আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ – পর্ব ৩

1
950

লেখক: আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ্ আল-উসাইমীন | অনুবাদ: আব্দুল আলীম বিন কাউসার

পর্ব-১ | পর্ব-২ | পর্ব-৩

কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশী দিল বা নিল, সে সুদী কারবার করল।[1]

এক্ষণে, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক দলীল হিসাবে পেশকৃত হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কি হবে?

আমাদের ভূমিকা হবে, হাদীছটাকে আমরা এমন অর্থে গ্রহণ করব, যাতে ‘রিবাল ফায্‌ল’-কে সুদ গণ্যকারী হাদীছের সাথে এই হাদীছও মিলে যায়। সেজন্য আমরা বলব: মারাত্মক সুদ হচ্ছে, ‘রিবান নাসীআহ’- যার কারবার জাহেলীযুগের লোকেরা করত এবং যে সম্পর্কে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেওনা।[2] তবে ‘রিবাল ফায্‌ল’ তদ্রুপ মারাত্মক নয়। [3] সে কারণে ইবনুল ক্বাইয়িম রহেমাহুল্লাহ তাঁর [জগদ্বিখ্যাত] গ্রন্থ ‘এ‘লামুল মুওয়াক্কেঈন’ إعلام الموقعين-এ বলেন, মূল সুদের অন্যতম মাধ্যম হওয়ার কারণে ‘রিবাল ফায্ল’-কে হারাম করা হয়েছে। সেটাই যে মূল সুদ, সে হিসাবে নয়।

কারণ ৭:

আলেম যঈফ হাদীছকে [দলীল হিসাবে] গ্রহণ করেন অথবা [দলীল শক্তিশালী, কিন্তু] তাঁর দলীলের বুঝ্ বা উপলব্ধিটা দুর্বল

আর এমন ঘটনা বহু ঘটে থাকে। যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশের অন্যতম একটা উদাহরণ হচ্ছে, কোন কোন আলেম ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’-কে উত্তম বলেন। ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ হচ্ছে, দুই রাক‘আত নামায আদায়- যাতে দণ্ডায়মান অবস্থায় সূরা ফাতিহা এবং ১৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয়। অনুরূপভাবে রূকূ ও সিজদাহ সহ নামাযের শেষ পর্যন্ত সব জায়গায় তাসবীহ পাঠ করা হয়। আসলে ঐ নামাযের নিয়ম-কানুন আমি ভালভাবে রপ্ত করিনি। কারণ শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেটাকে ঠিক মনে করি না। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ জঘন্য বিদআত এবং এ মর্মের হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আহমাদ রহেমাহুল্লাহ এ মতের পক্ষে। তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে উহা সাব্যস্ত নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ রহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ সংক্রান্ত হাদীছ হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উপর মিথ্যা রটনা।

আর বাস্তবেই যিনি এ সম্পর্কে গবেষণা করবেন, তিনি দেখবেন যে, এমনকি শরী‘আতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইহা অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম একটা বিধান। কেননা ইবাদত হয় অন্তরের জন্য উপকারী হবে নতুবা উপকারী হবে না। আর উপকারী হলে সব সময় এবং সব জায়গায় তা শরীআতসম্মত হবে। পক্ষান্তরে উপকারী না হলে শরীআতসম্মত হবে না। আর যে হাদীছে এই নামায সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ প্রত্যেক দিন, অথবা সপ্তাহে একদিন অথবা মাসে একদিন বা জীবনে অন্ততঃ একদিন আদায় করবে। ইসলামী শরী‘আতে এরকম আর কোন ইবাদত নেই। সেজন্য এ সংক্রান্ত হাদীছ সনদ এবং মতন উভয় দিক থেকেই ব্যতিক্রম এবং শায়খুল ইসলামের মত যিনি সেগুলোকে মিথ্যা বলেছেন, তাঁর বক্তব্যই সঠিক।

আর সেকারণেই শায়খুল ইসলাম বলেন, কোন আলেমই এই নামাযকে উত্তম বলেন নি। নারী-পুরুষ কর্তৃক ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় বলে আমি এই উদাহরণটা পেশ করেছি। এই বিদ‘আতী আমল শরীআতসম্মত গণ্য করা হবে মর্মে আমি ভয় পেয়েছি। কিছু কিছু মানুষের কাছে ভারী মনে হতে পারে ভেবেও আমি উহাকে বিদ‘আতই বলছি। কেননা কুরআন ও হাদীছে নেই এমন যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, তা-ই বিদআত।

দলীল শক্তিশালী কিন্তু দলীলের বুঝ বা উপলদ্ধিটা দুর্বল হওয়ার উদাহরণঃ হাদীছে এসেছে, ‘গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করাই হল গর্ভস্থ বাচ্চাকে যবেহ করা।[4] আলেম সমাজের নিকট এই হাদীছের প্রসিদ্ধ অর্থ হল, যদি গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করা হয়, তাহলে সেই যবেহ গর্ভস্থ বাচ্চার জন্যও যবেহ হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ মাকে যবেহ করার পর যখন বাচ্চাকে পেট থেকে বের করা হবে, তখন তাকে আর যবেহ করার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা বাচ্চা ইতিমধ্যে মারা গেছে। আর মারা যাওয়ার পর যবেহ করায় কোন লাভ নেই।

আবার কেউ কেউ হাদীছটার অর্থ এরূপ বুঝেছেন যে, গর্ভস্থ বাচ্চাকে তার মায়ের মত করেই যবেহ করতে হবে। ঘাড়ের দুই রগ কেটে দিতে হবে এবং রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। কিন্তু এটা অবাস্তব। কারণ মৃত্যুর পর রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং আল্লাহর নামে যবেহ করা হয়, তা খাও।[5] আর একথা স্পষ্ট যে, মৃত্যুর পরে রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। কিনারা বিহীন সাগরের মত অসংখ্য কারণের মধ্যে উক্ত কারণগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমি ভাল মনে করেছি। কিন্তু এত কিছুর পরে আমাদের ভূমিকা কি হবে?

আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি, শ্রবণযোগ্য, পঠনযোগ্য, দর্শনযোগ্য ইত্যাকার নানা প্রচার মাধ্যম এবং এই প্রচার মাধ্যমগুলোতে আলেম ও বক্তাগণের মতানৈক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সন্দীহান হয়ে পড়ছে আর বলছে, আমরা কার অনুসরণ করব? কবি বলেন: ‘শিকারী কুকুরের নিকট হরিণ এতই বেশী হয়ে গেছে যে, সে কোন্‌টা ছেড়ে কোন্‌টা শিকার করবে তা বুঝতেই পারছে না’।

এক্ষণে এসব মতানৈক্যের ব্যাপারে আমরা আমাদের ভূমিকার কথা আলোচনা করব এখানে আমরা আলেমগণের মতানৈক্য বলতে ঐসকল আলেমকে বুঝিয়েছি, যাঁরা ইলম ও দ্বীনদারিতায় নির্ভরযোগ্য। যাঁদেরকে আলেম মনে করা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা আলেম নয়- এমন সব ব্যক্তির মতানৈক্য আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কেননা তাদেরকে আমরা আলেম মনে করি না এবং প্রকৃত আলেমগণের উক্তিসমূহ যেমন সংরক্ষণ করা হয়, আমরা তাদের উক্তিসমূহকে সেই পর্যায়ের মনে করি না। সেজন্য যেসব আলেম মুসলিম উম্মাহ, ইসলাম ও ইল্‌ম বিষয়ে [মানুষকে] হিতোপদেশ দিয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন, আমরা আলেম বলতে তাঁদেরকেই বুঝি। ঐসব আলেমের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা দুইভাবে হতে পারেঃ-

. [আমাদেরকে জানতে হবে] ঐ সকল আলেম আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত মোতাবেক কোন বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কেন তদ্বিষয়ে মতানৈক্য করেছেন? মতানৈক্যের যেসব কারণ আমরা উল্লেখ করেছি এবং যেগুলো উল্লেখ করিনি, সেগুলোর মাধ্যমে এর জবাব জানা যেতে পারে। আর সেই কারণগুলো আসলে অনেক- যা শরী‘আতের জ্ঞান পিপাসুর নিকট স্পষ্ট, যদিও তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী না হন।

. [এরপর দেখতে হবে] তাঁদের অনুসরণের ব্যাপারে আমাদের করণীয় কি হবে? তাঁদের মধ্যে আমরা কার অনুসরণ করব? মানুষ কি কোন ইমামের এমন অনুসরণ করবে যে, তাঁর কথার বাইরে যাবে না- যদিও হক্ব অন্যের সাথে থাকে-যেমনটি মাযহাবসমূহের অন্ধ ভক্তদের স্বভাব, নাকি তার কাছে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলীলের অনুসরণ করবে- যদিও তা তার অনুসারী ইমামের বিরোধী হয়? এই দ্বিতীয়টাই সঠিক জবাব। সেজন্য যিনি দলীল জানতে পারবেন তার উপর সেই দলীলের অনুসরণ করা আবশ্যক- যদিও তা ইমামের বিরোধী হয়। তবে তা যেন ইজমার বিরোধী না হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো কথা সর্বাবস্থায় এবং সব সময় অবশ্য পালনীয়, সে অন্য কারো জন্য রিসালাতের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করল। কেননা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো কথার বিধান এমনটা হতে পারে না এবং অন্য কারো কথা সর্বদা শিরোধার্য হতে পারে না।

তবে এ বিষয়ে আরো একটু চিন্তাভাবনার বিষয় রয়েছে। কেননা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল থেকে কে হুকুম-আহকাম বের করবেন তদ্বিষয়ে আমরা এখনও গোলকধাঁধায়? এটা মুশকিলও বটে। কেননা প্রত্যেকেই বলছেন, আমি এই ক্ষমতার অধিকারী। এটা আসলে ভাল কথা নয়। যদিও কুরআন ও সুন্নাহ একজন মানুষের গাইড হবে- সে দিক বিবেচনায় সেটা ভাল কথা। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, অর্থ জানুক বা না জানুক কোন রকম দলীল উচ্চারণ করতে পারে এমন প্রত্যেকের জন্য আমরা দরজা খুলে দেব আর বলব, তুমি মুজতাহিদ [শরী‘আত গবেষক], যা ইচ্ছা তুমি তাই বলতে পার। এমনটা হলে ইসলামী শরীআত, মানব ও মানব সমাজে পচন ধরবে। এক্ষেত্রে মানুষ তিন ধরনেরঃ

  • প্রকুত আলেম– যাঁকে আল্লাহ ইল্‌ম ও উপলব্ধি দুটোই দান করেছেন।
  • [দ্বীনের] জ্ঞান পিপাসু- যার ইল্‌ম রয়েছে। কিন্তু [প্রথম শ্রেণীর] ঐ গভীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি পর্যন্ত তিনি পৌঁছতে পারেন নি।
  • সাধারণ মানুষ- যে কিছুই জানে না।

প্রথম প্রকার ব্যক্তি- শর‘ঈ বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে এবং মত পেশ করতে পারেন; বরং কারো বিরোধী হলেও তাঁর উপর দলীল অনুযায়ী বক্তব্য পেশ করা ওয়াজিব। কেননা তিনি তদ্বিষয়ে আদিষ্ট। মহান আল্লাহ বলেন, “…তবে তাদের মধ্যে তত্ত্বানুসন্ধিৎসুগণ ওটা উপলব্ধি করত।’[6] এই শ্রেণীর আলেমগণই কুরআন-সুন্নাহ থেকে হুকুম-আহকাম উদ্‌ঘাটনের অধিকারী- যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য বুঝেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি– যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন কিন্তু তিনি প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি, তার জন্য কোন দোষ নেই- যদি তিনি সাধারণ বিষয়গুলো এবং তাঁর কাছে যে জ্ঞানটুকু পৌঁছেছে তার অনুসরণ করেন। তবে তাঁকে খুব সতর্ক থাকতে হবে এবং তাঁর চেয়ে বড় আলেমকে জিজ্ঞেস করার ক্ষেত্রে মোটেও শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না। কেননা তিনি ভুল করতে পারেন এবং তার জ্ঞান সে বিষয় পর্যন্ত নাও পৌঁছতে পারে– যা কোন ‘আম’ [7] عام-কে ‘খাছ’ خاص করে দিয়েছে অথবা ‘মুতলাক্ব’ [8] مطلق-কে ‘মুক্বাইয়াদ’ مقيد করে দিয়েছে। অথবা মানসূখ হওয়া কোন বিষয়কে তিনি না জেনে মুহকাম মনে করছেন।

আর তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি যার কোন ইল্‌ম নেই–তার জন্য আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ”অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে।[9] অন্য আয়াতে এসেছে, ”অতএব জ্ঞানীদেরকে স্পষ্ট দলীল-প্রমাণসহ জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে।[10]

সুতরাং এই শ্রেণীর ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, জিজ্ঞেস করা। কিন্তু সে কাকে জিজ্ঞেস করবে? দেশে অনেক আলেম আছেন এবং সবাই বলছেন যে, তিনি আলেম অথবা সবার সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, তিনি আলেম! তাহলে কাকে জিজ্ঞেস করবে? আমরা কি বলব যে, যিনি সঠিকতার অধিকতর কাছাকাছি তোমাকে তাঁকে খুজে বের করতে হবে এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করে তাঁর কথা মেনে চলতে হবে? নাকি বলব, যে কাউকে ইচ্ছা তুমি জিজ্ঞেস করতে পার। কেননা নির্দিষ্ট কোন মাসআলায় কোন কোন সময় জ্ঞানে তুলনামূলক নিম্ন স্তরের আলেম তার চেয়ে উপরের স্তরের আলেমের চেয়ে বেশী তওফীকপ্রাপ্ত হতে পারেন?

আলেম সমাজ বিষয়ে বিভিন্ন মত দিয়েছেনঃ

কারো মতে, সাধারণ ব্যক্তির উপর তার এলাকার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আলেমকে জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। কেননা মানুষের শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেমন সে সবচেয়ে ভাল ডাক্তার খুঁজে, তেমনি এ ক্ষেত্রেও তা-ই করবে। কারণ জ্ঞান হল মনের ওষুধ। তুমি তোমার অসুখের জন্য যেমন ভাল ডাক্তার নির্ণয় কর, এক্ষেত্রেও তোমাকে ভাল আলেম নির্ণয় করতে হবে। দুটোর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই।

আবার কেউ কেউ বলেন, তার জন্য এটা আবশ্যক নয়। কেননা ভাল আলেম নির্দিষ্টভাবে প্রত্যকটা মাসআলায় তুলনামূলক নীচের স্তরের আলেমের চেয়ে জ্ঞানী নাও হতে পারেন। সেজন্য দেখা যায়, ছাহাবীগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম-এর যুগে মানুষ বেশী জ্ঞানী ছাহাবী থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলক কম জ্ঞানী ছাহাবীকে [অনেক সময়] জিজ্ঞেস করতেন।

এ বিষয়ে আমার অভিমত হল, সে দ্বীনদারিতায় ও জ্ঞানে তুলনামূলক উত্তম ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে। তবে সেটা তার জন্য ওয়াজিব নয়। কেননা তুলনামূলক বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি নির্দিষ্ট ঐ মাসআলায় ভুল করতে পারেন এবং তুলনামূলক কম জ্ঞানী ব্যক্তি সঠিক ফাতাওয়া দিতে পারেন। সুতরাং অগ্রগণ্যতার দিক থেকে সে জ্ঞান, আল্লাহভীতি ও দ্বীনদারিতায় অধিকতর সঠিকতার নিকটবর্তী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে।

পরিশেষে, আমি নিজেকে এবং আমার সমস্ত মুসলিম ভাইকে, বিশেষ করে ছাত্রদেরকে নসিহত করব, যখন কারো কাছে কোন মাসআলা আসবে, তখন সে যেন ভালভাবে না জেনে তড়িঘড়ি করে ফাতাওয়া না দেয়। যাতে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ না করে বসে। কারণ মুফতী মানুষ এবং আল্লাহর মধ্যে মাধ্যম হিসাবে আল্লাহর শরী‘আত প্রচার করে থাকেন। যেমনিভাবে হাদীছে এসেছে- রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী।[11] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘বিচারক তিন শ্রেণীর। তাঁদের এক শ্রেণীর বিচারক কেবল জান্নাতে যাবেন। আর তিনি হচ্ছেন, যিনি হক্ব জেনেছেন এবং তদনুযায়ী রায় দিয়েছেন।[12]

অনুরূপভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যখন তোমার কাছে কোন মাসআলা আসবে, তখন তুমি নিজের মনকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ করবে এবং তাঁর মুখাপেক্ষী হবে– যাতে তিনি তোমাকে বুঝার ও জানার শক্তি দেন। বিশেষ করে বেশীর ভাগ মানুষের কাছে সুপ্ত থাকে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয়ে।

আমার কতিপয় উস্তাদ আমাকে বলেছেন, কেউ কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তার বেশী বেশী ইস্তেগফার করা উচিৎ। মহান আল্লাহ বলেন: ”নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।[13] কেননা ইস্তেগফার পাপের পরিণাম দূর করার বিষয়টা নিশ্চিত করে– যে পাপ ইলম বিস্মৃত হওয়ার এবং মূর্খতার অন্যতম কারণ। মহান আল্লাহ বলেন: ”অতএব, তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদের উপর অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা কালামকে তার স্থান থেকে বিচ্যুত করে দেয় এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা তা থেকে উপকার লাভ করার বিষয়টা বিস্মৃত হয়েছে।[14]

ইমাম শাফেঈ রহেমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেন: ‘আমি আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির বিষয়ে ওকী‘ রহেমাহুল্লাহ-কে বললে তিনি আমাকে পাপ কাজ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেন এবং বলেন, জেনে রাখ! ইল্ম হচ্ছে আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোন পাপীকে দেওয়া হয় না।’

অতএব, ইস্তেগফার নিঃসন্দেহে আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে জ্ঞানদানের অন্যতম কারণ।

আল্লাহর কাছে আমার নিজের জন্য এবং আপনাদের জন্য তওফীক্ব ও সঠিকতা প্রার্থনা করছি। তিনি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কালেমায়ে ত্বাইয়্যেবাহ-এর উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। হেদায়েত দানের পর তিনি যেন আমাদের অন্তঃকরণকে বিপথগামী না করেন এবং আমাদেরকে তিনি যেন তার পক্ষ থেকে রহমত দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দাতা।

শুরুতে ও শেষে সবসময় মহান রব্বুল আলামীনের জন্য যাবতীয় প্রশংসা। আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবীবর্গের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।

পর্ব-১ | পর্ব-২ | পর্ব-৩


[1] . মুসলিম, ‘বরগা চাষ’ অধ্যায়, হা/১৫৮৮।

[2] . সূরা আলে-ইমরান ১৩০।

[3] ‘রিবাল ফাযল’ ‘রিবান নাসীআহ’-এর মত মারাত্মক না হলেও তা হারাম। সুতরাং কেউ যেন ইহাকে তুচ্ছজ্ঞান করে কোনক্রমেই সূদী কারবারে জড়িয়ে না পড়ে। কেননা, অপেক্ষাকৃত ছোট পাপ করতে করতে মানুষ কখন যে নিজের অজান্তেই অনেক বড় পাপ করে বসে, তা বলা যায় না। মনে রাখতে হবে, পরকালে সুদী কারবারের পরিণতি বড় কঠিন হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন!– [অনুবাদক]।

[4]. আবু দাঊদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/২৮২৮; তিরমিযী, ‘শিকার’ অধ্যায়, হা/১৪৭৬, তিনি হাদীছটাকে ‘ছহীহ’ বলেছেন; ইবনু মাজাহ, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৩১৯৯।

[5] . বুখারী, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৫৪৯৮; মুসলিম, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/১৯৬৮; আবু দাঊদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/২৮২৭; নাসাঈ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/৪৪০৩-৪৪০৪; ইবনু মাজাহ, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৩১৭৮।

[6] . সূরা আন-নিসা ৮৩।

[7] ‘আম’ ও ‘খাছ’-এর আলোচনা গত হয়ে গেছে।

[8] ‘মুতলাক্ব’ مطلق এমন শব্দ- যা একাধিক বস্তুকে শামিল করে, তবে একই সঙ্গে নয়। বরং এটার পরিবর্তে ওটা এই সূত্রে। যেমনঃ যদি বলা হয়, একজন পুরুষ, তাহলে তা সব পুরুষকে শামিল করবে। তবে একই সঙ্গে নয়; বরং একজন একজন করে।

‘আম’-এর সাথে ‘মুতলাক্ব’-এর পার্থক্য হল, ‘আম’ একই সঙ্গে একাধিক বস্তুকে শামিল করে।

পবিত্র কুরআন থেকে ‘মুতলাক্ব’-এর একটা উদাহরণঃ ‘যিহার’ ظهار-এর কাফফারাহ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘একটা দাসমুক্ত করবে’ [আল-মুজাদালাহ ৩]। কিন্তু এখানে কোন সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং দাস মুসলিম হোক বা কাফির হোক মুক্ত করলেই চলবে।

‘মুক্বাইয়াদ’ مقيد-এর পরিসর ‘মুতলাক্ব’-এর তুলনায় খানিকটা সংকুচিত। যেমনঃ মহান আল্লাহর বাণী, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ভুলক্রমে হত্যা করে, সে একজন মুমিন ক্রীতদাস মুক্ত করবে [আন-নিসা ৯২]। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ভুলবশতঃ হত্যার কাফফারাহস্বরূপ দাসমুক্তির কথা বলেছেন; কিন্তু দাস যেন মুমিন হয় সেই শর্ত জুড়ে দিয়ে দাসের ক্ষেত্রটা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন।–[অনুবাদক]

[9]. সূরা আল-আম্বিয়া ৭; সূরা আন-নাহ্‌ল ৪৩ ।

[10] . সূরা আন-নাহ্‌ল ৪৩-৪৪।

[11] . বুখারী, ‘ইলম’ অধ্যায়, অনু্চ্ছেদ নং ১০; আবু দাঊদ, ‘ইলম’ অধ্যায়, হা/৩৬৪১; ইবনু মাজাহ, ভূমিকা, হা/২২৩।

[12] . আবু দাঊদ, ‘বিচার’ অধ্যায়, হা/৩৫৭৩; ইবনু মাজাহ, ‘বিচার’ অধ্যায়, হা/২৩১৫।

[13] . সূরা আন-নিসা ১০৫-১০৬।

[14] . সূরা আল-মায়েদাহ ১৩।

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন