সবর: কী ও কেন – ২

2
4705

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব

সবর কী?

সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া বা বিরত রাখা। শরীয়তের ভাষায় সবর বলা হয়, অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেড়া থেকে বিরত রাখা। কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের ভেতরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের এক আত্মিক শক্তি যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ্য ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। জুনায়েদ বাগদাদী রহ. কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা।’

জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা, বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা।’ কারও মতে, ‘সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা।’ আবার কারও মতে, ‘বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর।’ এক বুযুর্গ এক ব্যক্তিকে অন্যের কাছে তার সমস্যা নিয়ে অনুযোগ করতে শুনলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি ভাই, স্রেফ যে দয়া করে না তার কাছে দয়াকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছো। এর বেশি কিছু করোনি।’  এ সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ করো, তখন মূলত সদয়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ করো।’

অভিযোগ করাটা দুই ধরনের। একটি হলো, আল্লাহ তা’আলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেন, ‘সে বলল, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’ [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৮৬] অপরটি হলো, নিজের মুখের বা শরীরের ভাষায় মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এটি সবর পরিপন্থী।

সবরের প্রকার

সবর তিন প্রকার। যথা :

প্রথম: আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। দ্বিতীয় : আল্লাহ তা’আলার নিষেধ এবং তার বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে অটুট ধৈর্য রাখা। এবং তৃতীয় : তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে ধৈর্য ধরা। এই তিন প্রকার সম্পর্কেই শায়খ আবদুল কাদির জিলানী রহ. তদীয় গ্রন্থ ‘ফুতুহুল গায়ব’ গ্রন্থে বলেন, ‘একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিতে হবে : কিছু আদেশ পালনে, কিছু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং তাকদীরের ওপর।’ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত লুকমান আলাইহিস সালামের বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৭]

লুকমান আলাইহিস সালাম যে ‘সৎকাজের আদেশ দাও’ বলেছেন, তার মধ্যে নিজে সৎ কাজ করা এবং অপরকে সৎ কাজের উপদেশ দেয়া— উভয়টি অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অসৎকাজে নিষেধ করার মধ্যেও উভয়টি রয়েছে। এখানে ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ শব্দই আমাদের এমন ধারণা দেয়। তাছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ বাস্তবায়িত হয় না, যতক্ষণ না আগে নিজে তা পালন করা হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, ‘বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে। যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম। আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে। যারা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না।’ [সূরা আর-রা’দ, আয়াত: ১৯-২২]

তাই বলে বিপদ কামনা করার বিধান নেই

বিপদে ধৈর্য ধরার ফযীলত অনেক। তাই বলে শরীয়তে বিপদ কামনা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কারণ, মুমিন সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে কখনো বিপদ প্রত্যাশা করতে পারে না। তবে বিপদ এসে পড়লে তাতে সে বিচলিতও হয় না; বরং ধৈর্য ধরে। বিপদের সময় দৃঢ়তা ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। যেমন বুখারী শরীফে আব্দুল্লাহ বিন আবূ আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যুদ্ধের দিনগুলোতে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষায় থাকলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তখন তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি হবার প্রত্যাশা করো না এবং আল্লাহ তা’আলার কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করো। তবে যখন তোমরা তাদের মুখোমুখি হও, তখন ধৈর্য ধর এবং সবর করো। আর জেনে রেখো, জান্নাত তরবারির ছায়া তলে।’ [বুখারী : ২৯৬৫; মুসলিম : ৪৬৪০। ] ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে শত্রু-সাক্ষাতের প্রত্যাশা করতে বারণ করেছেন। কারণ, সে জানে না সামনে কী ঘটবে আর বিপদে পরিত্রাণইবা পাওয়া যাবে কীভাবে। এ থেকে অপছন্দনীয় বিষয় প্রার্থনা করা এবং অপ্রিয় অবস্থা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিতে চাওয়ার নিষেধাজ্ঞা বুঝা যায়। এ জন্যই পূর্বসূরী নেককার ব্যক্তিগণ আল্লাহ তা’আলার কাছে বিপদাপদ ও পরীক্ষা থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন। কেননা সবাই সবসময় ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাতে পারে না।

আমরা তো সেই সাহাবীর কথা শুনে থাকবো যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত অবস্থায় যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন! এ জন্যই কিন্তু আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, ‘সুস্থ থাকবো আর শুকরিয়া আদায় করবো- এটাই আমার কাছে প্রিয় বিপদে থেকে সবর করার চেয়ে।’ [তাবরানী, মু’জামুল কাবীর : ১৭৬৬; বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান : ৪১২১] একজন প্রকৃত মুমিন কিন্তু সর্বাবস্থায় দৃঢভাবে এ কথা বিশ্বাস করে যে, সে যে অবস্থায় আছে, তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন মুসলিম শরীফে ছুহাইব বিন সিনান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থায়তেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, যখন সে আনন্দের উপলক্ষ পায়, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা হয় তার জন্য কল্যাণবাহী। আর যখন সে কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন সবর করে এবং ধৈর্যে অটল থাকে। ফলে এটিও তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।’ [মুসলিম : ৭৬৯২। ]

বিপদ মুমিনের নিত্যসঙ্গী

আমাদের মনে রাখতে হবে, মুমিনের পুরো জীবনই পরীক্ষায় ভরা। আল্লাহ তা’আলা যেমন ইরশাদ করেন, ‌’আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫] আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেন নি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেন নি ধৈর্যশীলদেরকে।’ [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪২] তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদকারী ও ধৈর্যশীল এবং আমি তোমাদের কথা— কাজ পরীক্ষা করে নেব।’ [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৩১] অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমাদেরকে কোনো আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না।’ [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪০] আল্লাহ তা’আলা আরও সুনির্দষ্ট করে বলেন, ‌’তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান।’ [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর শীষ্য ও সাহাবীদের সবর শিক্ষা দিয়েছেন। এটি বেশি করা হয়েছে মক্কী জীবনে। যেমন খুবাইব বিন আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসে আমরা এর চিত্র দেখতে পাই। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কা’বার ছায়ায় বালিশে হেলান দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর কাছে অভিযোগ করলাম, কেন আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইছেন না, আমাদের জন্য তাঁর কাছে দু’আ করছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে (এমন বিপদও এসেছে যে) কাউকে ধরা হতো। তারপর গর্ত খনন করে তাকে সেই গর্তে ফেলা হতো। এরপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো। অতপর তাকে দুই টুকরো করে লোহার চিরুনী দিয়ে তার শিরা-অস্থিসহ আচড়ানো হতো। তদুপরি তারা তাকে দীন থেকে ফেরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ! (এখন আমাদের পরীক্ষা চলছে) আল্লাহ এ দীনকে পূর্ণতা দেবেন। একদিন এমন আসবে যখন আরোহীরা সানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত যাবে। চিতা আর ছাগল নিরাপদে থাকবে। এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতে হবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো।’ [বুখারী : ৩৬১২। ]

অর্থাৎ মক্কার মুশরিকদের আযাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। সুতরাং অতীতের উম্মতের মতো তোমরাও দীনের বিপদে একটু ধৈর্য ধরো।

চলবে ইনশা’আল্লাহ…

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন