চেয়েও উত্তম বস্তুর দ্বারা পুরস্কৃত করবেন। এরশাদ হচ্ছে: “আল্লাহ তাআলা যদি তোমাদের অন্তরে কল্যাণের আলো দেখতে পান, তাহলে তোমাদের হারানো বস্তুর চেয়েও উত্তম জিনিস দান করবেন। শুধু তা-ই নয়, সাথে সাথে তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন”। [সূরা আনফাল: ৭০]

হে অন্তর পরিবর্তনকারী রব, তুমি আমাদের আত্মাসমূহ তোমার মনোনীত দ্বীনের উপর অটল রাখ। আমীন!!

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

বই – মুমিনের দু’আ – ফ্রি ডাউনলোড

muminer duaবই: মুমিনের দু’আ

সম্পাদনায়: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

সংকলক: ডা. মুহাম্মদ আবুবকর সিদ্দিক

প্রকাশনায়: তাইবাহ একাডেমি

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১০৪

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর। দু’আর মাধ্যমে একজন মুমিন কীভাবে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলবেন এবং উভয় জগতে সফল হবেন সেই নিমিত্তেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

বাজারে হিসনুল মুসলিম নামে অনেক বই আছে, যেখানে অনেক বাহুল্য বিদ্যমান। কলেবর বেশি হওয়ায় পাঠক অনেক সময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সেই বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই বইতে চেষ্টা করা হয়েছে দৈনন্দিন জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু দু’আ সকল মুসলিমের জন্য সহজবোধ্য আকারে সন্নিবেশিত করার। বিশেষ করে সকাল-বিকাল, সালাম ফিরানোর পর এবং কুরআনুল কারীমের দু’আ বিষয়ক আয়াতগুলোকে সংকলিত করা হয়েছে। পাশাপাশি দু’আ কবুল হওয়ার সময় এবং সর্বোপরি পূর্ববর্তী জীবনের পাপ থেকে তাওবাহ করে কীভাবে একজন মুমিন পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দু’আ পাঠ করবে সেই বিষয়টি এখানে আলোকপাত করা হয়েছে।

নিষ্ঠাবান মুমিন, যারা সঠিক ও নির্ভুল দু’আ পাঠ করতে চান, তারা এই বই পড়ে উপকৃত হবেন বলে আশা রাখি। মহান আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়া তা’আলা আমাদের এই প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্যকে সফল করুন। আমীন।

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – মুমিনের দু’আ – QA
বই – মুমিনের দু’আ – QA

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান : রাত্রি-জাগরণের স্বর্ণালি মুহূর্ত

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

হে বস্ত্রাবৃত, রাতের কিছু অংশ ব্যতীত রাতজেগে সালাত পড়ুন; অর্ধরাত কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম। অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কুরআন আবৃত্তি করুন ধীরে ধীরে—সুস্পষ্টভাবে।[1]

এভাবেই আল্লাহ তার প্রিয় রাসূলকে নির্দেশ করেছেন। রাসূল (সাঃ)-ও এই নির্দেশ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ইবাদাত করেছেন। রবের দরবারে অশ্রু নিবেদন করেছেন এবং খুশূ- খুযূর সাথে সালাত আদায়ে নিমগ্ন থেকেছেন।

মহান আল্লাহ অন্যত্র তার নবীকে রাত্রি-জাগরণের নির্দেশ দিয়ে ও তার প্রতিদান ঘােষণা করে বলেন-

আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন। এটা আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব। শীঘ্রই আপনার পালনকর্তা আপনাকে উন্নীত করবেন প্রশংসিত স্থানে।[2]

অর্থাৎ, এই রাত্রি-জাগরণ হবে কিয়ামত দিবসে আপনার প্রশংসার উচ্চ শিখরে পৌছার অন্যতম প্রধান সিঁড়ি।

দিনে সিয়াম পালন ও রাতে সালাত আদায়ের মাস এই রামাদান। দিনভর সিয়াম পালন শেষে আঁধার রাতে নির্জনে সালাত আদায়ে যে-মধুর আত্মতৃপ্তি, একমাত্র সিয়াম পালনকারী ব্যতীত অন্যকেউ অনুভব করতে পারে না।

যারা প্রকৃত অর্থেই সিয়াম পালন করে, রামাদানের রাতগুলাে তাদের কাছে খুব বেশি সংক্ষিপ্ত মনে হয়। কারণ, আনন্দমুখর সময়গুলাে কীভাবে যেন ফুরিয়ে যায়। আর নিরানন্দ অবসরের সময় যেন শেষই হতে চায় না। সৎকর্মশীলদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-

তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যায়।[3]

ফলে তাদের রাত হতাে সুখময়। রাতের শেষ প্রহরে তাদের অবস্থা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-

রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।[4]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে—

এবং তারা শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে।[5]

এভাবে তাদের শেষরাতগুলাে হতাে ছবির মতাে সুন্দর।

মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ রাতের আঁধারে অঝােরে কাঁদতেন। রবের দরবারে ফরিয়াদ করতেন। হৃদয়ের সবটুকু বিনয় ও কোমলতা ঢেলে দিয়ে মিনতি জানাতেন; কিন্তু দিন হলেই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বিজয় অথবা শাহাদাত অবধি যুদ্ধ করে যেতেন। হৃদয়ের কঠোরতা ও নির্মমতায় কাফিরদের ভস্ম করতেন।

অপরদিকে রাতের প্রথমভাগে তাদের ঘর হয়ে উঠত তিলাওয়াত, যিকির, ঈমান, ইসলাম ও ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষার অনন্য পাঠশালা; কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে আমাদের ঘরগুলাে হচ্ছে গান-বাদ্য, নাটক-সিনেমা এবং অনর্থক ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডের আখড়া। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

বস্তুত, যখন থেকে আমরা রাত্রি-জাগরণ ও রবের স্মরণে অশ্রুপাত ছেড়ে দিয়েছি, তখন থেকে ধীরে ধীরে আমাদের অন্তরগুলাে শক্ত হতে শুরু করেছে। ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখন আর আমাদের চোখে পানি আসে না!

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি (সাঃ) আমাদের রামাদানে রাত্রি-জাগরণের ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন-

যে-ব্যক্তি রামাদানে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রাত জাগবে এবং সালাত আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।[6]

রাত্রি-জাগরণ ও সালাত আদায়ে উৎসাহ পেতে এই আয়াতগুলােও স্মরণ করা যেতে পারে-

যে-দিন মানুষ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে।[7]

তবে কি সে জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উখিত হবে?[8]

এবং অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ করা হবে?[9]

পাশাপাশি কবরের অন্ধকার, সংকীর্ণতা ও ভীতিকর দৃশ্যও কল্পনা করা যেতে পারে; বরং কল্পনা করাও উচিত; কারণ, রাত জেগে সালাত আদায় করলে অন্ধকার কবরে তা আলাের প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকবে। এছাড়াও রাতে সালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত এবং গুনাহ মাফের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

রাতে ইবাদাতের ক্ষেত্রে সালাফগণের পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন রকম। কেউ রুকু অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতেন। কেউ সিজদায় পড়ে থাকতেন। কেউ দাঁড়ানাে অবস্থায় তিলাওয়াত করতে থাকতেন। কেউ কান্নারত অবস্থায় তিলাওয়াত করতেন। আর কেউ একমনে যিকির ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবেই তারা সারা রাত কাটিয়ে দিতেন।

এই যদি হয় আমাদের পূর্বসূরীদের অবস্থা, তবে আজ আমাদের ঘর কেন ইবাদাতশূন্য? আমাদের ঘর থেকে কেন আজ তিলাওয়াতের আওয়াজ আসে না? কেন আজ ঘরে তাহাজ্জুদ পড়ার মতাে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না? আফসােস!

রাত যখন গভীর হয় তখন অলস ও গাফেলরা ঘুমিয়ে পড়ে। ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত লোকেদের অন্তরগুলাে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অপরদিকে আল্লাহর মুমিন বান্দা-বান্দীদের অন্তরগুলাে তখনাে জেগে থাকে। তারা কিছুতেই ঘুমােতে পারেন না। কবরের আযাব ও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তাদের দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ে। কবর, হাশর-নাশর ও কঠিন শাস্তির কথা যার স্মরণে থাকে, সে কী করে ঘুমােতে পারে?

আজকের মুসলিমপ্রজন্ম ইবাদাত তাে দূরে থাক, রাতভর দাবা, জুয়া আর গান-বাদ্যে মজে থাকে! আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি (সাঃ) তাকে বলেন—

‘হে আব্দুল্লাহ, তুমি অমুকের মতাে হয়াে না, যে একসময় রাতজেগে করে সালাত আদায় করত; কিন্তু এখন তা ছেড়ে দিয়েছে।’ [10]

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৪৪ – ৪৮


[1] সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত :১-৪
[2] সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯
[3] সূরা যারিয়াত, আয়াত :১৭
[4] সূরা যারিয়াত, আয়াত : ১৮
[5] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৭
[6] সহীহ বুখারী : ২০০৮; সহীহ মুসলিম : ১৭
[7] সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত : ৬
[8] সূরা আদিয়াত, আয়াত : ৯
[9] সূরা আদিয়াত, আয়াত : ১০
[10] সহীহ বুখারী : ১১১৪

নবীজির সিয়াম পালন

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রামাদানে নবীজি (সাঃ) খুব বেশি পরিমাণে ইবাদাত করতেন। সালাত, সাদাকা, যিকির, তিলাওয়াত, ইতিকাফ ও অন্যান্য ইবাদাতে সর্বোচ্চ সময় দিতেন। প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে কুরআন শােনাতেন। নিজেও তার তিলাওয়াত শুনতেন। সব সময়ই অকাতরে দান করতেন। তবে জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর সাক্ষাতের সময় হলে বদান্যতায় রহমতের বায়ুকেও ছাড়িয়ে যেতেন তিনি। তার এই অনন্য দান ও বদান্যতা সম্পর্কে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে— তিনি সব সময়ই ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক দানশীল। তবে রামাদানে বদান্যতায় তিনি নিজেকেও ছাড়িয়ে যেতেন। [1]

এছাড়াও নবীজি (সাঃ) ও অন্যান্য মাসের তুলনায় রামাদানকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। এ মাসটিকে শুধুই ইবাদাতের জন্য বরাদ্দ রাখতেন। অনেক সময় ইফতার-সাহরী না খেয়ে একটানা সিয়াম পালন করতেন। রাত-দিন একাকার করে মহান আল্লাহর ইবাদাতে নিমগ্ন থাকতেন। তবে সাহাবীদের এভাবে সিয়াম পালন করতে বারণ করতেন।

সাহাবীগণ নিবেদন করতেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যে একনাগাড়ে সিয়াম পালন করেন? তিনি বলতেন, “আমি তাে তােমাদের মতাে নই। আমি যখন আমার রবের উদ্দেশ্যে রাত্রিযাপন করি তখন তিনিই আমার পানাহারের [2] ব্যবস্থা করেন। [3]

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যখন লাগাতার সিয়াম পালন করতেন তখন তার সামনে সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য উদঘাটিত হতাে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নতুন নতুন দুআর উন্মােচিত হতাে, রিসালাতের আলােক-ঝরনায় তার জ্ঞানসত্তা আলােকিত হতাে। এবং নবুওয়াতের অমিয় সুধায় তার ব্যক্তিসত্তা পরিতৃপ্ত হতাে। উপযুক্ত হাদীসে এই পরিতৃপ্তিকেই পানাহার বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্য এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। কেননা, অব্যাহত সিয়ামের মধ্য দিয়ে নবী (সাঃ) মহান রবের নিকট-সান্নিধ্য অনুভব করতেন। প্রেমাস্পদের স্মরণে হৃদয় জুড়াতেন। তখন সঙ্গত কারণেই পার্থিব জগৎ ও পানাহারের কথা বেমালুম ভুলে যেতেন।

নবীজি (সাঃ) ছিলেন সবচেয়ে বড় আবিদ—তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর ইবাদাত করতেন। তাঁর স্মরণে চিত্ত ও জিহ্বা সিক্ত রাখতেন। রামাদানকে সালাত, সিয়াম, যিকির, তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদাতের ভর মৌসুম মনে করতেন। রাতভর সালাতে দাঁড়িয়ে মহান রবের সাথে অন্তরাত্মার সম্পর্ক স্থাপনে মনােযােগি হতেন। নিবেদিত প্রাণ হয়ে তাঁর কাছে দয়া, অনুগ্রহ, সাহায্য, সফলতা ও বিজয়ের মিনতি জানাতেন। লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। রুকু-সিজদায় দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিতেন। এরপরও তাঁর হৃদয়ে ইবাদাতের প্রতি এক প্রকার ক্ষুধা ও অতৃপ্তি কাজ করত।

নৈশকালীন ইবাদাত ছিল তাঁর চোখের শীতলতা, বুকের বল এবং জীবনের একমাত্র অবলম্বন। মহান আল্লাহ তাকে সম্বােধন করে বলেন— হে বস্ত্রাবৃত, আপনি রাতজেগে সালাত আদায় করুন—তবে কিছুঅংশ ব্যতীত [4]

আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন। এটা আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব।শীঘ্রই আপনার পালনকর্তা আপনাকে উন্নীত করবেন প্রশংসিত স্থানে। [5]

আর দিনের বেলায় নবীজি (সাঃ) দাওয়াত, জিহাদ, আত্মশুদ্ধি, নসীহত, ফতােয়াপ্রদান ও মানুষের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থাকতেন।

রামাদানে নবীজির কতিপয় সুন্নাহ

> নবীজি (সাঃ) সরাসরি চাঁদ না দেখে অথবা নির্ভরযােগ্য কারও সাক্ষ্য না পেলে রামাদানের সিয়াম পালন শুরু করতেন না।

> নবীজি (সাঃ) সাহরী খেতে পছন্দ করতেন। অন্যদেরও সাহরী খেতে উৎসাহিত করতেন। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে তিনি বলেন— তােমরা সাহরী খাও; কারণ, তাতে বিরাট বরকত রয়েছে। [6]

সাহরীর সময় অত্যন্ত বরকতময়। কেননা, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ দুআ ও ইস্তিগফারের সময়; অধিকন্তু এসময়ে মহান আল্লাহ নিকটতম আসমানে অবতরণ করেন। বান্দাদের ডেকে ডেকে তাদের প্রয়ােজন জিজ্ঞেস করেন এবং প্রয়ােজনপূরণের আশ্বাস দেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে— রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করে। [7]

মহান আল্লাহ আরও বলেন— তারা ধৈর্যধারণকারী, সত্যবাদী, নির্দেশ সম্পাদনকারী, সৎপথে ব্যয়কারী এবং শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী। [8]

এছাড়াও সাহরী সিয়ামপালনে অত্যন্ত সহায়ক। এর দ্বারা শারীরিক ও আত্মিক শক্তি লাভ করা যায়; অধিকন্তু এতে আল্লাহপ্রদত্ত নিয়ামত তাঁরই ইবাদাতের কাজে ব্যয়িত হয়।

> নবীজি (সাঃ) সূর্যাস্তের পর দ্রুত ইফতারে করতেন। সূর্যাস্ত নিশ্চিত হওয়ার পর অন্যদেরও দ্রুত ইফতারে উৎসাহিত করতেন। তাজা বা শুকনাে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করতেন। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে। কারণ, খালি পেটে মিষ্টিদ্রব্য পাকস্থলীর জন্য অত্যন্ত উপকারী। সুতরাং, সিয়াম পালনের পর সারা দিনের ক্ষুধা নিবারণে উত্তম খাবার হচ্ছে খেজুর ও মিষ্টিদ্রব্য।

> ইফতারের পূর্বমুহূর্তে নবীজি (সাঃ) দুআয় মগ্ন হতেন। সহীহ সূত্রে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন — তিন ব্যক্তির দুআ বৃথা যায় না—এক. ন্যায়পরায়ণ বাদশার দুআ। দুই. ইফতারের সময় সিয়াম পালনকারীর দুআ। তিন. মাযলুম তথা নির্যাতিত ব্যক্তির দুআ। এই দুআ সরাসরি আসমানে পৌঁছে যায়। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং মহান আল্লাহ অভয় দিয়ে বলেন, আমার বড়ত্বের কসম, আমি অবশ্যই তােমাকে সাহায্য করব—যদিও একটু বিলম্ব হয়। [9]

হাদীসে আরও এসেছে — ইফতারের পূর্বমুহূর্তে সিয়াম পালনকারীর দুআ ব্যর্থ হয় না। [10]

উল্লেখ্য যে, ইফতারের সময় নবীজি (সাঃ) দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণ ও সফলতার জন্য দুআ করতেন।

> নবীজি (সাঃ) মাগরীবের সালাত আদায়ের পূর্বেই ইফতার করতেন। তিনি বলেন — যখন পূর্বদিক হতে সূর্য উদিত হয়ে পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়, তখনই সিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময়। [11]

> রামাদান মাসে সফর অবস্থায় নবীজি (সাঃ) কখনাে সিয়াম রাখতেন, আবার কখনাে বিরত থাকতেন। সফর অবস্থায় সাহাবীদেরও তিনি সিয়াম রাখা ও না রাখার ইচ্ছাধিকার দিয়েছেন। [12]

> সিয়াম পালন অবস্থায় শত্রুর মুখােমুখি হতে হলে নবীজি (সাঃ) সবাইকে সিয়াম ভেঙে ফেলার আদেশ করতেন। কারণ, যুদ্ধের ময়দানে আত্মিক ও সামরিক শক্তির পাশাপাশি শারীরিক শক্তিও প্রয়ােজন। [13]

উল্লেখ্য যে, রামাদান মাসে নবীজি (সাঃ) ছােট-বড় বেশ কয়েকটি যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন। তবে সিয়াম ভঙ্গ করেছেন মাত্র দুটি যুদ্ধে। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে ইমাম তিরমিযী ও ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ এমনটিই বর্ণনা করেছেন। রামাদানে পরিচালিত যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে বদর-যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আল্লাহ তাকে অভূতপূর্ব বিজয় দান করেন—যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কতটুকু দূরত্বের সফরে বের হলে সিয়াম ভঙ্গ করা যাবে, তার সুস্পষ্ট বর্ণনা সরাসরি রাসূল (সাঃ) -এর পক্ষ থেকে পাওয়া যায় না। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে যে-ব্যক্তি ৪৮ মাইল তথা ৭৭ কিলােমিটার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নিজের বাসস্থান ত্যাগ করে, তার জন্য সিয়াম ভঙ্গ করার এবং না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে কষ্ট সহনীয় পর্যায়ের হলে সিয়াম পালন করাই উত্তম। [14]

> রামাদান মাসে গােসল ফরয অবস্থায় যদি সুবহে সাদিক হয়ে যেত, তবে রাসূল (সাঃ) গােসল করে সিয়াম পালন শুরু করতেন। সিয়াম অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তবে আমাদের জন্য এমনটি না করাই শ্রেয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের মতাে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি আমাদের নেই। সিয়াম অবস্থায় গড়গড়া করে কুলি করা যেমন অনুচিত এবং সিয়ামের জন্য ক্ষতিকর, তদ্রুপ স্ত্রীকে চুম্বন করাও অনুচিত এবং ক্ষতিকর। [15]

> কোনাে ব্যক্তি সিয়াম অবস্থায় ভুলক্রমে পানাহার করলে নবীজি (সাঃ) তার ওপর কাযার বিধান দেননি। কেউ এমনটা করলে তিনি বলতেন, তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পানাহার করানাে হয়েছে। [16]

সিয়াম ভঙ্গের কারণ হিসেবে হাদীসে সরাসরি যে-সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলাে হলাে-খাওয়া, পান করা এবং হিজামা [16] ও বমি করা। এছাড়া পবিত্র কুরআনে স্ত্রী সহবাসকেও সিয়াম ভঙ্গের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

> রামাদানের শেষ দশকে নবীজি (সাঃ) ইতিকাফ করতেন। [17] দুনিয়ার যাবতীয় ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে সঁপে দিতেন। অন্তরচক্ষু দিয়ে উধ্বলােক পরিদর্শন করতেন। এজন্য রামাদানের শেষ দশকে তিনি মানুষের সাক্ষাৎ একেবারেই কমিয়ে দিতেন। রবের প্রতি একাগ্রতা ও আত্মনিবেদন বাড়িয়ে দিতেন। কায়মনােবাক্যে তাঁর দরবারে মিনতি জানাতেন। মানুষের হিদায়াতের জন্য দুআ করতেন। একমনে তাঁর নাম ও গুণাবলির ধ্যান করতেন। সৃষ্টিজগতের অনন্য নিদর্শন নিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হতেন। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি-কুশলতায় হারিয়ে যেতেন।

এককথায়, নবীজি মহান আল্লাহর সম্যক পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হৃদয়ের গভীরে সর্বোচ্চ মাত্রায় ইলমের নূর ধারণ করেছিলেন এবং মরিচীকাময় এই দুনিয়ার তুচ্ছতা পরিপূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এজন্য তিনি আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করতেন। তাঁর ওপর সর্বাপেক্ষা বেশি ভরসা করতেন এবং তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতেন।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ১৫ – ২১


[1] সহীহ বুখারী : ৬
[2] এখানে পানাহার দ্বারা উদ্দেশ্য হলাে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আত্মিক শক্তি যেশক্তি অর্জিত হলে ইবাদাতে ক্লান্তি অনুভূত হয় না এবং শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দেয় না। মহান আল্লাহ কেবল তাঁর প্রিয় রাসূলকেই এই পর্যায়ের আত্মিক শক্তি দান করেছিলেন। অন্য কাউকে দান করেননি। তাই অন্যদের তিনি এধরনের সাধনায় ব্রতী হতে নিষেধ করেছেন। 
[3] সহীহ বুখারী : ১৯৬৭; সহীহ মুসলিম : ১১০৩
[4] সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত :১-২
[5] সূরা বানী-ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯
[6] সহীহ বুখারী : ১৯২৩
[7] সূরা যারিয়াত, আয়াত : ১৮
[8] সুরা ইমরান, আয়াত : ১৭
[9] জামি তিরমিযী : ২৫২৫
[10] সুনানু ইবনি মাজাহ : ১৭৫৩
[11] সহীহ বুখারী : ১৯৫৪
[12] সহীহ বুখারী : ১৯৪৩, ১৯৪৫; সহীহ মুসলিম:১১২১, ১১২২
[13] সহীহ মুসলিম : ১১২০
[14] সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪; হিদায়া : ১/২২১; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/২০ [13) ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব:১৬/২৩৭
[15] সহীহ বুখারী : ১৯৩৩; সহীহ মুসলিম : ১১১৫
[16] হানাফী মাযহাব অনুসারে হিজামা করলে সিয়ামের কোনাে ক্ষতি হয় না। তবে হিজামার কারণে যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের আশংকা থাকে এবং সেকারণে সিয়াম ভেঙে ফেলার মতাে দুর্বলতা দেখা দেওয়ার আশংকা থাকে তবে সিয়াম অবস্থায় হিজামা করার অনুমতি নেই।
[17] সহীহ বুখারী: ২০২৬; সহীহ মুসলিম : ১৯৭১

রামাদ্বানে সময়ের সদ্বব্যবহারের অপরিহার্যতা পর্ব – ১

stopwatch

অনুবাদ: হামিদা মুবাশ্বেরা

পর্ব ১ | পর্ব ২

এ বিষয়ে কথা বলার আগে শুরুতেই আমাদের মনে করিয়ে দেয়া উচিৎ যে কেন রামাদ্বানে সময়ের সদ্বব্যবহার করা অপরিহার্য। ডেভিড অ্যালেন, বিশ্বখ্যাত জি.টি.ডি সিস্টেমের নির্মাতা ব্যাখ্যা করেছেন যখন আমরা কোনো কিছু করতে চাইব, তখন চারটি বিষয় মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎঃ পরিস্থিতি, হাতে থাকা সময় ও এনার্জির পরিমাণ এবং অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা। আপনি যদি একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন এই চারটি বিষয়ই রোযাতে কিছুটা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়।

যেহেতু এটা পবিত্রতম মাস যা অনেকগুলো আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে উপস্থিত হয় (ন্যুনতম যা করতে হয় তা হল ভোরবেলা সেহরির জন্য উঠা, রোযা রাখা, তারবীহ পড়া ইত্যাদি), তাই এটার অনুষঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা। রামাদ্বানে  যা অর্জন করা যেতে পারে তা নিঃসন্দেহে অন্যান্য মাসের থেকে আলাদা (খেয়াল করে দেখবেন, আমি কিন্তু বলি নি যে অন্য মাসে কম!)

সন্ধ্যায় যেটুকু সময় হাতে পাওয়া যায় তা ইফতারের প্রস্তুতি,রোযা ভাঙা (যার সাথে প্রায়শই জড়িত থাকে দাওয়াত নেয়া বা দেয়া)এবং দীর্ঘ সময় ধরে তারাবীহর নামায পড়া, ইত্যাদি কারণে বেশ কমে যায়। রোযা রাখার ব্যাপারটি (সবসময় নয়) কিছুটা ক্লেশদায়ক হতে পারে, তাই এসময় আমাদের অন্যান্য মাসের মত কাজ করার এনার্জি থাকে না,অথবা অন্তত আর কিছু না হোক,আমাদের এনার্জি লেভেলের দৈনন্দিন ধাঁচটা বদলে যায়। আর যেহেতু এটা পবিত্রতম মাস, আমাদের অগ্রাধিকারগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, জাগতিক থেকে পারলৌকিক দিকে (এই বিষয়টি বুঝতে পারলে আধুনিক যুগের সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অনেক অনুযোগের সমাধান করা সম্ভব)

উপরোল্লেখিত বিষয়ের আলোকে, আমাদের কাজ যাই হোক না কেন, একটি বিশাল কোম্পানির ব্যবস্থাপক, ছাত্র, ব্যবসায়ী বা পেশাদার, আমাদের দৈনন্দিন উদ্দেশ্যগুলো সাধনের সাধারণ উপায় সম্পর্কে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, প্রথমেই রামাদ্বানে আমাদের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্ট করে  নেয়া দরকার।

রামাদ্বানের উদ্দেশ্য এবং আমাদের সময়ের উপর এর প্রভাবঃ

স্কলাররা যখন ইবাদাতের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেন, তখন সাধারণত তারা একে দুই ভাগে ভাগ করেন: প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ।আমরা সবাই জানি যে সকল কাজ, হোক তা থালাবাটি ধোয়া বা কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকা, ইবাদাতে পরিণত করা যেতে পারে এক অমোঘ ঔষধ দ্বারা- তা হল  নিয়্যত। তবে ইবাদাতের আরও অনেক রূপ আছে যেমন জিকির, সালাত এবং কুরআন তিলাওয়াত-যেগুলো প্রত্যক্ষ এবং এর সাথে কোনো পার্থিব সংশ্লিষ্টতা নেই। প্রত্যক্ষ ইবাদাত স্পষ্টতই শ্রেয়তর, যেহেতু এটা আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার শক্তিশালী মাধ্যম। সারাবছর ধরে আমাদেরকে খুব সামান্য কিছু প্রত্যক্ষ ইবাদাত করতে বলা হয়েছেঃ পাঁচ বেলা নামায, হাজ্জ এবং যাকাত, যা করতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুব অল্প কিছু সময় ব্যয় হয়।

পক্ষান্তরে পরোক্ষ ইবাদাতে লিপ্ত হওয়ার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছেঃ পরিবারের দেখাশোনা, জীবিকা অর্জন এবং সমাজসেবা।তবে রামাদ্বান প্রত্যক্ষ ইবাদাতের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। রামাদ্বানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীদের অভ্যাসের দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করলে এটাই প্রমাণিত হয়।

এই বিষয়টাই আমাদের সময়ে উভয় সংকটের সৃষ্টি করে। মুসলিম পেশাদাররা প্রায়ই দুশ্চিন্তাবোধ করেন এটা ভেবে যে কিভাবে তারা এই পবিত্র মাসে সর্বোত্তম উপায়ে কার্য সম্পাদন করতে পারেন।  এক ধরণের হীনমন্যতার জন্ম নেয়,যেখানে অনেকেই তাদের ‘কার্যক্ষমতা হ্রাস’ পাওয়াতে লজ্জিত বোধ করেন। অফিস কর্মী, ছাত্র এবং প্রোজেক্ট কর্মীরা লজ্জিতভাবে ব্যাখ্যা করেন যে তারা সন্ধ্যায় খুব বেশি কাজ নিতে পারবেন না।

মুসলিম সংবাদপত্র গুলো তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অধঃপতনে আক্ষেপ প্রকাশ করতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, নিজের স্বাস্থ্য এবং এনার্জি স্তর শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার এক নেশায় চেপে বসে মুসলিমদের, যাতে তারা তাদের অমুসলিম সহকর্মী, যারা রোযা রাখছে না, তাদের সমকক্ষ হতে পারেন। তাই সাফল্য,প্রেরণা এবং কার্যকারিতা সংক্রান্ত আমার সকল পড়াশোনা দিয়ে আমি আমার পাঠকদের রামাদ্বানের ‘অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা’ সত্ত্বেও তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে জনপ্রিয়তার গাড়িতে সমাসীন হতে পারতাম । কিন্তু আমি তা করব না, কারণ তাতে আমি আসল পয়েন্টটাই হারিয়ে ফেলব।

এই মাস আল্লাহকে প্রত্যক্ষভাবে ইবাদাত করার মাস। এটা মনঃ সংযোগ স্থাপন এবং রোযার উপকারিতা উপভোগ করার জন্য। এটা কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার জন্য। এটা মসজিদে যাওয়ার জন্য এবং কুরআনের সুমধুর তিলাওয়াত শুনতে শুনতে জামাতে ২০ রাকাত নামায পড়ার সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য। আর তার মানে যদি হয় কম পার্থিব যশ, তবে তাই হোক! কারো ঊর্ধ্বতনকে যদি শান্তভাবে এই মাসের পবিত্রতা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে হয় যে আপনি বেশি কাজ করতে পারবেন না, তবে তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হবার কিছু নেই। এ ব্যাপারে আপনাকেই অগ্রবর্তী হতে হবে। আগে থেকেই কিছুদিন ছুটি নিয়ে নিন,কিছু কাজ অধঃস্তনদের করতে দিয়ে দিন, কিংবা তোমার রুটিনকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করুন যাতে সপ্তাহান্তে বেশি বেশি কাজ করতে পারেন।

যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে রামাদ্বানে অগ্রাধিকার পাবে ইবাদাত, সবকিছু সেই অনুযায়ী ঠিকঠাকভাবে বিন্যস্ত হয়ে যাবে। একজন বিবাহিত মহিলার কথা চিন্তা করুন, যিনি ঘরে থেকে কয়েকজন বাচ্চার দেখাশোনা করেন।তার স্বামী যদি  মারা যান,তাহলে হঠাৎ করেই তাকে এখনকার স্কুলে ছোটাছুটি,ঘরের কাজ এবং মাতৃত্বজনিত অন্যান্য কাজের সাথে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের প্রতিশ্রুতিসহ চাকুরী নিতে হবে। তার বর্তমান ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে চাকুরী করার কথা তিনি দূরতম স্বপ্নেও চিন্তা করেন নি। কিন্তু তার স্বামী মারা গেছেন।তার আর কোনো বিকল্প নেই। তাকে কাজটা করতেই হবে। তাই ঊনি এখন কাজ করেন স্বউদ্যোগে।একটা উপায় বের করেছেনঃ একজন আয়া রেখেছেন; তার কাজগুলোকে গ্রুপে ভাগ করে নিয়েছে্ন; সময় নষ্টকারী কাজগুলো বাদ দিয়েছেন। স্বউদ্যোগী হওয়ার মাধ্যমে সে তার কার্যকারিতা ২০০% এ উন্নীত করেছে। বাস্তব জীবনেও সারা দুনিয়াতে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

এই উদাহরণ থেকে যেটা বোঝা যায় তা হল, যেমনটা ডঃ শোয়ার্টজ তার অতুলনীয় ‘ উচ্চাভিলাষী হবার জাদুকরী কৌশল’ তে ব্যাখ্যা করেছেন, “যোগ্যতা আসলে একটা মানসিক বিষয়।যখন আপনি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করেন যে আপনি অনেক বেশি কিছু করতে পারেন,আপনার মন তখন সৃষ্টিশীলভাবে চিন্তা করতে থাকে এবং আপনাকে পথ দেখায়”। এভাবে রামাদ্বানে আমরা যদি ইবাদাতকে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু বানাই, আমাদের সময়ে বরকত দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দুআ করি এবং সত্যিকারে বিশ্বাস করি যে আমাদের যা যা করা দরকার তা আমরা করতে পারবো-তাহলে কিভাবে সবকিছু সাজাতে হবে সেটার উপায় সহজেই মাথায় চলে আসবে।

আপনি যদি রামাদ্বানের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী,এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন- তাহলেই আপনি এই প্রবন্ধের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষাটি বুঝতে পারবেন। এই মূল বাণীর তুলনায় আর সব কৌশলগুলো হচ্ছে শাখা বিশেষ। কেউ যদি ভালো মুসলিম হতে চায় এবং এখান ওখান থেকে একটা দুটো ভালো কাজ শিখে, সে কিভাবে তুলনীয় হতে পারে তার সাথে যে তাকওয়া এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যকে এই সব কিছুর ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে? পরের জন দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে একটি মানসিকতার উপর এবং এটা তার উন্নতির গতিকে অনেক বেগবান করবে সেই মুসলিমের থেকে যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে কিছু বিচ্ছিন্ন কাজের উপর। অনুরূপভাবে আপনি যদি রামাদ্বানকে একজনের প্রত্যক্ষ ইবাদাত বাড়ানোর একটা প্রোজেক্ট হিসেবে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করো এবং এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে অন্য তেমন কিছু করা ছাড়াই আপনি যথেষ্ট আগাতে পারবেন।

তবে কিছু কৌশল আছে যা আপনাকে সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে সাহায্য করবে, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করার পরও। আর এই বিষয়টা আমাদের এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে।

পর্ব ১ | পর্ব ২

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

রামাদানের খাদ্যাভ্যাস – পর্ব ১

লেখকঃ উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস| সম্পাদনা ও সংযোজনঃ মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

রামাদানে ইবাদাত এবং নিজেকে কীভাবে আত্মিকভাবে আরাে পরিশুদ্ধ করা যায়, সেই চিন্তা না করে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ৩০ দিন ইফতার ও সাহরিতে কী রান্না করবেন বা কী খাবার তৈরী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। রামাদানের এক বা দুই সপ্তাহ আগ থেকেই কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। কিছু মানুষ তাে রামাদানের প্রথম কয়েকদিনে চরম অমিতব্যয়ির মতাে খাবার বানান, অথচ চিন্তা করেন না পরবর্তীতে তা তাদের উপর কী প্রভাব ফেলবে; বিশেষত যখন তাদের দীর্ঘ তারাবিহর সালাতের জন্য দাঁড়ানাের প্রয়ােজন হবে।

এই প্রবন্ধে রামাদানে একজন প্রােডাক্টিভ মুসলিমের খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি একটি বিশেষ ডায়েট প্ল্যান বানানাের রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে যা মেনে চললে সিয়ামরত অবস্থায়ও আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হােন, আপনার এই রামাদান আরেকটি ভােজন-উৎসব হবে না। বরঞ্চ এই রামাদানে আপনি পরিমিত ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আপনার স্বাস্থ্য এবং ওজনকে সঠিক অবস্থানে আনতে পারবেন, ইন শা আল্লাহ!

মানবদেহে রোজার প্রভাব

যারা আগে কখনও রােজা রাখেন নি তারা হয়ত ভাববেন এটি খুবই প্রান্তিক ও কষ্টকর কিছু হবে। কিন্তু, রামাদানের প্রথম কয়েকদিন রােজা থাকার পরেই আপনার শরীর নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং উপকারী বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদনে রত হবে।

আসলে আমাদের শরীর রােজা রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে শেষ খাবার খাওয়ার অর্থাৎ, সাহরি খাওয়ার ৮-১২ ঘণ্টা পর থেকে, যখন সর্বশেষ ভােজনের সব পুষ্টিরস আমাদের পাকস্থলী শুষে নেয় তখন। শক্তি উৎপন্ন করার জন্য আমাদের দেহ প্রথমে কার্বোহাইড্রেট এবং তারপর জমা থাকা চর্বি ব্যবহার করে। যখন আপনি কিছুই না খেয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দিবেন তখন আপনার দেহ জমে থাকা প্রােটিন ব্যবহার করা শুরু করবে এবং মাংসপেশি বা মাসল ভাঙতে শুরু করবে।

তখন আপনি অনাহারের পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, রামাদানে রােজা রাখায় শারীরিক ক্ষতির তেমন সম্ভাবনা নেই, কারণ রােজা রাখা শুরু হয় ভােরবেলা থেকে আর রােজা ভাঙ্গা হয়ে যায় সূর্যাস্তের সময়ে।

উপরন্তু, রােজা রাখার ফলে মানবদেহে জমে থাকা চর্বি স্তর থেকে শক্তি উৎপন্ন করার উপকারী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন কমায়, কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

সিয়াম হলাে প্রাকৃতিক বিষনাশক

রােজা রাখার আরেকটি উপকারিতা হল এটি ডিটক্সিফিকেশন তথা বিষনাশে সাহায্য করে। সহজভাবে বললে, আমাদের দেহে অনেক ক্ষতিকর উপাদান চবির সাথে জমে থাকে। চর্বি থেকে যখন শক্তি উৎপন্ন হয় তখন এসব ক্ষতিকর উপাদানগুলাে গলে যায় এবং আমাদের শরীরও দ্রুত আরােগ্য প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। রােজা রাখার ফলে মানবদেহে আরেকটি উপকার সাধিত হয়। তা হচ্ছে, এটি অধিক পরিমাণ শক্তিকে হজমক্রিয়ায় ব্যবহার না করে শরীরের রােগ প্রতিরােধ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে ব্যয় করে।

আপনি কি কখনাে খেয়াল করেছেন, রামাদানে আমাদের শরীর অনেক বেশি ঝরঝরে লাগে? কারণ, সিয়াম আপনার পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং আপনার বিপাকক্রিয়াকে শক্তি যােগায়। ফলে তা আরাে কার্যকরভাবে শর্করা খরচ করতে পারে। যদি আপনার পরিপাক ক্রিয়া দুর্বল হয়, এটি আপনার খাদ্য বিপাক ক্রিয়ার সামর্থ্যে প্রভাব ফেলে এবং চর্বি খরচ করে।

সিয়াম আপনার পরিপাক ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্বাস্থ্যকর অস্ত্রক্রিয়ার প্রবর্তন করে। এভাবে আপনার বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে। কিছু গবেষকের মতে, ‘শুধুমাত্র একদিন কিছু না খেলে, আমাদের শরীর বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কার করে ফেলে। এর ফলে শরীরের লিভার, কিডনিসহ অন্যান্ অঙ্গের কার্যক্ষমতা বাড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নাথান হেউইট তার একটি প্রবন্ধে অনুরূপ কথাই বলেছেন।

যদিও সিয়ামের অনেক বেশি উপকারিতা রয়েছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত; তবু, এটা ওজন কমানাের চুড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। কারণ, আমাদের শরীরে ওয়াটার বড়ি রয়েছে যা কমলে শরীরের ওজন তাে আপাত কমে, কিন্তু এটি ওজন কমানাের চূড়ান্ত সমাধান নয়।

সিয়াম আপনার ওজন কমানাের প্রক্রিয়ায় একটি দ্রুত লম্বা পদক্ষেপ, কিন্তু এটিই চূড়ান্ত সমাধান নয়।

সিয়াম যেভাবে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বাড়ায়

রামাদান শুধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছাকাছি হওয়ার আত্মিক অভিযাত্রার নামইনয়, এটি আপনার শারীরিকসুস্থতার যাত্রাশুরুর মাইলফলকও। সিয়ামের অসংখ্য শারীরিক উপকারিতা আছে, এটি আপনাকে আপনার খাবারদাবার পুনঃমূল্যায়ন করার ও খাদ্যাভ্যাসকে উন্নত করার একটি সুযােগ প্রদান করার মাধ্যমে আপনার ওজন কমানােতে সাহায্য করে।

খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) এর একটি একটি হাদিস উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। নবীজি (ﷺ) বলেন, “মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। (যতটুকু খাদ্য গ্রহণ করলে পেট ভরে পাত্র থেকে ততটুকু খাদ্য উঠানাে কোন ব্যক্তির জন্য দৃষণীয় নয়)। যতটুকু আহার করলে মেরুদণ্ড সােজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই কোন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোন ব্যক্তির উপর তার নফস (প্রবৃত্তি) জয়যুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।”  [তিরমিযি, হাদিস-ক্রম :২৩৮০; ইবনু মাজাহ, হাদিস-ক্রম : ৩৩৪৯]

খাবারের ব্যাপারে অংশ ঠিক রাখার এই বিষয়টি আমাদের প্রিয় রাসূল (ﷺ) প্রায় ১৪০০ বছরেরও আগে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, তখনও ওজন কমানাের এত উন্মাদনা শুরু হয়নি। আমরা যদি সত্যিই আমাদের রাসূল -এর এই সােনালি উপদেশ মেনে চলি, তাহলে আমরা নির্বোধের মতাে খাওয়া দাওয়া করবাে না এবং আমাদের পেট পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তা ভরতে থাকবাে না। কারণ, তা অবধারিতভাবেই ওজন বৃদ্ধি, অলসতা এবং ক্লান্তি নিয়ে আসে।

যারা সারাক্ষণ পানাহারের উৎসবে মেতে থাকে অথবা তাদের এই অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, সিয়াম পালন আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়াতে এবং আপনার খাদ্যাসক্তিকে কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। কেননা, তা আপনাকে শুধুমাত্র অনুমােদিত সময়ে খেতে বাধ্য করে। সেজন্য, আপনার শরীর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই নবপরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। প্রাকৃতিকভাবে, সিয়াম পালন আপনাকে এমন একটি পদ্ধতি খুঁজে পেতে ও মেনে চলতে সাহায্য করে, যেটা পরবর্তীতে অসুস্থদের জন্য স্বাস্থ্যকর, ইন শা আল্লাহ।

“ইন্টারমিটেন্ট ফাষ্টিং’ ওজন কমায়

কিছু নির্ধারিত সময়ে না খেয়ে থাকাকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বলে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শরীরের চর্বিসমৃদ্ধ কোষসমূহকে কার্যকরভাবেনষ্ট করে ফেলে, যা শুধু নিয়মিত নির্ধারিত খাদ্যতালিকা অনুসরণের মাধ্যমে সম্ভবপর হয় না। সুতরাং, সিয়াম বা না খেয়ে থাকাটা ওজন কমানাের একটা নিরাপদ উপায় হতে পারে। একদিন সিয়াম পালনের পর আপনার জন্য অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করাটা অধিক কার্যকরী, বিশেষত হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত ব্যাপারে।

আপনি সিয়ামবিহীন দিনের তুলনায় সিয়ামরত দিনে বেশি চর্বিসমৃদ্ধ কোষকে খরচ করছেন, কেননা, “ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ এ আপনার শরীর শর্করার পরিবর্তে চর্বিকে শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে, এমনকি অনেক ক্রীড়াবিদেরাও খেয়ে থাকাটাকে প্রতিযােগিতার জন্য শরীরের চর্বি কমানাের উপায় হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন।

সিয়াম অনাহারে থাকা নয়

কিছু মানুষ এই গভীর অনুভূতি লালন করে যে, সিয়াম শরীরকে ক্ষুধার কষ্ট দেয় এবং আপনি তাই ‘ক্ষুধায় কাতর হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতাে অবস্থায় চলে যান। এটি সত্য নয়। সিয়াম দিনের পর দিন অনাহারে থাকা নয়। এটি সহজভাবে, কিছু সময়ের জন্য পানাহার না করা, অনবরত মৌলিক পুষ্টি ব্যতীত দিনের পর দিন নয়।

মার্টিন বেরধান হলেন একজন পুষ্টিবিদ এবং প্রশিক্ষক। তিনি তার প্রবন্ধে উপবাস নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বলেন, “না খেয়ে থাকা মানে না খেয়ে থাকা। এটা কোন একটা খাবার বাদ দিয়ে যাওয়া অথবা ২৪ ঘন্টার জন্য না খেয়ে থাকাটাকে বুঝায় না। অথবা, ৩ দিনের জন্য না খেয়ে থাকাও নয়। তাই, এই বিশ্বাস করা যে, কোন একবেলার খাবার বাদ দিয়ে দিলে অথবা সংক্ষিপ্ত সময়ের। জন্য উপবাস করলে তা ‘ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার অবস্থায় নিয়ে যাবে; এটি পুরােপুরি হাস্যকর ও অযৌক্তিক।

পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসে প্রতিষ্ঠাপিত হওয়ার কর্মযজ্ঞ

রামাদানের পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য অনেক মুসলিমই রামাদানের আগের মাস তথা শাবান মাসে বিক্ষিপ্তভাবে নফল রােজা রাখেন। নবীজি (ﷺ) শাবান মাসে অনেক বেশি রােজা রাখতেন। [বুখারি, হাদিস-ক্রম; ১৯৬৯; মুসলিম, হাদিস-ক্রম : ১১৫৬]

এটি রামাদানের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করে। একইভাবে দিনে-রাতে কিছু নির্দিষ্ট সময় ঘুমানাের অভ্যাস থাকলে, ফজরে ঘুম থেকে উঠার এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানাের নিয়মিত অভ্যাস থাকলে আপনার জন্য রামাদানের রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া অনেক সহজ হবে। আপনি যদি অনেক বেশি চা-কফি পান করতে পছন্দ করেন তাহলে রামাদানের আগেই ধীরে ধীরে পান করার সংখ্যা কমিয়ে ফেলুন। রামাদানের অন্তত কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে এসবের পরিবর্তে লেমােনেড, হারবাল চা এবং পানি খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করুন।

অসময়ে নাশতা ও ফাস্টফুড খাওয়ার বাজে অভ্যাসও পরিত্যাগ করে ফেলুন। এসব খাবার আসক্তির মত। অভ্যাস আগে থেকে না বদলালে রামাদানে অসময়ে এসব খাদ্য খেতে ইচ্ছা করবে।

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ প্রোডাক্টিভ রামাদান, পৃষ্ঠা: ১৩২ – ১৩৬

বই – ভালোবাসার রামাদান – ফ্রী ডাউনলোড

বই: ভালোবাসার রামাদান

লেখক: ড. আইদ আল কারণী

প্রকাশনায়: সমকালীন প্রকাশন

ভাষান্তর: আবুল হাসানাত, জুবায়ের নাজাত, আব্দুল বারী

সম্পাদনা ও সংযোজন: আকরাম হোসাইন

পৃষ্ঠা সংখ্যা: 184

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: রামাদান এতই মাহাত্ম্যপূর্ণ একটি মাস যে, এই মাসে জান্নাতের সবগুলো দরজা উন্মুক্ত রাখা হয় এবং জাহান্নামের সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এই মাসেই রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনী যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রামাদানের প্রতিটি দিন ও রাতে আল্লাহর কাছে বান্দার দুআ কবুল হয় এবং অগণিত বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে।

অথচ কত-ই না দুর্ভাগা আমরা যে, উপযুক্ত দিক-নির্দেশনার অভাবে আমাদের অনেকেই মূল্যবান এই মাসটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি না। ফলে আমরা ব্যর্থ হই রামাদানের অমূল্য- সব নিয়ামতপ্রাপ্তি থেকে। মূল্যবান এই গ্রন্থখানি রামাদানে সিয়াম পালনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা সমৃদ্ধ।

এই গ্রন্থে
অপেক্ষাকৃত কার্যকরী বহু আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীসের মাধ্যমে রামাদানের বিভিন্ন আমলের ব্যাপারে নির্ভুল দিক-নির্দেশনা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। পাঠকগণ যেন তাদের রামাদানকে উত্তমরূপে কাজে লাগাতে পারেন সে-উদ্দেশ্যেই সমকালীন প্রকাশনের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – ভালোবাসার রামাদান – QA Server
বই – ভালোবাসার রামাদান – QA Server
বই – ভালোবাসার রামাদান – 4Shared
বই – ভালোবাসার রামাদান – 4Shared

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

রোজার মাসে নিজেকে নিয়ে চিন্তাভাবনা

8-ways-to-ward-off-loneliness-at-the-top

লিখেছেন: নূসরাত রহমান

রোজার মাস আসলেই পত্রিকায় রোজার ফযিলত নিয়ে যে কথাটা আসে, এ মাসটি বরকতময়, এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, কুরআন আমাদের সমস্ত জীবনবিধান, সুতরাং এ মাসের শুকরিয়া আদায় কর অধিক কুরআন পাঠ ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে। কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু মাসটার মাহাত্ম্য কিন্তু এর মাঝেই সীমাবদ্ধ না। তারাবী নামায ও কুরআন খতম দেয়ার পাশাপাশি আমাদের এই খেয়ালটুকুও রাখতে হবে, এর সাথে আত্মার যোগাযোগ যেন থাকে, এগুলো কেবলই যেন বাৎসরিক অভ্যাসে পরিণত না হয়। রমজান মাসের সুফল বলতে গেলে ঘুরেফিরে বারবারই পরকালের মুক্তির কথা আসে। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রতিফলন কই?

রমজান মাসকে বলা হয় আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মশুদ্ধি – এ কথাটার মানে কী? মানে আমাদের যেসব খারাপ দিক আছে সেগুলো ঝেড়ে মুছে ফেলব এই মাসে, তাই ত? কিন্তু কীভাবে?

খারাপ দিক ঝেড়ে ফেলার ব্যাপারে বলতে হলে আগে বলতে হবে খারাপ বৈশিষ্ট্য আমাদের মাঝে কোথা থেকে আসে। কুরআনে আদম সৃষ্টির ঘটনাটা যদি কারো মনে থাকে, তবে মনে পড়বে, শয়তান আল্লাহর কাছে শপথ করে বলেছিল, আমি আদম সন্তানদের চারিদিক থেকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করব। সুতরাং বিভ্রান্তি, বা আল্লাহর পছন্দ না, এমন স্বভাবগুলোর একটা মূল কারণ শয়তান। কিন্তু শয়তানের কোন ক্ষমতা নেই আমাদের মধ্যে কিছু সৃষ্টি করার। আমাদের ভেতরেই খারাপ চিন্তাগুলোর বীজ আছে, শয়তান সেগুলোকে উস্কে দেয় কেবল। ভালবাসার তীব্রতাকে শয়তান ঈর্ষা, সন্দেহপরায়নতায় বদলে দিতে পারে, আবার জ্ঞানপিপাসাকে একটু ঘুরিয়ে বদলে দিতে পারে সন্দেহবাতিকতা ও উন্নাসিকতায়। খারাপ চিন্তার উৎসটা আমাদের ভেতরেই। মোটা দাগে একে নফস বলা যেতে পারে। সারা বছর শয়তান আমাদের বুকের ভেতরে বসে নফসকে খুঁচিয়ে যেতে থাকে, আর নফস ও খেয়ালে বেখেয়ালে তাতে সাড়া দিয়ে বসে।

আত্মশুদ্ধির এই মাসটাতে আল্লাহ আমাদের প্রতি বিরাট এক রহম করেন, তিনি শয়তানকে দোজখে বেঁধে রাখেন পুরোটা মাস। তার মানে নফস কে জ্বালাতন করার এখন আর কেউ নেই! তার মানে, আমি যদি চাই, আত্মসমালোচনা করার এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। কারণ আমি জানি, যা কিছু খারাপ আসছে, তা পুরোপুরিভাবে আমার থেকেই আসছে, সুতরাং নিজেকে বদলাতে হলে আমার নফস এর সাথে আমার বোঝাপড়া করতে হবে।

নফস এর সাথে বোঝাপড়া – সেও কিন্তু রমজান মাসে আল্লাহ অনেক সহজ করে দিয়েছেন। নফস বলতে মোটা দাগে আমাদের শারীরিক মানসিক প্রয়োজনগুলিকে বোঝানো যেতে পারে। শারীরিক প্রয়োজনগুলি অতিমাত্রায় চর্চায় খারাপ অভ্যাসে রূপ নিতে পারে। যেমন, প্রয়োজনীয় বিশ্রামের অত্যধিক ব্যবহারে সেটা হয় আলস্য, ক্ষুধানিবৃত্তির প্রয়োজন নিয়ে বাড়াবাড়ি গিয়ে ঠেকে টেবিলভর্তি ইফতারে। তেমনি মানসিক প্রয়োজন, যেমন আবেগ ভালবাসার অনিয়ন্ত্রিত রূপ কতটা কদর্য হতে পারে, সে ত আমরা সবাই জানি।

রোজার মাসে শরীরের মনের এই সবগুলো প্রয়োজনকেই খুব নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখতে হয়। এত সংযম করেও আমরা যখন মারা পড়িনা, দিব্যি হেলেদুলে বেড়াই, তখনই বোঝা যায়, আমাদের মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজনটা আসলে কত কম!

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? শয়তান নেই, প্রবৃত্তির বাড়াবাড়ি নেই – বাকিটুকু যেটুক থাকে, তা কেবলই ‘আমি’, মানে আমার ভাল অংশটুকু। একে নিয়ে যত চিন্তাভাবনা করব, ততই একে চিনতে পারব। তখন রোজার মাস শেষ হয়ে গেলেও শয়তান একে আড়াল করে ফেলতে পারবে না।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি –

আমি লেখালেখির সুবাদে সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোতে অনেকটা সময় কাটাই। উদ্দেশ্যটা ভাল, লেখার মাধ্যমে ভাল চিন্তার প্রসার ঘটাব – কিন্তু আমার সুযোগসন্ধানী নফস করে কি, একে সব রকমের কঠিন কাজ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর উপলক্ষ বানিয়ে ফেলে। যেমন গবেষণার কাজের জন্য একটা আর্টিকেল পড়তে হবে, একটু কঠিন লাগলেই ফেলে দিয়ে ব্লগিং এ ঢুকে পড়ি। এখানে উদ্দেশ্যটা ভাল হলেও আমার যথেচ্ছ ব্যবহার এর ভাল দিকটা নষ্ট করে দিচ্ছে। তারপর ফাঁকি দিচ্ছি – এই বোধটা আসামাত্রই শয়তান যুক্তি দিতে থাকে, ‘না! এটা ত ভাল কাজ, পড়াশুনা ত পরেও করতে পারবে, এই মুহুর্তে এই লেখাটা না লিখলে পরে আর লেখা হবেনা…’

রোজার সময় আমি যেটা করার চেষ্টা করব, তা হচ্ছে, যতবারই কাজ ফেলে ব্লগিং এ মাথা গুঁজতে ইচ্ছা করবে, একটা খাতায় লিখে ফেলব, কেন এখনই ব্লগে যেতে হবে। পাশে সময়টাও লিখে রাখব, আর সে সময় কী কাজে ব্যস্ত ছিলাম, ওটাও! আশা করা যায় আমার নফস, যে কিনা সব রকমের নিয়ম কানুনের বিরূদ্ধে সদা বিদ্রোহী, সে রোজার সময় অনেক সংযত থাকবে, তালিকা বানানো নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে দেবে না। এবার দিন শেষে তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করব, এর মধ্যে সবগুলোই কি দরকারি, না কাজে ফাঁকি দেয়ার ছুতোও আছে? ভাগ্য ভাল, শয়তান নেই, থাকলে আমাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ত, যে এর চেয়ে জরুরি কিছু পৃথিবীতে হতেই পারেনা। শয়তানের যুক্তি বোধ ত আমার চেয়ে ভাল হবেই, তার কত যুগের অভিজ্ঞতা!

এভাবে করে আমরা প্রত্যেকেই যার যার বদভ্যাসগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি। নামাযে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দু’আ করতে পারি, “আল্লাহ, এ মাসে নিজেকে বদলানো সবচেয়ে সহজ, তুমি আমার জন্য আরো সহজ করে দাও!” তারপর আল্লাহ রোজা রাখার মত সুস্থ শরীর আর মন দিয়েছেন, এই কৃতজ্ঞতায় দিনের বেলাটা যে যেই কাজই করিনা কেন, চাকুরি, পড়াশুনা, ঘরের কাজ – সেটা আরো যত্ন করে করতে পারি। এতে করে আমাদের প্রাত্যহিক কাজগুলিও ইবাদতের মর্যাদা পাবে। আল্লাহ খুশি হবেন, আমার বান্দা রোজাও রাখছে, কুরআন ও পড়ছে, শরীরের সদকাও করছে, আবার পৃথিবীর দায়িত্বগুলো ভুলে যায়নি, সেটাও করছে সুন্দর করে। আল্লাহ তা’আলা এমনিতেই রহমত আর মাগফিরাত দিয়ে পূর্ণ, এরকম একটা মাসে বান্দাদের এত সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ ইবাদত দেখলে তিনি কতটা খুশি হবেন, ফেরেশতাদের কত কতবার করে বলবেন… কল্পনা করতেই খুব ভাল লাগে!

লেখিকা সম্পর্কে: নূসরাত রহমান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মেরিল্যান্ডে বায়োলজিতে পিএইচডি করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজির ছাত্রী ছিলেন তিনি । বিজ্ঞান থেকে যুক্তি ও বিশ্লেষণ শিখে পারিপার্শ্বিকতার কাছ থেকে দর্শন ও মূল্যবোধ গ্রহনের মাধ্যমে তিনি তার উপলব্ধিকে লেখার উপজীব্য করেছেন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

মুসলিম চরিত্রে রমযানের কাঙ্খিত প্রভাব – পর্ব ২

পর্ব ১ | পর্ব ২

দ্বিতীয় শিক্ষা: আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় করা

বিভিন্ন ধরনের ইবাদত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাথে আমাদের বন্ধন প্রতিষ্ঠার উপায়। রমযানে এই ইবাদতগুলো পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যেন আমরা এই মাস শেষে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের উচ্চতর স্তরে অবস্থান করতে পারি। খাদ্য ও পানীয় দেহের পুষ্টির উৎস, মনের খাদ্য হচ্ছে জ্ঞান, আর অন্তেরর প্রয়োজন হচ্ছে ঈমান এবং আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা। রমযানে অধিক ইবাদতের দ্বারা আমরা ইবাদতকে আমাদের জীবনের মৌলিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণের শিক্ষা পাই। কুরআনে যেমনটি বলা হচ্ছে: “নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার ত্যাগ, আমার জীবন-মরণ, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। [সূরা আল আনআম, ৬:১৬২]

এরকমই হচ্ছে একজন প্রকৃত মুসলিমের জীবন। রমযানে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য এক মাসে কুরআন ‘খতম’ করা নয়। বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বাণীর সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীরতর করা, যদি কুরআনের বাণী আমাদের অন্তেরে স্থান করে নিতে পারে, তবে তা আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে। অধিক পরিমান কুরআন তিলাওয়াৎ শোনার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে শয়তানের কুরআন থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া। শয়তানের কুরআন [আরবী পরিভাষায় কুরান অর্থ হচ্ছে তিলাওয়াৎ, এখানে ভাষাগত অর্থটিকে ইংগিত করা হয়েছে] হচ্ছে গান-বাজনা, গল্প-উপন্যাস, সিনেমা-নাটক ইত্যাদি যেগুলো আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে না, এগুলো আমাদেরকে আনন্দ দান করলেও আল্লাহ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নেয়। তাই রমযানে আল্লাহর কুরআনের নিকটবর্তী হওয়া এবং শয়তানের কুরআন থেকে দূরবর্তী হওয়ার দ্বিমুখী সাধনা চালাতে হবে।

রমযানে বেশী বেশী করে আমরা রাতের নফল সালাত আদায় করি, যেন রমযানের পরও তা আমাদের অভ্যাস হিসেবে থেকে যায়, কেননা সমস্ত সালাতের ভিতর রাতের সালাতই সবচেয়ে একনিষ্ঠভাবে আদায় করা সম্ভব, যখন কেউ আমাদের দেখতে পায় না, এই একনিষ্ঠতা অন্যান্য সালাতে অর্জন করা খুবই কষ্টসাধ্য। তেমনি এ মাসে ধার্মিক লোকদের সাহচর্য বৃদ্ধি পায়, আমরা রোযাদারদের সাথে বসে একত্রে ইফতার করি, এবং রোযাদারেরা একে অপরকে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে থাকে। আমাদের উচিৎ এ মাসে বেশী বেশী করে আল্লাহভীরু, ধার্মিক লোকদের সাহচর্য লাভে সচেষ্ট হওয়া, বেশী বেশী করে সে সব স্থানে যাওয়া, যেখানে জ্ঞানের কথা আলোচিত হয়।

তৃতীয় শিক্ষা: সবর এবং ইচ্ছাশক্তি

যদিও মুসলিম সমাজে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতির রোযায় সবর ও ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন নেই। কেননা ইফতার এবং সেহরীতে পেটভরে খেয়ে এবং সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালে তাতে বিশেষ কষ্টের কিছু নেই। এতে কেবল দৈনন্দিন রুটিন পরিবর্তিত হয়ে রাত পরিণত হয় দিনে আর দিন রাতে। পারিভাষিক অর্থে একে রোযা বলে সংজ্ঞায়িত করা গেলেও এটা প্রকৃত সিয়াম নয়। এধরনের সিয়াম সবর করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে না। এতে সেই সবর অর্জিত হবে না, যেই সবর এই জীবনের পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমনটি আল্লাহ সূরা আল আসরে বর্ণনা করেছেন: “সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই সকল মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, এবং পরস্পরকে সত্যের প্রতি আহবান জানায় এবং পরস্পরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়।”[সূরা আল আসর, ১০৩:১-৩]

এখানে বলা হচ্ছে সবর সাফল্যের চাবিকাঠি। এবং প্রকৃত সবরকারীর প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত।

চতুর্থ শিক্ষা: রিয়া থেকে বাঁচা

রিয়া অত্যন্ত ভয়ানক ব্যাপার। যদি আমরা অন্যদের দেখানোর জন্য আমল করি, তবে বাহ্যত একে উত্তম আমল বলে গণ্য করা হলেও আমাদের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই রিয়ার কারণে। রাসূল (সা) বলেছেন: “তোমাদের জন্য আমি যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি, তা হল ছোট শিরক বা শিরক আল আসগার।” সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, ছোট শিরক কি?” তিনি উত্তর দিলেন, “রিয়া (লোক দেখানোর জন্য কাজ করা), নিশ্চয়ই আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে প্রতিদান দেওয়ার সময় লোকদের বলবেন, ‘পার্থিব জীবনে যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা কাজ করেছিলে, তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পার কিনা।’” (আহমাদ, বায়হাকী)। ইবন আব্বাস (রা) এ সম্পর্কে বলেন, “কোন চন্দ্রবিহীন মধ্যরাতের অন্ধকারে কালো পাথরের উপর কালো পিঁপড়ার চুপিসারে চলার চেয়েও গোপন হচ্ছে  রিয়া।” (ইবন আবী হাতিম)। রোযার মাধ্যমে প্রতিটি কাজ বিশুদ্ধভাবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করার শিক্ষা হয়, কেননা প্রকৃত সিয়াম অন্যকে দেখানোর জন্য হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সিয়ামের বিষয়টি বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না। একটি হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন: “আদম সন্তানের সকল কাজই তার নিজের জন্য, সিয়াম ব্যতীত। এটা শুধুই আমার জন্য, এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।”

পঞ্চম শিক্ষা: নৈতিক চরিত্র গঠন

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “যে রোযা অবস্থায় মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার ওপর আচরণ করা থেকে বিরত হল না, তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” এ মাসে আমরা অধিক ভাল কাজ করার এবং খারাপ কাজ থেকে অধিক পরিমাণে বিরত থাকার চেষ্টা করি। আমরা খারাপ কথা ও কাজ পরিহার করি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেন: “তোমাদের কেউ রোযা অবস্থায় যেন অশ্লীল কাজ ও অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকে, এবং যদি কেউ কোন অশ্লীল কথা শুরু করে কিংবা তর্ক করতে আসে, তবে সে যেন তাকে বলে: ‘আমি রোযাদার।’” তেমনি আমাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে আনার শিক্ষা হয় এই রমযান মাসে। তাই সিয়াম আমাদের চোখ, কান, হাত ও জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার মাধ্যমে আমাদের নৈতিক চরিত্রে উন্নতি ঘটায়। আমরা যদি রোযা রেখেও হারাম কথা, কাজ কিংবা হারাম দৃশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত বন্ধ না করি, তবে এই সিয়াম আমাদের নেক কাজের পাল্লায় যোগ না হয়ে যোগ হবে অন্যায়ের পাল্লায়, যার জন্য কিয়ামতের দিন আমাদের শাস্তি পেতে হবে।

ষষ্ঠ শিক্ষা: এটা উপলব্ধি করা যে পরিবর্তন সম্ভব

আমরা যখন বর্তমান মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকাই, আমরা সর্বত্র দেখতে পাই নৈতিক অবক্ষয়, ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিদাত, শিরক প্রভৃতির প্রাচুর্য, মুসলিমরা ইসলাম থেকে এতই দূরে, যে কারও পক্ষে ‘কোন আশা নেই’ এ কথা বলে বসা অসম্ভব নয়। এ অবস্থার যেন ক্রমাবনতি ঘটছে। এর সমাধান হচ্ছে মুসলিমদেরকে পরিবর্তন হতে হবে, কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? রমযান আমাদের বলছে যে এটা সম্ভব। আমরা রমযানের ফজরে দেখতে পাই মসজিদ পরিপূর্ণ, অথচ অন্যান্য মাসে তা ফাঁকা থাকে। যদিও এদের মাঝে কিছু লোক কেবল “রমযান মুসলিম”, কিন্তু অনেকেই প্রকৃত ঈমানদার, যারা রমযানে সচেতন হয়ে ওঠে। তেমনি কুরআনের ওপর জমে থাকা ধূলো সরে যায়, এবং কুরআন বেশী বেশী করে তিলাওয়াৎ করা হয়। তেমনি মানুষের চরিত্রেও পরিবর্তন দেখা যায়। হয়ত ঝগড়াটে কোন ব্যক্তি এ মাসে নিজেকে সংযত করতে শেখে। তেমনি অনেক খারাপ কাজ যা অন্য মাসে ত্যাগ করা সম্ভব হয় না, তা এই মাসে সম্ভব হয়, যেমন অনেকে ধূমপান ত্যাগ করে থাকে। তাই রমযান আমাদের শেখায় যে মুসলিমরা নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে সক্ষম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এজন্য জিহাদকে রমযানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের নফসের বিরুদ্ধে, পরিবারে, সমাজে ও বিশ্বে অবস্থিত সকল কু-শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। একমাত্র এভাবেই পরিবর্তন আসা সম্ভব।

সপ্তম শিক্ষা: নিয়ন্ত্রণ

ক্ষুধা এবং যৌন বাসনা মানুষের চরিত্রে সবচেয়ে প্রবল দুটি বাসনা। এগুলোর ফলে মানুষ বহু বড় বড় পাপকাজে জড়িয়ে পড়ে। রোযা যেহেতু খাদ্য, পানীয় এবং যৌনাচার থেকে সংযম, তাই এর মাধ্যমে রোযাদারের আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন হয়। প্রকৃতপক্ষে রোযার শিক্ষা অর্জিত হয়েছে কিনা, তা বোঝার মুহূর্তটি হচ্ছে রোযা ভাঙ্গার মুহূর্ত। কেননা এসময় টেবিলে যাবতীয় মজাদার খাবার সাজানো থাকে, তাই রোযা ভেঙ্গেই মুখে প্রচুর পরিমাণে খাবার পোরার ইচ্ছে হয়, কিন্তু একজন মুমিনকে এসময় সংযত থাকতে হবে এবং নামাযের আগে হালকা কিছু মুখে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) তিনটি খেজুর এবং পানি দিয়ে রোযা ভাঙতেন, এবং মাগরিবের নামাযের পর, মাঝারি খাবার খেতেন। আত্মিক সংযমও রোযার লক্ষ্য। কেবল খাদ্য, পানীয় ইত্যাদিই নয়, রোযাদারকে মিথ্যা বলা, গীবত করা, দুর্নাম করা ইত্যাদি থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “যে রোযা অবস্থায় মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার ওপর আচরণ করা থেকে বিরত হল না, তার ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” তিনি (সা) আরও বলেছেন: “তোমাদের কেউ রোযা অবস্থায় যেন অশ্লীল কাজ ও অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকে, এবং যদি কেউ কোন অশ্লীল কথা শুরু করে কিংবা তর্ক করতে আসে, তবে সে যেন তাকে বলে: ‘আমি রোযাদার। তাই উপরোক্ত দিক নির্দেশনা মেনে যে রোযা রাখবে, তার নৈতিক চরিত্রে উন্নতি ঘটবে, সে অধিকতর সত্যবাদী এবং কথা ও কাজে আরও সতর্ক হবে।

অষ্টম শিক্ষা:মধ্যপন্থা

যেহেতু রোযা ভাঙার সময় একজন রোযাদার নিজেকে সংযত রাখে, ফলে তার খাদ্যাভাসে মধ্যপন্থা গড়ে ওঠে, যেমনটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে বলেছেন: “মুমিন এক পেটে, কাফির (যেন) সাত পেটে খায়।” জাবির (রা) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, “একজনের খাদ্য দুইজনের জন্য যথেষ্ট, দুইজনের খাদ্য চারজনের জন্য যথেষ্ট।” ইবন উমার (রা) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাউকে সঙ্গীর অনুমতি ব্যতীত খাওয়ার সময় একেকবারে দুটো করে খেজুর নিতে নিষেধ করেছেন।

নবম শিক্ষা: সহমর্মিতা

রোযা একজন মানুষকে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করায়, ফলে সে দরিদ্রের অবস্থা বুঝতে পারে। এর ফলে তার মাঝে দরিদ্রকে সহায়তা করার এবং তাদেরকে নিজ সম্পদের ভাগ দেয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। আর এই চেতনার নমুনা হিসেবেই ঈদুল ফিতরের দিনে অভাবীকে নির্দিষ্ট পরিমাণে দান করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর যখন আমরা উপলব্ধি করব যে আমাদের এই কষ্ট ইচ্ছাকৃত, কিন্তু দরিদ্রদের কষ্ট অনিচ্ছাকৃত, তারা চাইলেও খেতে পায় না, তখন আমরা অধিকতর সহমর্মিতা অর্জন করতে পারব।

পর্ব ১ | পর্ব ২

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

রমজান মাসের ৩০ আমল

লিখেছেন: হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল  |  সম্পাদনা: ড.আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

রমাদান মাস আল্লাহ তা‘আলা এক বিশেষ নিয়ামাত। সাওয়াব অর্জন করার মৌসুম। এ মাসেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, রহমাত, বরকত ও নাজাতের মাস-রমাদান মাস। আলকুরআনে এসেছে: ‘‘রমাদান মাস, যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৫]

রমাদান মাসের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘রমাদান- বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোযা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃংখলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল (মহা কল্যাণ হতে)’’ [সুনান আত-তিরমিযি: ৬৮৩]

এ মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে, যেগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা জান্নাতে যেতে পারি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। নিম্নে রমাদান মাসের আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

তবে এ আমলগুলো করার জন্য শর্ত হলো:

এক:- ইখলাস অর্থাৎ ‘‘একনিষ্ঠতার সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যে আমল করা। সুতরাং যে আমল হবে টাকা উপার্জনের জন্য, নেতৃত্ব অর্জনের জন্য ও সুনাম-খ্যাতি অর্জনের জন্যে সে আমলে ইখলাস থাকবে না অর্থাৎ এসব ইবাদাত বা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না বরং তা ছোট শির্কে রূপান্তরিত হতে পারে। আল-কুরআনে এসেছে: “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে” [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ : ৫]

দুই:- ইবাদাতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ। সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সকল ইবাদাতের কথা উল্লেখ আছে সেগুলো পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। কারণ, ইবাদাত হচ্ছে তাই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়ে দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে:‘এবং রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও’ [সূরা হাশর: ৭]

এ বিষয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে’’। [সহীহ মুসলিম : ৪৫৯০]

রমাদান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো:-

[১] সিয়াম পালন করা:  ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি রুকন হল সিয়াম। আর রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ। সেজন্য রমাদান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন: “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে, মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে” [সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫]

সিয়াম পালনের ফযিলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’ [সহীহ বুখারী : ২০১৪]

‘‘যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সিয়াম পালন করবে, তাদ্বারা আল্লাহ তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে সত্তর বছরের রাস্তা পরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন’’। [সহীহ মুসলিম : ২৭৬৭]

[২] সময় মত সালাত আদায় করা: সিয়াম পালনের সাথে সাথে সময় মত নামায আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ [সূরা নিসা : ১০৩]

এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে:আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামায আদায় করা। [সহীহ মুসলিম : ২৬৩]

[৩] সহীহভাবে কুরআন শেখা: রমাদান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম আমল হলো সহীহভাবে কুরআন শেখা। আর কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে:‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’’ [সূরা আলাক : ১]

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন:‘‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’’ [মুসনাদ আলজামি : ৯৮৯০]

 [৪] অপরকে কুরআন পড়া শেখানো: রমাদান মাস অপরকে কুরআন শেখানোর উত্তম সময়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৫০২৭]

‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দিবে, যত তিলাওয়াত হবে তার সাওয়াব সে পাবে’ [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ : ০৭]

[৫] সাহরী খাওয়া: সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে: ‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন’ [মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১, সহীহ]

[৬] সালাতুত তারাবীহ পড়া: সালাতুত তারাবীহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবীহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হাদীসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমাদানে কিয়ামু রমাদান (সালাতুত তারাবীহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [সহীহ আল-বুখারী : ২০০৯]

তারাবীহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে আছে: ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবীহ) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে’’ [সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭, সহীহ]

তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই লিংক গুলো দেখতে পারেন: 
  1. http://islamqa.info/bn/9036
  2. http://islamqa.info/en/82152
  3. http://islamqa.info/en/38021

[৭] বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা: এটি কুরআনের মাস। তাই এ মাসে অন্যতম কাজ হলো বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’’ [সুনান আত-তিরমিযী: ২৯১০, সহীহ]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাদান ব্যতীত কোন মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘‘রমাদান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোযা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি’’ [সহীহ মুসলিম : ১৭৭৩]

 [৮] শুকরিয়া আদায় করা: রমাদান মাস পাওয়া এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং আগামী রমাদান পাওয়ার জন্য তাওফীক কামনা করা। রমাদান সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে: ‘‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৫]

‘‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’।’’ [সূরা ইবরাহীম : ৭]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে বলতেন অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য [সুনান আত-তিরমিযী : ২৭৩৮]

[৯] কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা: এ মাসটিতে একটি ভাল কাজ অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভাল কাজ করতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৬৮৪]

 [১০] সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া: রমাদান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমাদানের কারণে আরো বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমাদান মাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ [সহীহ মুসলিম : ২৮১২]

[১১] বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা: এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]

[১২] উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা: রমাদান মাস নিজকে গঠনের মাস। এ মাসে এমন প্রশিক্ষণ নিতে হবে যার মাধ্যমে বাকি মাসগুলো এভাবেই পরিচালিত হয়। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশস্নীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, আমি রোযাদার’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৫১]

[১৩] ই‘তিকাফ করা: ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘প্রত্যেক রমাযানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমযানে তিনি ইতিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’ । দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত। [সহীহ আলবুখারী : ২০৪৪]

[১৪] দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা: রমাদান মাস হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াতের সর্বোত্তম মাস। আর মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকাও উত্তম কাজ। এজন্য এ মাসে মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার জন্য আলোচনা করা, কুরআন ও হাদীসের দারস প্রদান, বই বিতরণ, কুরআন বিতরণ ইত্যাদি কাজ বেশি বেশি করা। আলকুরআনের ঘোষণা : ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’ [সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৩৩]

হাদীসে এসেছে:‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’ [সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]

 [১৫] সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা: এ মাসে একটি উমরা করলে একটি হাজ্জ আদায়ের সমান সাওয়াব হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘রমাদান মাসে উমরা করা আমার সাথে হাজ্জ আদায় করার সমতুল্য’’ [সহীহ আলবুখারী : ১৮৬৩]

[১৬] লাইলাতুল কদর তালাশ করা: রমাদান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল-কুরআনের ঘোষণা: ‘‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’’ [সূরা কদর : ৪]

হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব পাওয়ার আশায় ইবাদাত করবে তাকে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৩৫]

এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রমদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৭৫]

 লাইলাতুল কদরের দো‘আ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর নবী ! যদি আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই তবে কি বলব ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বলবেঃ ‘‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৩৫১৩]

[১৭] বেশি বেশি দো‘আ ও কান্নাকাটি করা: দো‘আ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দো‘আ করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। হাদীসে এসেছে: ‘‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমাদানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে’’ [আল জামিউস সাগীর : ৩৯৩৩]

অন্য হাদীসে এসেছে: ‘‘রমযানের প্রতি দিবসে ও রাতে আল্লাহ তা‘আলা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিবসে প্রতি মুসলিমের দো‘আ কবূল করা হয়’’ [সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ১০০২]

 [১৮] ইফতার করা: সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ আমল। কোন বিলম্ব না করা । কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র ’’ [সুনান আবু দাউদ : ২৩৫৭, সহীহ]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : “পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।” [সুনান আবূ-দাউদ: ২৩৫৯, সহীহ]

অপর বর্ণনায় যে এসেছে- “হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” এর সনদ দুর্বল। আমাদের উচিত সহীহ হাদীসের উপর আমল করা। [সুনান আবু দাউদ :২৩৫৮] 

 [১৯] ইফতার করানো: অপরকে ইফতার করানো একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে ইফতার করানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’’ [সুনান ইবন মাজাহ : ১৭৪৬, সহীহ]

 [২০] তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা: তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এ মাস তাওবাহ করার উত্তম সময়। আর তাওবাহ করলে আল্লাহ খুশী হন। আল-কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাটি তাওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত’’ [সূরা আত-তাহরীম : ৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি’’ [সহীহ মুসলিম : ৭০৩৪]

 তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে ‘‘হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের উপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃত-কর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অত:এব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’

ফযিলাত: ‘‘যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৬৩০৬]

 [২১] তাকওয়া অর্জন করা: তাকওয়া এমন একটি গুণ, যা বান্দাহকে আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করে। আর রমাদান মাস তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করার এক বিশেষ মৌসুম। কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা এর মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩]

যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। [সূরা তালাক : ০২]

 [২২] ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা:ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা। এটি একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ফজর জামাআত আদায় করার পর সূর্য উদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করবে, অতঃপর দুই রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে পরিপূর্ণ হাজ্জ ও উমারাহ করার প্রতিদান পাবে। [সুনান আত-তিরমিযী : ৫৮৬]

 [২৩] ফিতরাহ দেয়া: এ মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেয়া আবশ্যক। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাত আদায়ের পুর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন। [সহীহ আল-বুখারী :১৫০৩]

 [২৪] অপরকে খাদ্য খাওয়ানো: রমাদান মাসে লোকদের খাওয়ানো, বিশেষ করে সিয়াম পালনকারী গরীব, অসহায়কে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সাওয়াবের কাজ । কুরআনে এসেছে: তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। [সূরা আদ-দাহর: ৮]

এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১২]

অপর বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে :‘‘যে কোনো মুমিন কোনো ক্ষুধার্ত মুমিনকে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। [বাইহাকী, শু‘আবুল ইমান : ৩০৯৮, হাসান]

 [২৫] আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তা রক্ষা করাও একটি ইবাদাত। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘‘আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আরও তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা: ১]

আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“সালাম বিমিয়ের মাধ্যমে হলেও আত্নীয়তার সম্পর্ক তরতাজা রাখ।” [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবওয়িয়্যাহ : ১৩]

 [২৬] কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা: কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এ দায়িত্ব মূলত বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোর মাধ্যমেই সম্পাদন করেন। কুরআনে এসেছে: ‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ [সূরা আল-হিজর: ৯]

যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম।আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘কুরআনের ধারক-বাহককে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হবে” [সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]

[২৭] আল্লাহর যিকর করা: এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলো যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি  পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি  পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে পড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। [মুসনাদ আহমাদ : ১১৩৪৫]

[২৮] মিসওয়াক করা: মেসওয়াকের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদীসে এসেছে: অর্থাৎ মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী, এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রেখেও মেসওয়াক করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। [সহীহ ইবন খুযাইমাহ : ১৩৫]

 [২৯] একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো: রমাদান মাসে একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো একটি উত্তম আমল। এটিকে দাওর বলা হয়। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে: জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমাদানের প্রতি রাতে রমাদানের শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল তাকে কুরআন শোনাতেন[সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]

ইবনে হাজার রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রমযান হতে অন্য রমযান অবধি যা নাযিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসূলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন ।

[৩০] কুরআন বুঝা ও আমল করা: কুরআনের এ মাসে কুরআন বুঝা ও আমল করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে: ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’। [সূরা আল-আ‘রাফ : ৩]

কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: ‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম’ [শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০]

যা করণীয় নয়:

রমাদান মাসের ফজিলত হাসিল করার জন্য এমন কিছু কাজ রয়েছে যা থেকে বিরত থাকা দরকার, সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

1. বিলম্বে ইফতার করা
2. সাহরী না খাওয়া
3. শেষের দশ দিন কেনা কাটায় ব্যস্ত থাকা
4. মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ করা
5. অপচয় ও অপব্যয় করা
6. তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা
7. জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা
8. বেশি বেশি খাওয়া
9. রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা
10. বেশি বেশি ঘুমানো
11. সংকট তৈরি করা জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য
12. অশ্লীল ছবি, নাটক দেখা
13. বেহুদা কাজে রাত জাগরণ করা
14. বিদ‘আত করা
15. দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন থাকা

প্রিয় পাঠক!

রমাদান মাস পাওয়ার মত সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে! আমরা যদি এ মাসের প্রতিটি আমল সুন্নাহ পদ্ধতিতে করতে পারি তবেই আমাদের রমাদান পাওয়া সার্থক হবে।কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেলো অথচ তার গুনাহ মাফ করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক।’’ [শারহুস সুন্নাহ : ৬৮৯] আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রমাদান মাসের ফজিলত হাসিল করার তাওফীক দিন। 

আমীন!

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe