বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার পর্ব ১

2
2907

228

লেখক: ক্বামারুয্যামান বিন আব্দুল বারী

পর্ব ১ | পর্ব ২

উপক্রমণিকা:

দারিদ্র্য এক নির্মম অভিশাপ। এ অভিশাপ মানুষকে কুঁরে কুঁরে খায়। সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে দেয়। এটা মানবতাকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পারে। দারিদ্রে্যর কশাঘাতে ও ক্ষুধার নির্মম যাতনায় অভাবের অনলে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে ন্যায়-অন্যায় বিস্মৃত বনু আদম পাপ-পঙ্কিলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে নিজের অজান্তেই আত্মবিধ্বংসী পথে অগ্রসর হয়। দারিদ্রে্যর এ নির্মম কঠোর জ্বালায় মানবতাবোধ লোপ পায়, হিংস্রতার প্রসার ঘটে, অন্যায়-অবিচার বিস্তৃত হয়। নারী তার পরম সযত্নে লালিত সতীত্বকে বিলিয়ে দেয়, মানুষ তার কলিজার টুকরা সন্তান বিক্রি করে, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতেও দ্বিধা করে না। দারিদ্র্য হ’ল রক্তশূন্যতা সদৃশ। অর্থ-সম্পদ মানুষের জন্য সে কাজ করে, যা মানুষের দেহের জন্য রক্ত করে। রক্ত মানুষের দেহ ও জীবনের স্থিতির নিয়ামক। রক্তশূন্যতা দেখা দিলে মানুষের দেহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির আবাসে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে সম্পদের স্বল্পতা থাকলে মানুষের জীবনও অচল হয়ে পড়ে অনিবার্যভাবে।

‘দারিদ্র্য’ ও ‘বাংলাদেশ’ শব্দদ্বয় একত্রে বিসদৃশ লাগে। কারণ বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। সম্পদে ভরপুর দেশটির স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময়ে ছুটে আসা পর্যটক, বিশেষজ্ঞ জ্ঞানী-গুণী ও ভূ-তত্ত্ববিদগণ। অথচ বর্তমানে আমাদের দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৮৯ হাযার ৭৭২ জন। যা শতকরা ৩১ দশমিক ৫ ভাগ এবং অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ ৬৫ হাযার ১৭১ জন, যা শতকরা ১৭ দশমিক ৬ ভাগ। প্রকৃতপক্ষে আমরা দরিদ্র নই; বরং আমাদেরকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে। আমাদের শাসকবৃন্দ হ’লেন এর প্রধান কুশীলব। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা পরিপন্থী কর্মনীতি ও কর্মপন্থা তথা ইসলাম পরিপন্থী অর্থব্যবস্থা ও কর্মকান্ডই এ দারিদ্র্য সমস্যার মূল কারণ। কেননা দারিদ্র্য ও ইসলাম শব্দ দু’টি দুই মেরুর শব্দ। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব যেমন চিরন্তন, ঠিক তেমনি দারিদ্র্য ও ইসলামের দ্বন্দ্বও চিরন্তন। ইসলাম ও দারিদ্রে্যর সহাবস্থান অকল্পনীয়। যে ‘জাযীরাতুল আরবে’র (আরব উপদ্বীপ) মানুষেরা অভাব ও দারিদ্রে্যর যাতাকলে পিষ্ট হয়ে কয়েকদিন পর্যন্ত উপোস থেকে উদরে পাথর বেঁধে দিনাতিপাত করত, সেই  আরব  জাতি  ইসলামের  সুমহান আদর্শে বলীয়ান হয়ে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এমন স্বনির্ভর দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত জাতি হ’তে সক্ষম হয়েছিল যে,  যাকাত নেওয়ার মতো কোন লোক সেখানে পাওয়া যেত না। ড: হাম্মূদাহ আবদালাতি বলেন: (It is authentically reported that there were times in the history of the Islamic administration when there was no person eligible to receive Zakah.) ‘ইসলামী সোনালী শাসনামলের ইতিহাসে এমন এক সময় ছিল, যখন যাকাত গ্রহণ করার মতো কোন লোক ছিল না’।  [মোঃ এনামুল হক, যাকাত : আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল-জুন ২০১০ ইং), পৃঃ ১৫৭।]

দারিদ্রে্যর সংজ্ঞা:

  • দারিদ্রে্যর অর্থ হচ্ছে- দরিদ্র অবস্থা, অভাব ও দীনতা। [সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, পৃঃ ২৭৭]
  • দারিদ্র্য বলতে এমন ব্যক্তি বা দেশকে বুঝায় যার সামান্য সম্পদ ও অল্প আয় রয়েছে, যা দ্বারা ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন (Basic Needs) মেটাতে ব্যর্থ। [মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, প্রবন্ধ: দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, জানুয়ারী-মার্চ ২০০৯ইং, পৃঃ ৯৩]
  • ডেলটুসিং বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদের অপ্রতুলতাই হ’ল দারিদ্র্য’। [মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামী প্রেক্ষিত, পৃঃ ৯৪]
  • থিওডরসনের মতে, ‘দারিদ্র্য হ’ল প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মানসিক উপোস’। [ঐ]
  • ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য হচ্ছে এমন এক অবস্থা, যা মানব জীবনের অব্যাহত প্রয়োজনীয় পণ্য বা মাধ্যম উভয়েরই অপর্যাপ্ততা বুঝায়। [ঐ]

দারিদ্রে্যর কারণ ও প্রতিকার:

দারিদ্র্য সমস্যার কারণের মাঝেই তার প্রতিকার নিহিত আছে। তাই বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যার কারণ বিশ্লেষণের সাথে সাথেই তার প্রতিকার বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

১. সম্পদের মালিকানা:

বাংলাদেশ ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ বিত্তশালী নিজেদেরকে তাদের সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক মনে করে সম্পদ নিজ আয়ত্বে কুক্ষিগত করে রাখেন। অভাবগ্রস্ত দারিদ্র্যপীড়িত আর্ত-মানবতার সেবায় তারা কোনই অর্থ ব্যয় করেন না। আর এটা বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যার অন্যতম কারণ। মালিকানার ধারণা মানুষের মাঝে স্বেচ্ছাচারিতা ও লাগামহীনতার জন্ম দেয়। শোষণের মূলে রয়েছে মানুষের এ স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা। মালিক যখন নিজেকে নিরঙ্কুশ মালিকানার অধিকারী মনে করে, তখন তাকে এ ধরনের ফেরাঊনী অলীক ভাবনায় পেয়ে বসে। ইসলাম তাই বান্দার নিরঙ্কুশ মালিকানার ধারণা রহিত করে দিয়ে শুরুতেই শোষণবাদী মানসিকতার মূলোৎপাটন করে দেয়। মূলতঃ সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা আল্লাহ্র। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীনের বাণী:  

  • আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’ [নাযি‘আত ২৪]
  • আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্র।’ [বাক্বারাহ ২৮৪]

সম্পদে আল্লাহ্র মালিকানার বিশ্বাস মানুষকে স্বভাবতই বিনয়ী, জবাবদিহিতার চেতনায় উদ্ভাসিত এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অর্থ ব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করে।

২. দারিদ্র্য সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা:

আমাদের দেশের একশ্রেণীর আলেম-ওলামা, শ্রমবিমুখ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী দারিদ্র্যকে সযত্নে লালন করে চলছেন। ‘দারিদ্র্য আমার অহংকার। এর দ্বারাই আমি গর্ববোধ করি’ [ছাগানী, আল-মাওযূ‘আত ১/৫২ পৃঃ, হা/৭৭; হাফেয সাখাবী, আল-মাক্বাছিদুল হাসানাহ হা/৭৪৫]

তারা এ মর্মে একটি জাল হাদীছ উদ্ধৃত করে নিজেদের দারিদ্র্য সম্পর্কিত ভ্রান্ত আক্বীদার সাফাই গেয়ে থাকেন। অথচ তারা জানেন না যে, যারা আল্লাহ্র বিধানাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, মূলতঃ তারাই দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টে নিপাতিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাববুল আলামীনের বাণী: ‘যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা হবে সংকুচিত।’ [ত্ব-হা ১২৪]

রাসূল (সা:) সর্বদা দো‘আয় বলতেন: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট জাহান্নামের শাস্তি ও ফিতনা, কবরের ফিতনা ও আযাব, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।’ [বুখারী, হা/৬৩৭৬ ‘দো‘আ’ অধ্যায়, ‘প্রাচুর্যের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা’ অনুচ্ছেদ]

তিনি আরো বলতেন: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ক্ষুধা থেকে পানাহ চাচ্ছি। কেননা তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট সঙ্গী এবং তোমার নিকট খিয়ানত থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। কেননা তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট সঙ্গী।’ [নাসাঈ, মিশকাত হা/২৪৬৯, হাদীছ হাসান ছহীহ]

৩. শ্রমবিমুখতা:

ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, Diligence is the key to success. ‘পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি’। পক্ষান্তরে শ্রমবিমুখতাই দারিদ্রে্যর মূল কারণ। শ্রমই দারিদ্র্য বিমোচনের প্রথম হাতিয়ার এবং ভাগ্যোন্নয়নের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু আমাদের এ দেশের অধিকাংশ মানুষ শ্রমবিমুখ, আরামপ্রিয়, অলস। তারা নিম্ন পেশার কাজ করতে লজ্জাবোধ করে। তাই দারিদ্রে্যর যাতাকলে আমরা আজও নিষ্পেষিত। শ্রমবিমুখতাকে ইসলাম পসন্দ করে না। ছালাত শেষে অলসভাবে মসজিদে বসে না থেকে রিযিক অন্বেষণের লক্ষ্যে যমীনে ছড়িয়ে পড়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে: ‘ছালাত সমাপ্ত হ’লে তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ (রিযিক) অন্বেষণ কর।’ [জুম‘আ: ১০]

রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন: ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য অপেক্ষা অধিক উত্তম খাদ্য আর কিছুই নেই।’ [বুখারী, মিশকাত হা/২৭৫৯]

যদি আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:)-এর উপরোক্ত দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হ’তাম, তবে এ দেশে দারিদ্র্য সমস্যা থাকত না।

৪. মালিক ও শ্রমিকের দায়িত্বহীনতা:

মালিক-শ্রমিকের দায়িত্বহীনতাও দারিদ্র্য সমস্যার জন্য কম দায়ী নয়। কারণ এ দেশের মালিক-শ্রমিকের কেউ নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নয়। এ ব্যাপারে তারা একেবারেই উদাসীন বললেও অত্যুক্তি হবে না। শ্রমিকের কর্তব্য হ’ল তার উপর আরোপিত দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দেয়া আর মালিকের কর্তব্য হ’ল শ্রমিকের যথার্থ মজুরী নির্ধারণ করা, সময়মত তা পরিশোধ করা এবং অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে না দেয়া।

আদর্শ শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে রাববুল আলামীনের বাণী: ‘শ্রমিক হিসাবে সেই উত্তম যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ [ক্বাছাছ ২৬]

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘তিন ব্যক্তির জন্য দ্বিগুণ ছওয়াব রয়েছে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল, ‘যে ক্রীতদাস আল্লাহ্র হক আদায় করে এবং স্বীয় মালিকের হকও যথার্থভাবে আদায় করে।’ [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১১]

অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা:) মালিকদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন: ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার প্রাপ্য মজুরী দিয়ে দাও।’ [ইবনু মাজাহ হা/২৪৪৩; মিশকাত হা/২৯৮৭, হাদীছ ছহীহ]

হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ক্বিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল: ‘যে ব্যক্তি মজুরীতে মজুর রেখে তার কাছ থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করেছে, অথচ তার ন্যায্য মজুরী প্রদান করেনি।’ [বুখারী, মিশকাত হা/২৯৮৪]

উপরোক্ত ইসলামী দিকনির্দেশনা না মানার কারণেই মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কর্মহীন বেকার হয়ে দারিদ্রে্যর অতলতলে তলিয়ে যাচ্ছে হাযারো পরিবার, যার বাস্তব দৃষ্টান্ত হ’ল দেশের গার্মেন্টস শিল্প।

৫. সুষম বণ্টন ব্যবস্থার অভাব:

ধন-সম্পদে ভরপুর আমাদের এ বাংলাদেশ। তাই এ দেশকে বলা হয় সোনার বাংলাদেশ। তদুপরি এ দেশের প্রায় ৩১ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ইসলামের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য সমস্যার মূল কারণ এই নয় যে, পৃথিবীতে সম্পদের অভাব। বরং আসল কারণ হচ্ছে সুষ্ঠু ব্যয় ও বণ্টনের অভাব। ইসলাম সম্পদ বণ্টনের মূলনীতি হিসাবে নির্দেশ দিয়েছে: ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হ’তে না থাকে।’ [হাশর: ৭]

অর্থাৎ ইসলাম চায় ধন-সম্পদ শুধু সমাজের মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর মাঝে আবর্তিত না হয়ে গোটা সমাজে আবর্তিত হোক। সমাজের প্রত্যেকটি সদস্য ধন-সম্পদ দ্বারা উপকৃত হোক। এজন্য ইসলাম ইনছাফভিত্তিক শ্রমনীতির ব্যবস্থা করেছে। ধন অর্জনের শোষণমূলক ও অনৈতিক পন্থা যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জুয়া, সূদ, ঘুষ, মজুদদারী, প্রতারণা, ওযনে কম দেয়া, ভেজাল ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ধন-সম্পদ বংশানুক্রমিক মুষ্টিমেয় লোকদের হাতে কুক্ষিগত হওয়া বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রবর্তন করেছে ব্যাপকভিত্তিক উত্তরাধিকার আইন। চালু করেছে নফল দান-ছাদাক্বাহ ও সহযোগিতার ব্যবস্থা। রয়েছে করযে হাসানার মতো মানবহিতৈষী নিঃস্বার্থ ঋণদান ব্যবস্থাও।

৬. যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার অনুপস্থিতি:

আমাদের এ দেশ ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি পর্যায়ে কিছুটা যাকাত দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে বটে, কিন্তু যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু নেই। আর এটা দারিদ্র্য সমস্যার অন্যতম কারণ। যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র্য বিমোচন, যা সামাজিক নিরাপত্তার মূল চালিকাশক্তি। যাকাত বণ্টনের ৮টি খাতের মধ্যে ৪টি খাতই (ফকীর, মিসকীন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত) অসহায় অভাবগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত। এছাড়া নব মুসলিমের ভাগটাও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে আসতে পারে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি যাকাত। এতে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অর্থ ক্ষুধা-দারিদ্র্য, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হতাশা, শ্রেণীবৈষম্য, অসহনশীলতা, অনৈক্য, দুশ্চিন্তামুক্ত পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদে সকল সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য দূর হয়ে সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণময়তা বিরাজ করা। পরস্পর এগিয়ে এসে একে অপরের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করা। যে সমাজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ, আজকের আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যে সমাজের কথা কল্পনাও করতে পারে না, সে সমাজ উপহার দিয়েছে ইসলাম এখন থেকে প্রায় পনেরশত বছর আগে। যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ছিল যে সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। যাকাত দুস্থ-দরিদ্রদের প্রতি বিত্তশালীদের দয়া বা অনুকম্পা নয় বরং অধিকার। এ প্রসঙ্গে রাববুল আলামীনের বাণী: ‘আর তাদের (বিত্তশালীদের) সম্পদে রয়েছে দরিদ্র ও বঞ্চিতের অধিকার।’ [যারিয়াত: ১৯]

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমা, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থ থেকে এবং বিত্তশালীদের থেকে যদি বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় করা হয় তাহ’লে বার্ষিক ৩,০০০ কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব, যা প্রায় জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ। [মোঃ আবুল কালাম আজাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষম বণ্টনের কৌশল হিসাবে যাকাত : তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, নূরুল ইসলাম মানিক সম্পাদিত, দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ’০৯ ইং), পৃঃ ২৩১]

এ অর্থ দিয়ে মাত্র পাঁচ বছরেই বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব। শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী তাইতো বলেছেন, ‘যাকাত দু’টি লক্ষ্যে নিবেদিত- আত্মশুদ্ধি অর্জন ও সামাজিক দারিদ্র্য নিরসন’। [হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (বৈরূত : দারু ইহ্ইয়াইল উলূম, ৩য় সংস্করণ, ১৪২০ হিঃ/১৯৯৯ খৃঃ), ২/১০০-১০১]

৭. সূদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা:

দারিদ্র্য সমস্যার অন্যতম কারণ হ’ল সূদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। সূদ মানব সভ্যতার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শত্রু। সূদ মানুষকে শোষণের অর্থনৈতিক হাতিয়ার। সূদের প্রভাবে মানুষের শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই দেখা দেয় তা নয়, বরং নৈতিক ও চারিত্রিক সর্বোপরি মানবিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি হয়। একদিকে সূদের নিষ্পেষণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্রমেই দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হ’তে থাকে। অপরদিকে পুঁজিপতি বিত্তশালীরা সূদ গ্রহণ করে আরও ধনী হ’তে হ’তে নৈতিক, চারিত্রিক ও মানবিক গুণশূন্য অর্থগৃধুণতে পরিণত হয়। তাই রাববুল আলামীন সূদকে চিরতরে হারাম ঘোষণার সাথে ব্যবসাভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালুর তাকীদ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে:‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সূদকে হারাম করেছেন’ [বাক্বারাহ: ২৭৫]

সূদভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়, পক্ষান্তরে যাকাত, দান-ছাদাক্বা ভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে দারিদ্র্য বিমোচন হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা সূদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-ছাদাক্বাকে বর্ধিত করেন।’ [বাক্বারাহ: ২৭৬]

৮. দারিদ্র্যকে লালন করা হচ্ছে:

বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যার আর এক বিশেষ কারণ হচ্ছে- এ দেশের শাসকগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার, সরকারী আমলা, এনজিও, বিদেশী দাতা সংস্থা কর্তৃক দারিদ্র্যকে লালন করা হচ্ছে। সরকার থেকে শুরু করে এনজিও পর্যন্ত সকলেরই কথার ফুলঝুরি হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। এজন্য প্রতিবছর ‘দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র’ (PRSP)-এর আওতায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর নিকট থেকে এ দেশে প্রতিবছর আসছে হাযার হাযার কোটি টাকা। সরকারী বাজেটের এক বৃহদংশ বরাদ্দ থাকছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য। ব্যাংকগুলোও যথেষ্ট না হ’লেও দরিদ্রদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করছে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে সকলেরই লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। তারপরেও কেন দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে না?
অভিযোগ রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশই চলে যায় মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারী আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী, এনজিও মালিক-কর্মকর্তাদের পকেটে। আর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীও কি আদতে চায় যে, এদেশের দরিদ্রতা দূর হোক? সুশাসন ও সুষ্ঠু আইন-শৃংখলা কায়েম হোক? এ দেশ স্বনির্ভর হোক? নাকি মুখে মুখে সুবচন ঝাড়লেও তারাও মনে মনে চায়, দুর্নীতিবাজ, দেশপ্রেমহীন, মূল্যবোধহীন, চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ, আমলা, এনজিও মালিক ও তথাকথিত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাই বহাল থেকে তাদের তল্পিবহন করুক? তাদের দাস্যবৃত্তি করুক? এদেশে মওজুদ থাকুক সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী দেশপ্রেমহীন চরিত্রহীন অথচ শক্তিশালী ও ধনবান একটি দালাল শ্রেণী? [হারুনুর রশীদ, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ মাথাপিছু ২৮ হাযার টাকার ঋণ ও অনুদান’ মাসিক আত-তাহরীক, আগষ্ট ২০০৩, পৃঃ ২২-২৩]

মূলতঃ পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় না থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আমি আজ তাদের মুখে মোহর এঁটে দিব। তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সমূহ তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দিবে।’ [ইয়াসীন: ৬৫]

৯. এনজিও কর্তৃক দারিদ্র্য চাষ:

এদেশের এনজিওগুলি- যাদের ঘোষিত লক্ষ্য হ’ল দারিদ্র্য বিমোচন, তারাই দারিদ্র্য চাষ করছে বলে ঘোরতর ও প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। বস্ত্ততঃ এনজিওগুলো যে ক্ষুদ্রঋণ দেয় এবং তার জন্য যে পরিমাণ সূদ শেষাবধি গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয়, তাতে ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায় না; বরং মূল উপার্জনেরই একটা অংশ তুলে দিতে হয় নতুন এই বেনিয়াদের হাতে। [শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, সূদ হারামের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা, মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর ’০৪ইং, পৃঃ ২৫]
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান গত ১৮ অক্টোবর এক সেমিনারে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক চিন্তার আধুনিক সংস্করণ মাত্র। প্রতিবছর দেশের প্রায় ১ কোটি জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্রঋণের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এ ধরনের কোন প্রকল্পের মাধ্যমে কখনোই দেশকে দারিদ্রে্যর অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়’। [ইনকিলাব, ১৯ অক্টোবর ২০১১, পৃঃ ১৫ ও ১৬]

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহীত এনজিও ঋণের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘চোরাবালিতে আটকা পড়ে যাচ্ছেন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা’। বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছেন ৪ কোটি দরিদ্র মানুষ। এত ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার পরও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বছরে প্রায় ১২ হাযার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বর্তমানে প্রায় ২০ হাযার প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণের সূদের হার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। [দৈনিক যুগান্তর, ৭  নভেম্বর ২০১০ইং]

অথচ রপ্তানী খাতে শিল্পপতিদের ঋণ দেয়া হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ সূদে। যেখানে দরিদ্রদেরকে বিনা সূদে ঋণ দেয়া উচিত ছিল, সেখানে শিল্পপতি কোটিপতিদের চেয়ে দরিদ্রদের নিকট থেকে নেয়া হচ্ছে ৪ গুণ বেশী সূদ! এটা দারিদ্র্য চাষ নয় তো কি?
ইসলাম অতি দরিদ্রদের মাঝে ‘করযে হাসানা’ তথা সূদমুক্ত ঋণ প্রদানের তাকীদ দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে: ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তবে তিনি তা তোমাদের জন্য বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, ধৈর্যশীল।’ [তাগাবুন: ১৭]

পর্ব ১ | পর্ব ২

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

2 COMMENTS

আপনার মন্তব্য লিখুন