অধিক পাওয়ার আকাংখা

6
2008

লেখকঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

(১) অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, (২) যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। (৩) কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে। (৪) অতঃপর কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে (৫) কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে (তাহ’লে কখনো তোমরা পরকাল থেকে গাফেল হ’তে না)। (৬) তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে। (৭) অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে। (৮) অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদের দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

বিষয়বস্ত্ত:

প্রাচুর্যের লোভ মানুষকে আখেরাত ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু না, তাকে দুনিয়া ছাড়তেই হবে এবং আখেরাতে পাড়ি দিতেই হবে। একথাগুলো বর্ণিত হয়েছে ১ হ’তে ৫ আয়াত পর্যন্ত।

অতঃপর সেখানে তারা দুনিয়াবী নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে এবং হাতে-নাতে ফলাফল পাবে। একথাগুলো আলোচিত হয়েছে ৬ হ’তে ৮ আয়াত পর্যন্ত।

তাফসীর:

(১) ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (আখেরাত থেকে) গাফেল রাখে’।

أَلْهَاكُمُ অর্থ أنساكم তোমাদের ভুলিয়ে রাখে। التَّكَاثُرُ অর্থ পরস্পরে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা। মূল ধাতু (المادة) হ’ল الكثرة ‘আধিক্য’।

অর্থাৎ অধিক ধনলিপ্সা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাংখা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য এবং আখেরাতের চিন্তা হ’তে গাফেল রাখে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার এই আকাংখার শেষ হয় না। বস্ত্ততঃ এটি মানুষের একটি স্বভাবগত প্রবণতা। কাফের-মুনাফিকরা এতে ডুবে থাকে। কিন্তু মুমিন নর-নারী এ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং সর্বদা আখেরাতের জন্য প্রস্ত্তত থাকে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), মুক্বাতিল ও কালবী বলেন, কুরায়েশ বংশের বনু আবদে মানাফ ও বনু সাহ্ম দুই গোত্র পরস্পরের উপরে বিভিন্ন বিষয়ে প্রাধান্য দাবী করে বড়াই করত। সে উপলক্ষে সূরাটি নাযিল হয় (কুরতুবী)। কিন্তু বক্তব্য সকল যুগের সকল লোভী ও অহংকারী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কেননা দুনিয়াবী এই সব শান-শওকত মায়া-মরীচিকার মত। এগুলোর কোন কিছুই বান্দা সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। কেবলমাত্র তার নেক আমল ব্যতীত।

(১) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন: ‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেওয়া হয়, তাহ’লে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাংখা করবে। আর তার মুখ কখনোই ভরবে না মাটি ব্যতীত (অর্থাৎ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করে থাকেন’। [1] রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলতেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর উপরোক্ত হাদীছকে কুরআনের অংশ মনে করতাম, যতক্ষণ না সূরা তাকাছুর নাযিল হয়’। [2]

(২) মুত্বাররিফ (রাঃ) স্বীয় পিতা আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে: আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর কাছে এলাম। সে সময় তিনি সূরা তাকাছুর পাঠ করছিলেন। অতঃপর তিনি বলেন, বনু আদম বলে আমার মাল,  আমার মাল।  অথচ  হে  আদম সন্তান! তোমার মাল কি কেবল অতটুকু নয়, যতটুকু তুমি ভক্ষণ করলে ও শেষ করলে? অথবা পরিধান করলে ও জীর্ণ করলে। অথবা ছাদাক্বা করলে ও তা সঞ্চয় করলে’? [3]

(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ তার মাল হ’ল মাত্র তিনটি : (১) যা সে খায় ও শেষ করে। (২) যা সে পরিধান করে ও জীর্ণ করে এবং (৩) যা সে ছাদাক্বা করে ও সঞ্চয় করে। এগুলি ব্যতীত বাকী সবই চলে যাবে এবং লোকদের জন্য সে ছেড়ে যাবে’। [4]

(৪) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন: ‘মাইয়েতের সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন তার সাথে থেকে যায়। মাইয়েতের সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’। [5]

(৫) হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন: ‘আদম সন্তান বার্ধক্যে জীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু দু’টি বস্ত্ত বৃদ্ধি পায়: সম্পদের লোভ ও অধিক বয়স পাওয়ার আকাংখা’। [6]

(৬) হাফেয ইবনু আসাকির ইমাম আহনাফ ইবনে ক্বায়েস (নাম : যাহহাক)-এর জীবনী আলোচনায় বলেন, একদা তিনি একজন ব্যক্তির হাতে একটি দিরহাম দেখে বলেন, এটি কার? সে বলল, আমার। আহনাফ বললেন, ওটা তোমার হবে তখনই, যখন তুমি ওটা কোন নেকীর কাজে বা আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্যয় করবে। অতঃপর আহনাফ আবু নাওয়াসের নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করেন-            ‘যখন তুমি আটকে রাখলে, তখন তুমি মালের
‘ আর যখন তুমি খরচ করলে, তখন মাল হ’ল তোমার’ (ইবনু কাছীর)

(৭) ‘যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’।

حتَّى زرتُم الْمقابرِ  حتى أتاكم الموت فوصلتم إلى المقابر وصرتم من أهلها অর্থ- ‘যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু এসে যায়। অতঃপর তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও এবং তার বাসিন্দা হয়ে যাও’। مَقَابِر একবচনে مَقْبَرَةٌ অর্থ কবরস্থান। القُبُوْرُ একবচনে القَبْرُ ‘কবর’। কবরকে আখেরাতের প্রথম মনযিল বলা হয়।

(৯) كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘কখনই না। তোমরা সত্বর জানতে পারবে’।

(১০) ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘অতঃপর কখনই না। তোমরা সত্বর জানতে পারবে’।

كَلاَّ পরপর দু’বার আনা হয়েছে শ্রোতাকে ধমক দেওয়ার জন্য ও সতর্ক করার জন্য। এটি كلمة ردع বা অস্বীকারকারী শব্দ। এর মাধ্যমে বান্দার লোভের আধিক্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর দ্বারা বলতে চাওয়া হয়েছে যে, প্রাচুর্যের লোভ করো না। পরিণামে তোমরা লজ্জিত হবে। যা তোমরা সত্বর জানতে পারবে। হাসান বাছরী বলেন, ‘এটি ধমকের পরে ধমক’ (ইবনু কাছীর)। দু’বার আনার অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, প্রথমটি দ্বারা কবর এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা আখেরাত বুঝানো হয়েছে। অথবা প্রথমটি দ্বারা ক্বিয়ামত এবং শেষেরটি দ্বারা হাশর অর্থাৎ বিচার দিবস বুঝানো হয়েছে। অথবা প্রথমটিতে বলা হয়েছে, তোমরা সত্বর জানতে পারবে যখন মৃত্যু এসে যাবে ও তোমাদের রূহ তোমাদের দেহ থেকে টেনে বের করা হবে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, পুনরায় তোমরা জানতে পারবে যখন তোমরা কবরে প্রবেশ করবে এবং মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের সম্মুখীন হবে’ (কুরতুবী)।

হযরত ওছমান গণী (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন কান্নায় তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে বলা হল, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা আসলে আপনি কাঁদেন না। অথচ এখানে আপনি কাঁদছেন? জবাবে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই কবর হ’ল আখেরাতের মনযিল সমূহের প্রথম মনযিল। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে, তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলি সহজ হয়ে যাবে। আর যদি সে এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরবর্তীগুলি কঠিন হবে। তিনি বলেন, কবরের চাইতে ভয়ংকর কোন দৃশ্য আমি দেখিনি’। [7]

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা:) আমার দেহের একাংশ ধরে বললেন: ‘পৃথিবীতে তুমি আগন্তক অথবা পথযাত্রীর মত বসবাস কর’। [8] ‘এবং নিজকে সর্বদা কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর’। [9]

(১১) كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِيْنِ ‘কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত  জ্ঞান রাখতে’। তৃতীয়বার كَلاَّ এনে বান্দাকে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে, যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে! কেননা ক্বিয়ামত ও আখেরাতে জবাবদিহিতার উপরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে তোমরা কখনোই অধিক অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের পিছনে ছুটতে না। এখানেلَوْ (যদি) এর জবাব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আজকে নিশ্চিত জানতে, যা তোমরা পরে জানবে, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত থেকে গাফেল হ’তে না।

ইবনু আবী হাতেম বলেন, তিনটি স্থানেই كَلاَّ অর্থ أَلاَ অর্থাৎ ‘সাবধান’। ফার্রা বলেন, বরং كَلاَّ অর্থ হবে حقًّا‘অবশ্যই’। অর্থাৎ অবশ্যই তোমরা সত্বর জানতে পারবে (কুরতুবী)।

(১২) لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ ‘তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে’।

(১৩) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِيْنِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে’।

এটিতে প্রচ্ছন্নভাবে আরেকবার ধমক দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে শপথ লুকিয়ে রয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তোমরা অবশ্যই জা ‎হান্নামকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করবে। তখন তোমাদের মধ্যে দিব্য-প্রত্যয় জন্মাবে।

এখানে ‘তোমরা’ বলে কাফেরদের বুঝানো হ’তে পারে। কেননা তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। অথবা সাধারণভাবে সকল বনু আদমকে বুঝানো হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় (জাহান্নামে) পৌঁছবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়ছালা’ [মারিয়াম ১৯/৭১]

এখানে পৌঁছনোর অর্থ প্রবেশ করা নয়, বরং অতিক্রম করা। একে ‘পুলছিরাত’ বলা হয়। ছহীহ হাদীছ সমূহে এসেছে যে, মুমিনগণ পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে চোখের পলকে বিদ্যুতের বেগে। জাহান্নামের কোন উত্তাপ তারা অনুভব করবে না। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ আটকে যাবে ও জাহান্নামে পতিত হবে…। [10] যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন: ‘অতঃপর আমরা আল্লাহভীরুদের উদ্ধার করব এবং যালেমদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ [মারিয়াম ১৯/৭২]

অতএব মুমিন-কাফির সবাই জাহান্নামকে প্রত্যক্ষ করবে। মুমিনগণ সহজে পার হয়ে যাবে। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের কঠিন পাকড়াও থেকে রক্ষা করুন- আমীন!

এখানে عَيْنَ الْيَقِينِ বা ‘দিব্য-প্রত্যয়ে’ বলার কারণ এই যে, চোখে দেখা কানে শোনার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন:‘কানে শোনা কখনো চোখে দেখার সমান নয়’। [11]

 العَيْنُ অর্থ النَّفْسُ। ফলে দেখাটাকেই ইয়াক্বীন গণ্য করা হয়েছে (ক্বাসেমী)।

দুনিয়াতে ঈমানদারগণ আল্লাহ ও রাসূলের কথায় বিশ্বাসী হয়ে মনের চোখ দিয়ে সেটা দেখতে পারে এবং আখেরাতে মানুষ সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তখনকার দেখায় কোন কাজ হবে না। দুনিয়াতে বিশ্বাস করলে ও সেই অনুযায়ী সাবধান হয়ে নেক আমল করলে আখেরাতে কাজে লাগবে। ফলে সেদিন জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেও আল্লাহর হুকুমে সেখানে সে পতিত হবে না। বরং সহজে পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। দুঃখ হয় মানুষের জন্য যে নিজে না দেখেও অন্যের কথা শুনে নিজের মাতা-পিতা ও দাদা-দাদীর উপরে ঈমান এনে থাকে। অথচ সে নবী-রাসূলের কথা শুনে আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনতে পারে না। আল্লাহ আমাদের অন্তরকে নরম করে দিন এবং তাকে ঈমানের আলোকে আলোকিত করুন- আমীন!

(১৪) ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।

আবু নছর আল-কুশায়রী বলেন, প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। তবে কাফেরদের প্রশ্ন করা হবে ধিক্কার হিসাবে কেননা তারা এগুলোর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত না। আর মুমিনকে প্রশণ করা হবে তার মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। কেননা সে সর্বদা এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করত’ (কুরতুবী)।

মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তার চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা, তার হস্ত-পদ-পেট ও মস্তিষ্ক, তার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবই আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত নে‘মতের অংশ। মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে সৃষ্ট আসমান-যমীন, সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্ররাজি, বায়ু-পানি-মাটি, খাদ্য-শস্য, ফল-ফলাদি, পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালা, গবাদিপশু ও পক্ষীকুল সবই আল্লাহর নে‘মতরাজির অংশ। মানুষের জ্ঞান-সম্পদ, তার চিন্তাশক্তি ও বাকশক্তি তার সর্বাধিক মূল্যবান নে‘মত। সর্বোপরি মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত কিতাব ও নবী-রাসূলগণ মানব জাতির জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। আল্লাহ বলেন: ‘যদি তোমরা আল্লাহর নে‘মতরাজি গণনা কর, তবে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ [ইবরাহীম ১৪/৩৪; নাহল ১৬/১৮]

দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান হাযারো নে‘মতের মধ্যে আল্লাহ মানুষের লালন-পালন করেন। অকৃতজ্ঞ সন্তান যেমন পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করে না, অকৃতজ্ঞ মানুষ তেমনি তার পালনকর্তা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না। আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা কি দেখ না, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের সেবায় অনুগত করে দিয়েছেন? এবং তোমাদের উপরে তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নে‘মতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন…’ [লোকমান ৩১/২০]

তিনি বলেন: ‘পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং একটি সমুদ্রের সাথে সাতটি সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর নে‘মতসমূহ  লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। [লোকমান ৩১/২৭]

প্রধান নে‘মত সমূহ :

নিম্নে আমরা মানুষের প্রধান প্রধান নে‘মত, যা পবিত্র কুরআনে ও ছহীহ হাদীছ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির কথা উল্লেখ করব।-

(১) চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয়: আল্লাহ বলেন: ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে’। [বনু ইসরাঈল ১৭/৩৬] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) -এর ব্যাখ্যায় বলেন, এটা হ’ল দেহ, কর্ণ ও চক্ষুর সুস্থতা। কেননা এগুলি কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে আল্লাহ বান্দাকে প্রশ্ন করবেন। যদিও আল্লাহ এ বিষয়ে সম্যক অবহিত’। [ইবনু কাছীর]

(২) স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা: ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন: ‘দু’টি নে‘মত রয়েছে, যে দু’টিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং সচ্ছলতা’। [12] অর্থাৎ যখন সে সুস্থ ও সচ্ছল থাকে, তখন এ দু’টি নে‘মতকে সে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে ব্যয় করে না। বরং অলসতা করে এবং এখন নয়, পরে করব বলে শয়তানী ধোঁকায় পতিত হয়। ফলে যখন সে অসুস্থ হয় বা অসচ্ছল হয় কিংবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আর ঐ নেকীর কাজটি করার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্ততে গণীমত (সম্পদ) মনে কর : (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থাস্থ্যকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে’।[13] 

ইবনুল জাওযী বলেন: ‘যে ব্যক্তি তার সচ্ছলতা ও সুস্বাস্থ্যকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হ’ল ঈর্ষণীয়। আর যে ব্যক্তি ঐ দু’টি বস্ত্তকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হ’ল ধোঁকায় পতিত’। [14] অত্র হাদীছে সুস্বাস্থ্য ও আর্থিক সচ্ছলতাকে আল্লাহর বিশেষ নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

(৩) সম্পদ, সন্তান ও নেতৃত্ব: আবু হুরায়ারা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে কান, চোখ, মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেইনি?… আমি কি তোমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ও গণীমতের মাল নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেইনি? [15] 

অত্র হাদীছে কান ও চোখ ছাড়াও ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও নেতৃত্বকে  অন্যতম প্রধান নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যে বিষয়ে তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে।

(৪) আত্মীয়-পরিজন, ব্যবসা ও বাড়ী-ঘর: পবিত্র কুরআনে আরও কয়েকটি বস্ত্তকে মানুষের প্রিয়বস্ত্ত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যেগুলি নিঃসন্দেহে আল্লাহর দেওয়া অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মত। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘বল তোমাদের নিকটে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিবার ও গোত্র-পরিজন, তোমাদের মাল-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করে থাক, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা করে থাক এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ করে থাক, যদি আল্লাহ ও রাসূলের চাইতে তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয় হয়…’। [তওবা ৯/২৪] উপরোক্ত প্রতিটি নে‘মতের বিষয়ে বান্দাকে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।

(৫) সদাসঙ্গী পুত্রগণ: এই সঙ্গে আরেকটি নে‘মতের কথা বলা হয়েছে। وَبَنِينَ شُهُودًا ‘সদাসঙ্গী পুত্রবর্গ’(মুদ্দাছছির ৭৪/১৩)। অনেকের একাধিক পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু কেউ পিতামাতার কাছে থাকেনা। এটা যথার্থ নে‘মত নয়। যে   সন্তান সর্বদা পিতামাতার সুখ-দুঃখের সাথী থাকে, সেই-ই হ’ল প্রকৃত নে‘মত।

(৬) পুণ্যশীলা স্ত্রী: আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন: ‘নিশ্চয় সমগ্র দুনিয়াটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী’। [16] এই শ্রেষ্ঠ নে‘মত কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করা হবে। তেমনি স্ত্রীকেও তার সংসারের গুরু দায়িত্ব পালন সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’। [17]

(৭) ক্ষুধায় অন্ন: হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন: ‘একদা দিনে বা রাত্রিতে আল্লাহর রাসূল (সা:) ঘর থেকে বের হ’লেন। রাস্তায় তিনি আবুবকর ও ওমরকে পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ বস্ত্ত এই সময় তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছে? তারা উভয়ে বললেন, ক্ষুধা, হে আল্লাহর রাসূল! জবাবে রাসূল (সা:) বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমাকেও বের করেছে ঐ বস্ত্ত, যা তোমাদেরকে বের করে এনেছে’। অতঃপর বললেন, ওঠো। ফলে তারা উঠলেন ও তাঁর সাথে জনৈক আনছারীর বাড়ীতে গেলেন। কিন্তু তখন বাড়ীতে কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় বাড়ীওয়ালার স্ত্রী তাঁদের স্বাগত জানালো। রাসূল (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী বলল, উনি আমাদের জন্য সুপেয় পানি আনতে গেছেন। এমন সময় আনছারী ব্যক্তি এসে গেলেন। তিনি রাসূল (সা:) ও তাঁর দুই সাথীকে দেখে বলে ওঠলেন,‘আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা! আজকের দিনে সর্বাধিক সম্মানিত মেহমান কারু নেই আমার ব্যতীত’। অতঃপর তিনি গাছে উঠে টাটকা খেজুরের কাঁদি কেটে আনলেন এবং আধা-পাকা, শুকনা ও পাকা খেজুর পরিবেশন করতে লাগলেন। অতঃপর ছুরি নিয়ে ছাগল যবেহ করতে গেলেন। তখন রাসূল (সা:) তাকে বললেন, খবরদার দুগ্ধবতী বকরী যবেহ করো না। অতঃপর ছাগল যবেহ করা হ’ল এবং তিনজনে মিলে রান্না করা গোশত খেলেন। খেজুর খেলেন ও পানি পান করলেন।খানাপিনা শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আজকের এই নে‘মত সম্পর্কে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। অতঃপর তোমরা ফিরে যাওনি এই নে‘মত না পাওয়া পর্যন্ত’। [18]

মুসনাদে আবু ইয়া‘লা (হা/৭৮) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে এবং ছহীহ ইবনু হিববান (হা/৫২১৬) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ওমর (রাঃ) বর্ণিত: রেওয়ায়াতে দুপুর বেলায় যোহর ছালাত শেষে দু’জনের মসজিদে ঠেস দিয়ে বসে থাকার কথা এসেছে। তিরমিযী (হা/২৩৬৯) ও আবু ইয়া‘লা (হা/২৫০)-তে উক্ত আনছার ছাহাবীর নাম এসেছে, আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান। সেখানে একথাও এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) গিয়ে প্রথমে তিনবার সালাম করেন। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ফিরে আসতে উদ্যত হ’লেন। এমন সময় তার স্ত্রী ছুটে এসে বললেন,‘হে রাসূল! আমি আপনার সালাম শুনেছিলাম। কিন্তু আমাদের উপর আপনার সালাম আরও বেশী পাবার আকাংখায় জবাব না দিয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। রাসূল (সা:) খুশী হয়ে বললেন,  ‘বেশ’। আবুল হায়ছাম কোথায়? তাকে দেখছি না যে? উম্মুল হায়ছাম বললেন, উনি আমাদের জন্য পানি আনতে গিয়েছেন। [19]

উল্লেখ্য যে, এই মহা সৌভাগ্যবান মেযবান আবুল হায়ছাম আনছারীর (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বিখ্যাত সৈনিক কবি ও পরবর্তীতে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে রোমকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ঐতিহাসিক মুতা যুদ্ধের অন্যতম শহীদ সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) ছয় লাইনের বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন (কুরতুবী)। যার দু’টি লাইন নিম্নরূপ: ‘উম্মতের জন্য ইসলামের চাইতে সম্মান আমি কিছুতে দেখিনি। ইরাশীর মেহমানদের ন্যায় মর্যাদাবান কাউকে আমি মানবজাতির মধ্যে দেখিনি’। ‘নবী, ছিদ্দীক ও উম্মতের ফারূক। শাখা ও মূলে হাওয়ার সন্তানদের মধ্যে সেরা’ (কুরতুবী)। ইরাশ একটি স্থানের নাম। বাড়ীওয়ালা মেযবান সেদিকে সম্পর্কিত।

উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুৎ-পিপাসায় অন্নদান আল্লাহর এক অমূল্য নে‘মত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (সা:) পাখি থেকে উপদেশ হাছিল করতে বলেছেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন: ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে বলতে শুনেছি যে, যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পার, তাহ’লে অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে রিযিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিকে রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় ও পেটভরা অবস্থায় সন্ধ্যায় ফিরে আসে’। [20]

(৮) জীবন একটি নে‘মত: রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: ‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তান পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পা বাড়াতে পারবে না। ১- তার জীবন সম্পর্কে, কিসে তা শেষ করেছিল। ২- তার যৌবন সম্পর্কে, কিসে তা জীর্ণ করেছিল। ৩- তার মাল সম্পর্কে, কোন পথে তা অর্জন করেছিল এবং ৪- কোন পথে তা ব্যয় করেছিল। ৫- তার ইল্ম সম্পর্কে, সে অনুযায়ী সে আমল করেছিল কি-না’। [21]

অত্র হাদীছটি মানুষের পুরা জীবনকেই নে‘মত গণ্য করে। বিশেষ করে ইলমের নে‘মত। কেননা বাকী চারটা সবার থাকলেও ইল্ম সবার থাকে না। অধিকন্তু ইল্ম অনুযায়ী আমলকারী আলেমের সংখ্যা খুবই কম।

(৯) সকল নবী ও শেষনবী: মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেন ‘ঐ নে‘মত হ’লেন স্বয়ং মুহাম্মাদ (সা:), যাকে আল্লাহ আমাদের উপরে নে‘মত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন’। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘আল্লাহ ঈমানদারগণের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে রাসূল পাঠিয়েছেন…’। [আলে ইমরান ৩/১৬৪]

নবীগণের এই মহা নে‘মত সম্পর্কে কাফের ও অহংকারী ফাসেকদের জাহান্নামে নিক্ষেপের সময় জিজ্ঞেস করা হবে- ‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেননি? তারা কি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ পাঠ করেননি? এবং তোমাদেরকে আজকের দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে সতর্ক করেননি’? [যুমার ৩৯/৭১]

(১০) ইসলামের বিধান হালকা হওয়া: হাসান বাছরী ও মুফাযযাল বলেন,  বান্দার উপর আল্লাহর বড় নে‘মত হ’ল, আমাদের উপর শরী‘আতের বিধানসমূহকে হালকা করা এবং কুরআনকে সহজ করা। যেমন আল্লাহ বলেন: ‘আর তিনি তোমাদের উপরে দ্বীনের ব্যাপারে কোন সংকীর্ণতা রাখেননি’। [হজ্জ ২২/৭৮] যেমন ছালাত জমা ও ক্বছর করা, অপারগ অবস্থায় বসে, কাৎ হয়ে বা ইশারায় ছালাত আদায় করা, সফরে ছিয়াম ক্বাযা করা, ঋতু অবস্থায় মেয়েদের ছালাত মাফ হওয়া ইত্যাদি। অন্যত্র আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? [ক্বামার ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০] উল্লেখ্য যে, কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হ’ল, এর তেলাওয়াত সহজ এবং এর শিক্ষা-দীক্ষাসমূহ স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য। যেমন ছালাত পড়, ছিয়াম রাখো, অন্যায়-অশ্লীলতা হ’তে দূরে থাক ইত্যাদি। কিন্তু কুরআন থেকে আহকাম বের করা ও আয়াতের উদ্দেশ্য অনুধাবন করাটা সহজ নয়। এজন্য যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল আলেম হওয়া যরূরী।

(১১) কুরআন ও সুন্নাহ: কুরআন ও সুন্নাহ উম্মতের নিকটে রেখে যাওয়া শেষনবী মুহাম্মাদ (সা:)-এর দুই জীবন্ত মু‘জেযা, দুই পবিত্র আমানত এবং মানবজাতির জন্য আল্লাহর সবচাইতে বড় নে‘মত। বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী এক ভাষণে রাসূল (সা:) বলেন: ‘তোমাদের মাঝে আমি দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না যতদিন এ দু’টি বস্ত্তকে তোমরা কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকবে। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’। [22]

এখন  রাসূল নেই, খলীফাগণ নেই। উম্মতের সম্মুখে রয়েছে কেবল কুরআন ও হাদীছের দুই অমূল্য নে‘মত। অতএব সে অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করেছে কি-না, সে বিষয়ে আল্লাহর নিকটে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।

শেষনবী ছিলেন বিশ্বনবী। কুরআন ও সুন্নাহ সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী বিধান। অতএব মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকেই উক্ত ইলাহী নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

বস্ত্ততঃপক্ষে উপরে বর্ণিত সকল বিষয়ই আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। এগুলি সম্পর্কে বান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা দুনিয়ায় থাকতে এগুলির শুকরিয়া আদায় করেছিল, না কুফরী করেছিল। এই প্রশ্ন প্রত্যেক মানুষকেই করা হবে। আল্লাহ আমাদের জবাবদানের তাওফীক দিন- আমীন!

সারকথা: অধিক পাওয়ার আকাংখা পরিহার করতে হবে এবং অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে। আখেরাতে আল্লাহর নে‘মত সমূহের জওয়াবদিহি করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকতে হবে।


[1]. বুখারী হা/৬৪৩৯, মুসলিম হা/১০৪৮, মিশকাত হা/৫২৭৩।
[2]. বুখারী হা/৬৪৪০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ১০ অনুচ্ছেদ।
[3]. মুসলিম হা/২৯৫৮, মিশকাত হা/৫১৬৯ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[4]. মুসলিম হা/২৯৫৯, মিশকাত হা/৫১৬৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী হা/৬৫১৪, মুসলিম হ/২৯৬০, মিশকাত হা/৫১৬৭।
[6]. তিরমিযী হা/২৩৩৯, মুসলিম হা/১০৪৭, বুখারী, মিশকাত হা/৫২৭০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।
[7]. তিরমিযী হা/২৩০৮, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩২।
[8]. বুখারী হা/৬৪১৬।
[9]. তিরমিযী হা/২৩৩৩, ইবনু মাজাহ হা/৪১১৪; মিশকাত হা৫২৭৪।
[10]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭৯, ৫৫৮১ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ।
[11]. আহমাদ হা/২৪৪৭, মিশকাত হা/৫৭৩৮ সনদ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৬৪১২, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, আহমাদ; মিশকাত হা/৫১৫৫।
[13]. হাকেম, বায়হাক্বী-শো‘আব, তিরমিযী; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭; মিশকাত হা/৫১৭৪; হাদীছ ছহীহ।
[14]. ফাৎহুল বারী হা/৬৪১৪-এর ব্যাখ্যা।
[15]. তিরমিযী হা/২৪২৮ সনদ ছহীহ, কুরতুবী হা/৬৪৬৩।
[16]. মুসলিম হা/১৪৬৭; মিশকাত হা/৩০৮৩ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।
[17]. বুখারী ও মুসলিম; মিশকাত হা/৩৬৮৫।
[18]. মুসলিম হা/২০৩৮ ‘পানীয় সমূহ’ অধ্যায়, ২০ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৩৬৯; মিশকাত হা/৪২৪৬।উপরোক্ত হাদীছের রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধের সময় ইসলাম কবুল করেছিলেন। এতে অনেকে ধারণা করেন ঘটনাটি অনেক পূর্বের, যা তিনি শুনে বর্ণনা করেছেন। কেননা খায়বর যুদ্ধে বিজয়ের পর গণীমত হিসাবে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম অনেক সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন এবং তিনি নিজে ‘ফিদাক’ খেজুর বাগানের মালিক হন। এর জবাবে ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,هذا زعم باطل এটি একটি বাতিল ধারণা মাত্র। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমৃত্যু সচ্ছলতা ও দরিদ্রতার মধ্যে পরিক্রান্ত হয়েছেন। কখনো তিনি সম্পদশালী হয়েছেন, আবার কখনো নিঃস্ব হয়েছেন’। যেমন আয়েশা, আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবী বর্ণিত হাদীছ সমূহে এসেছে যে, মৃত্যুকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দীনার, দিরহাম, বকরী, উট, গোলাম, বাঁদী কিছুই রেখে যাননি। এরপরও যদি কিছু থেকে থাকে, সবই ছাদাক্বা হয়ে গিয়েছিল (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৯৬৪-৬৭, ফাযায়েল ও মাসায়েল অধ্যায়, ১০ অনুচ্ছেদ)।
[19]. ইবনু আবী হাতেম, মুসনাদে আবি ইয়া‘লা হা/২৫০, সনদ যঈফ, বাযযার প্রভৃতি; তাফসীর ইবনু কাছীর; তাফসীরে কুরতুবী।
[20]. তিরমিযী হা/২৩৪৪, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫২৯৯, সনদ ছহীহ।
[21]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৯৭ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৯৪৬।
[22]. মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

6 COMMENTS

  1. [[179379108907488]]http://Moneybd.xtgem.com ফেইসবুকের অলস সময়কে কাজে লাগান মাত্র ২ মিনিটে আয় করুন ৫০০ টাকা নাম মাত্র কিছু কাজ করেই আপনি পেতে পারেন ৫০০ টাকা মোবাইল রিচার্জ যেকোন সিমে। বিশ্বাস না হলে http://Moneybd.xtgem.com – লিংকটিতে প্রবেশ করেই দেখুন এবং নির্দেশ মত কাজ করুন । আমি নিজে এইমাত্র ২০০ টাকা পেলাম । এটি পে-পাল ও ফেইসবুক অনুমোদিত। [[179379108907488]]http://Moneybd.xtgem.com ফেইসবুকের অলস সময়কে কাজে লাগান মাত্র ২ মিনিটে আয় করুন ৫০০ টাকা নাম মাত্র কিছু কাজ করেই আপনি পেতে পারেন ৫০০ টাকা মোবাইল রিচার্জ যেকোন সিমে। বিশ্বাস না হলে http://Moneybd.xtgem.com – লিংকটিতে প্রবেশ করেই দেখুন এবং নির্দেশ মত কাজ করুন । আমি নিজে এইমাত্র ২০০ টাকা পেলাম । এটি পে-পাল ও ফেইসবুক অনুমোদিত। »» http://Moneybd.xtgem.com

আপনার মন্তব্য লিখুন