আল্লাহ কেন এরকম করলো? আল্লাহ থাকতে এসব হয় কিভাবে? পর্ব ১

12
7067

Why-Logo-White-copy

লেখক: ওমর আল জাবির

পর্ব-১|পর্ব-২

আল্লাহ আমাকে কেন বানিয়েছে? আমি কি আল্লাহকে বলেছিলাম আমাকে বানাতে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল না কেন আমি এরকম জীবন চাই কিনা? যারা এধরনের প্রশ্ন করে তাদেরকে আপনি যদি একটা যুক্তিযুক্ত উত্তর দেনও, সাথে সাথে তারা প্রশ্ন করবেঃ “আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের জীবন দিল, যেখানে অন্যরা কত শান্তিতে আছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে এতো কষ্ট দিতে?”

আপনি যদি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে ক্যাপিটালিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে, কেউ ধনী হলে সে অন্য অনেক মানুষকে গরীব বানিয়ে ছাড়বেই, তখন তারা এই ধরণের প্রশ্ন করা শুরু করবেঃ “আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানালো কেন, আমিতো মেয়ে হতে চাইনি? আল্লাহ আমাকে কালো কিন্তু অন্যদেরকে ফর্সা বানাল কেন, এটা তো ঠিক হল না? আমি খাট কেন, লম্বা না কেন? আমার কপালে এরকম শয়তান স্বামী পড়ল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, রোযা রাখি, কোনদিন ঘুষ খাইনি, কিন্তু তারপরেও আমার ক্যান্সার হল কেন?”

এই ধরনের “আমি, আমার, আমাকে” প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার পর তারা চলে যাবে আরও জটিল সব ঘটনায়ঃ সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন? মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি? সব টেররিস্টগুলো মুসলমান কেন? কেন ধর্মের নামে এতো খুনাখুনি, যুদ্ধ? আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম। আল্লাহর মানুষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে এতো কষ্ট দেবার দরকার কি ছিল? সরাসরি মানুষকে বেহেস্তে পাঠালেই তো হয়ে যেত। আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি? আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি? আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়।

এধরণের প্রশ্ন শুধু যে অমুসলিম, নাস্তিকরা করে তাই না, আজকাল মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক হারে এধরণের প্রশ্ন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে আমরা যখনি কোন জটিল শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক সমস্যায় পড়ি, তখনি আল্লাহর সম্পর্কে এই ধরণের অভিযোগ করা শুরু করে দেই।

এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি প্রশ্নকারীদেরকে তিন ভাগে ভাগ করবঃ

  • অসহায় ক্যাটাগরিঃ কেন আমাকে বানাল, কেন আমার এতো কষ্ট, কেন আমার এত অসুখ, …
  • স্বার্থপর ক্যাটাগরিঃ আমি মেয়ে কেন, আমি কালো কেন, আমার এতো অভাব কেন, …
  • দার্শনিক ক্যাটাগরিঃ কেন শয়তান, কেন দোযখ, কেন পৃথিবীর দরকার, সোজা বেহেস্ত দিলেই তো হত, …

এই তিন ধরণের ক্যাটাগরির মানুষের জন্য তিন ধরণের ব্যাখ্যা দিব, ইনশা আল্লাহ।

কিন্তু যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদেরকে প্রথমে ‘আল্লাহ’ বলতে আমরা কি ধরনের সত্ত্বার কথা বলছি, তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করবো ‘আল্লাহ’ কে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে লাভ হবে না। সবসময় একটা ‘কিন্তু…’ থেকেই যাবে।

আজ থেকে মাত্র বিশ বছর আগেও আপনি যদি কাউকে বলতেন যে শীঘ্রই আপনি ফার্মগেটে বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাংলাদেশে থেকে আমেরিকায় কারও সাথে সরাসরি কথা বলতে পারবেন, সে আপনাকে পাগল ভাবতো। কিন্তু এখন আমাদের সবার হাতে দেখুন মোবাইল ফোন রয়েছে। আজ থেকে পনের বছর আগেও যদি কাউকে বলতেন শীঘ্রই আপনি বান্দরবনের এক পাহাড়ে বসে আমেরিকায়, যুক্তরাজ্যে, চায়নায় কয়েকজন মানুষের সাথে সরাসরি শুধু কথাই বলতে পারবেন না, একই সাথে তাদেরকে দেখতেও পারবেন, ফাইল আদান প্রদান করতে পারবেন, তাহলে সে আপনার দিকে আতংক নিয়ে তাকাতো। কিন্তু দেখুন এখন Skype মানুষের ঘরে ঘরে।  গত একশ বছরে মানুষ জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এতোটা এগিয়ে গেছে যেটা গত হাজার বছরেও হয়নি। মানুষ যদি মাত্র একশ বছরে এমন সব কল্পনাতীত অর্জন করতে পারে, তাহলে মানুষ আজ থেকে দশ হাজার বছর পরে কোথায় যাবে, সেটা এই বিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। মানুষের উন্নতি যদি একই ধারায় চলতে থাকে, তাহলে আজ থেকে দশ হাজার বছর পরের মানুষ আমাদের থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতো এগিয়ে যাবে, চিন্তার ক্ষমতায় এতো উন্নত হবে, মানসিক ধারণ ক্ষমতা এতো বেশি হবে যে, আজকে শিম্পাঞ্জী এবং মানুষের মধ্যে যে রকম ব্যাপক ব্যবধান, তাদের সাথে আমাদের ব্যবধান হবে সে রকম। সেই উন্নত মানবজাতির কেউ একজন যদি আজকে আমাদের কাছে কোনো ভাবে চলে আসে, তাহলে সে চারিদিকে তাকিয়ে শুধুই শিম্পাঞ্জী গোছের কিছু মানুষ দেখবে। আমাদের কাছ থেকে তার কিছুই শেখার বা জানার থাকবে না, এমনকি তার কথা বোঝার মতো যথেষ্ট মানসিক ক্ষমতাও আমাদের থাকবে না।

তাহলে চিন্তা করে দেখুন যেই সত্ত্বা ১৬০০ কোটি বছরের (মহাবিশ্বের বয়স) থেকে অনেক বেশি সময় ধরে আছেন, যিনি মানুষের মতো অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করতে পারেন, যিনি এই বিশাল পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে পারেন, যিনি পৃথিবীর মতো এরকম একটি দুটি নয়, বরং ১০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ এরও বেশি গ্রহ, নক্ষত্র সৃষ্টি করে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেন, তিনি আমাদের থেকে কত উপরে। তাঁর জ্ঞান, তাঁর “মানসিক” ক্ষমতা, তাঁর পরিকল্পনা, তাঁর সৃজনশীলতা কোন্‌ পর্যায়ের হতে পারে, সেটা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়, যেখানে কিনা আমরা নিজেরাই দশ হাজার বছর পরে কি পর্যায়ে পৌছাবো সেটাই কল্পনা করতে পারি না।

যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে নানা ধরণের প্রশ্ন করে, তারা আসলে আল্লাহ কে এবং সে কে – সেটাই তারা বোঝে না। তারা মনে করে তারা তাদের বিবেক বুদ্ধি ব্যবহার করে আল্লাহর জ্ঞান, সিদ্ধান্ত, কাজের মধ্যে অনেক ফাঁক ফোঁকর বের করে ফেলেছে, যেটা আল্লাহ বের করতে পারেন নি। বাইবেলে এর একটা চমৎকার উত্তর দেওয়া আছেঃ “Destruction is certain for those who argue with their Creator. Does a clay pot ever argue with its maker? Does the clay dispute with the one who shapes it, saying, ‘Stop, you are doing it wrong!’ Does the pot exclaim, ‘How clumsy can you be!’ How terrible it would be if a newborn baby said to its father and mother, ‘Why was I born? Why did you make me this way?

যারা তাদের প্রভু সাথে তর্ক করে তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। একটা মাটির পাত্র কি কখনও কামারের সাথে তর্ক করে? মাটি কি তাকে বলে, “থামো, তুমি ভুল করে বানাচ্ছ!” মাটির পাত্রটা কি অভিযোগ করে, “তুমি এতো খামখেয়ালি কেন?” কি বাজে ব্যপার হবে যদি একটা শিশু জন্ম নিয়েই তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করে, “আমি জন্ম হলাম কেন? আমাকে এরকম করে জন্ম দিলে কেন?” (Isaiah:45:9-10)

কু’রআনের পুরো বাণীকে যদি এক লাইনে বলা যায়, তাহলে কু’রআনের বাণী হচ্ছেঃ আল্লাহ হচ্ছে তোমার প্রভু, তুমি হচ্ছ আল্লাহর একজন দাস। একজন দাসকে তার প্রভু যা ইচ্ছা দিতে পারে, যা ইচ্ছা কেড়ে নিতে পারে। এখানে দাসের অভিযোগ করার কিছুই নেই। প্রভু কোন বন্ধু না যে দাসকে তার কোন জবাব দিতে হবে। আমার যদি একটা গরু থাকে এবং গরুটা দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলে আমি যদি তাকে বিক্রি করে দিতে চাই, তখন যদি গরুটা আমার সাথে তর্ক শুরু করে, “আমি না এত দুধ দিলাম? আমাকে বিক্রি করবা কেন?” – তাহলে ব্যপারটা কেমন দাঁড়ায়?

এই পর্যায়ে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়ঃ “না, এটা তো ঠিক হল না! আল্লাহ আমাদের প্রভু এবং আমরা দাস হলেই কি আল্লাহ আমাদেরকে নিয়ে যা খুশি তাই করবে? এটা কেমন এক প্রভুর সংজ্ঞা হল?” আল্লাহ অন্য সব প্রভুর মত নন। প্রভু-দাস এই শব্দগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ভালো ধারণা নেই কারণ প্রভু হিসেবে মানুষ সাধারনত সবসময়ই নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী হয়। আর দাস বলতে আমরা সবসময় বুঝি অত্যাচারিত, অধিকার বঞ্চিত, গরিব মানুষ। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন সুরা ফাতিহাতেঃ “আল্লাহর নামে, পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। সমস্ত প্রশংসা-মহিমা-ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টি জগতের প্রভু। পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়।” [১:১-৩]

এখানে আল্লাহ বার বার বলেছেন, তিনি হচ্ছেন পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময় প্রভু। তিনি মানুষের মত অল্প করুণাময়, মাঝে মাঝে করুণাময় নন। আল্লাহ কিন্তু শুধুই বলতে পারতেন “তিনি পরম করুণাময়”, ব্যাস। কিন্তু একজন পরম করুণাময় কিন্তু সবসময় করুণা নাও দেখাতে পারেন। তিনি সকালে করুণা দেখালেন, রাতে আর দেখালেন না। কিন্তু না, তিনি নিরন্তর করুণাময়, তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে করুণা করছেন। আপনি যখন সকালে ফজরের এলার্ম বন্ধ করে নামায পড়বেন কিনা তা কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে আবার ঘুম দেন, তখন আপনার একটা হাত খুলে পড়ে যায় না। আপনি যখন একজন অন্ধ ফকিরের পাশ দিয়ে না দেখার ভান করে হেটে চলে যান, তখন কিন্তু আপনার চোখ দুটা নষ্ট হয়ে যায় না। কারণ আল্লাহ নিরন্তর করুণাময়। আপনি তাঁর এক মামুলি দাস হয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় তাঁর আদেশ অমান্য করে, তাঁকে আপনার পরিবারের সদস্যদের চাহিদা থেকে কম গুরুত্ব দিয়ে, লোকে কি বলবে এই ভেবে ক্রমাগত তার আদেশ ভেঙ্গে যাবার পরেও তিনি আপনাকে প্রতিদিন ছেড়ে দেন। কারণ তিনি নিরন্তর করুণাময়, চরম ধৈর্যশীল।

এছাড়াও তিনি বলেছেন – সমস্ত প্রশংসা, মহিমা, ধন্যবাদ তাঁর। তিনি যাই করেন, সেটাই প্রশংসনীয়। সেটা আমরা আমাদের নগণ্য বুদ্ধি নিয়ে বুঝি, আর নাই বুঝি। একটা সামান্য পিঁপড়া যেভাবে হাজার হাজার পিঁপড়ার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে, যার সমকক্ষ কিছু মানুষ এখনও তৈরি করতে পারেনি; যেভাবে মৌমাছিরা ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাসা তৈরি করে, যা মানুষ এখনও বানাতে পারেনি, যেভাবে এক মামুলি ঘাস নাইট্রোজেন জমা করে হাজার ধরণের ছোট বড় প্রাণীকে প্রোটিন সরবরাহ করে, যার ধারে কাছে কোন কিছু মানুষ বানাতে পারেনি – এসব কিছুর মধ্যে আল্লাহর বিরাট প্রশংসা এবং মহিমা রয়েছে। আমরা মানুষরা যদি আল্লাহর এই মহিমা উপলব্ধি করে তাঁর প্রশংসা না করি, আল্লাহর তাতে কিছুই যায় আসে না। আমরা শুধু শুধুই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবো। “তাহলে আমার এতো অভাব কেন? আমার এতো অসুখ কেন?” স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নগুলো আসে। “যদি আল্লাহ সত্যিই পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়, সকল প্রশংসা পাবার যোগ্য হন, তাহলে আমার এই করুণ অবস্থা কেন?”

আপনার সমস্যা হচ্ছে আপনি মনে করছেন, যদি আল্লাহ পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়, সব প্রশংসার অধিকারী হন, তাহলে আপনার জীবনটা হবে বেহেস্তের মত। আপনার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক – আল্লাহ আপনাকে কোন টাকা পয়সার অভাব দিবেন না। আপনার দাদা-নানা তাদের জীবনে ফাঁকিবাজি করে আপনার বাবার জন্য জীবনটা সচ্ছল করে দিয়ে যাক বা না যাক, আল্লাহ আপনার জীবনটা ঠিকই আরামে পার করে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিবেন। আপনি প্রতিদিন লক্ষ মানুষের মল মিশ্রিত ঢাকা ওয়াসার দুষিত পানি পান করেন আর নাই করেন, আল্লাহ আপনার পাকস্থলিকে এতো শক্তিশালী করে দিবে যে সেই পানি খেয়েও আপনার কোন অসুখ হবে না। আপনি প্রতিদিন ফরমালিন দেওয়া ফল, মাছ খান বা না খান, আলাহ প্রতি মাসে আপনার শরীরের সব কোষকে নতুন করে পাল্টিয়ে দিয়ে কখনও আপনার শরীরে ক্যানসার হতে দিবেন না।

আপনি কু’রআনের উপদেশ মেনে আপনার জীবন পার করবেন না, কিন্তু তারপরেও আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে কোন সমস্যা থাকবে না। আল্লাহ মহাবিশ্বের সব নিয়ম কানুন ভেঙ্গে, বিশ্বের সমস্ত মানুষের সব খারাপ কাজের প্রভাব থেকে আপনাকে মুক্ত রেখে; সমস্ত জীবাণু, রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রভাব থেকে আপনার দেহকে প্রতিরোধ করে; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, সমস্ত ঘটনাকে আপনার সুবিধা মত পরিবর্তন করে, আপনার কাছে যখন যেটা সমস্যা মনে হবে, সেটাই তিনি দূর করে দিবেন। এই হচ্ছে আপনার মতে “পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়” এর সংজ্ঞা।

কিন্তু সেটা আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা নয়। এখন আপনি বলবেনঃ “তাহলে আমার দোষ কি? আমাকে দুনিয়াতেও কষ্ট করতে হবে আবার দোযখের শাস্তিও পেতে হবে? এটা কেমন ন্যায় বিচার হল?” “তোমার প্রভু কারো সাথে একটুও অবিচার করবেন না।” [১৮:৪৯] কিয়ামতের দিন যখন পাপীদেরকে জাহান্নামে নেওয়া হবে, তখন কেউ দাবি করবে না যে তাকে অন্যায়ভাবে জাহান্নামে নেওয়া হচ্ছে। সবাই যখন তাদের কাজের ফলাফল দেখতে পাবে, তখন সবাই নিজেরাই বুঝতে পারবে যে সে শাস্তি পাবার যোগ্য।

একই ভাবে দুনিয়াতে প্রতিটি কষ্টের জন্য আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে ছাড় দিবেনই, যদি মানুষ কষ্টে পরেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলে, আল্লাহকে অভিযুক্ত না করে বরং তার বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকে। “‘আমি’ তোমাদেরকে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, এবং সম্পত্তি, জীবন ও ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। তবে (মুহম্মদ) ধৈর্যধারণকারীদের সুসংবাদ দাও। যাদেরকে দুর্ঘটনা/বিপর্যয়/কষ্ট আঘাত করলে বলে, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং তাঁর কাছেই আমরা ফেরত যাব।” তাদের উপরেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং দয়া রয়েছে এবং তারাই সঠিক পথে আছে।” [২:১৫৫-১৫৭]

যারাই জীবনে পরীক্ষায় পড়ে আল্লাহকে দোষ না দিয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিবে এবং ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং চলুন আমরা বেশি করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো ধৈর্য নিয়ে পাস করার সামর্থ্য দেন। এছাড়াও আরেকটি অসাধারণ আয়াত হলঃ “তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহর কি লাভ?” [৪:১২৭]

আল্লাহ কেন আমাদেরকে খামোখা শাস্তি দিবেন? তাঁর তো আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। তিনি আমাদেরকে শাস্তি তখনই দিবেন যখন আমরা শাস্তি পাবার মত কাজ করবো। আপনি আমি যখন Nando’s চিকেন খাই, আর আমাদের পাশের গলিতে একটা লোক না খেয়ে ছেড়া চাদর গায়ে দিয়ে রাস্তায় ঘুমায়, তখন আমাদেরকে যখন জাহান্নামে নেওয়া হবে, আমরা কিন্তু সেটাকে “এটা ঠিক হল না!” বলে চিল্লাচিল্লি করবো না। আমরা যখন আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে আইফোনে গেম ফেলি, টিভি দেখি, রেস্টুরেন্টে খাই, স্কুলে পাঠাই, কিন্তু তাদেরকে দশ মিনিটও কু’রআন পড়ে শোনাই না, সারা জীবনে তাদেরকে আল্লাহর পাঠানো একমাত্র বইটা শেখাই না; তারপর তারা বড় হয়ে নামায ফাঁকি দেয়, সুদের লোণ নেয়, বন্ধু বান্ধব নিয়ে পার্টি করে, অশ্লীল সিনেমা দেখে, মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে, ফুটানি করে, গরিবের সাথে অন্যায় করে – তখন সেই সমস্ত গুনাহর ভাগীদার হয়ে আমরা যখন মাথা নিচু করে জাহান্নামে যাবো, তখন আমরা প্রশ্ন করবো না – “আমার কি দোষ ছিল!”

আমাদের বাবা-মা যখন আমাদেরই চোখের সামনে ইসলাম না মেনে অন্যায় করে যাচ্ছে, আর আমরা ভাবছি – “তাদেরকে ভালো কথা বলতে গেলেই আরেকটা লেকচার শুনতে হবে, একটা ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে, এর চেয়ে নিজে ঠিক থাকি।” তারপর যখন কিয়ামতের দিন আমাদেরকে দেখান হবে কিভাবে আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম শেখার এবং অনুসরন করার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা অকৃতজ্ঞের মত নিজের বাবা-মাকেও সংশোধন করার কষ্টটা করতে পারি নি। যারা কিনা ছোটবেলায় আমাদের বমি পরিস্কার করেছে, সারারাত আমাদের ক্যান ক্যান শুনে নিজেরা না ঘুমিয়ে কোলে নিয়ে বারান্দায় হেঁটেছে, সারাদিন কাজ করে পরদিন ভোর বেলা উঠে স্কুলে নিয়ে গেছে – তাদেরকেই আমরা নিজেদের হাতে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছি। তখন যদি আমাদেরকে তাদের সাথে জাহান্নামে পাঠানো হয়, আমরা তার প্রতিবাদ করবো না। আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে একটা চমৎকার কথা বলেছেনঃ “যখন আমি মানুষকে অনুগ্রহ করি তখন সে গর্বে নিজের মত থাকে, কিন্তু যেই না খারাপ কিছু হয়, সাথে সাথে সে লম্বা দোয়া করা শুরু করে।” [৪১:৫১]

যারা এই সব প্রশ্ন করে, দেখবেন তাদের দিনকাল যখন বেশ ভালো যায় – কোন অসুখ নেই, টাকা পয়সার অভাব নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে – তখন কিন্তু তারা এইসব প্রশ্ন করে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে না। বরং যখনই তার কোন সমস্যা হয়, তার পরিবারের কারো বিপদ হয়, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ধরা পড়ে, তখনই তাদের এই সব প্রশ্ন শুরু হয়। মানুষের মত একটা নগণ্য বুদ্ধির প্রাণী, যারা এখন পর্যন্ত পদার্থের ‘ভর’ কেন হয় – এরকম অত্যন্ত প্রাথমিক একটা ব্যপার বের করতে পারেনি; যেই ‘হিগ্‌স বোসন’ বের করার জন্য ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে গবেষণা করছে এক যুগ ধরে, তারাই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় সৃষ্টিকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে। এরকম মূর্খ একটা প্রাণীই দাবি করে – আল্লাহ বলে কিছু নেই, থাকলে পৃথিবীতে এত অশান্তি, এত দুঃখ, কষ্ট, যুদ্ধ, থাকতো না।

কিন্তু আপনি এসব কিছুই মানতে পারছেন না। আপনি বলবেনঃ “আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল না কেন আমি এরকম জীবন চাই কিনা?” যারা এধরনের প্রশ্ন করে তারা আসলে চিন্তা করেই দেখেনি কি রকম অবাস্তব একটা প্রশ্ন এটা। আল্লাহ কি প্রতিটা মানুষের আত্মাকে জন্ম হবার আগে একটা ঐশ্বরিক টিভি ছেড়ে দিয়ে বলতেন, “দেখ, এই হচ্ছে তোমার হবু বাবা-মা। তাদের অবস্থা দেখে তোমার যদি পছন্দ হয়, তাহলে আমাকে জানাও, আমি তোমাকে পৃথিবীতে পাঠাব।” ধরুন আপনার বাবাকে এই সুযোগটা দেওয়া হয়েছিল। তিনি ‘না’ বলেছিলেন কারণ আপনার দাদা-দাদিকে তার পছন্দ হয় নি। যে কারনে আপনার বাবার জন্ম হয়নি। তাহলে আপনি আসবেন কোথা থেকে?

এভাবে পেছনের দিকে যেতে থাকেন। আপনার বড় দাদা, তার বাবা, তার বাবা। কেউ একজন যদি বলতেন, ”না, আমার বাবা-মাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না, আমি যাবো না” – তাহলে পুরো একটা প্রজন্মের কোন দিন জন্ম হত না। আপনি কোন দিন সেই সুযোগটা পেতেন না। আপনার আত্মাকে বলা হত – “যেহেতু তোমার বাবা পৃথিবীতে যেতে চাচ্ছে না, সেহেতু তোমার পৃথিবীতে যাবার কোন সুযোগ নেই।” তখন কি আপনি দাবি করতেন না – “কেন? আমার বাবা না গেলে আমি সুযোগ পাব না কেন? এটা অন্যায়!” এ পর্যায়ে আমাকে একজন বলেছিলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি পৃথিবীতে আসব, কি আসব না সেটা না বলে, আমাকে আমার পছন্দ মত বাবা-মা দেওয়া হল না কেন?”

ব্যপারটা কিভাবে ঘটত চিন্তা করে দেখেছেন কি? আল্লাহ কি আপনাকে একটা ঐশ্বরিক টিভি এবং একটা ঐশ্বরিক রিমোট দিয়ে বলতেনঃ “যাও, পৃথিবীতে এখন যে ২ কোটি বাবা-মা আছে, তাদের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নাও। এই রিমোটটা দিয়ে একটা করে চ্যানেল পালটালে একটা করে বাবা-মার জীবন দেখতে পারবে। তোমার দেখা শেষ হলে আমাকে বল কোন বাবা-মার সন্তান হতে চাও তুমি।” তাহলে এই সুযোগ শুধু আপনাকে না, প্রতিদিন যে লক্ষ লক্ষ বাচ্চা জন্ম হয় তাদের প্রত্যেকের আত্মাকে একই সুযোগ দিতে হবে। তাহলে ঘটনা কি দাঁড়াবে? প্রতিদিন হাজার হাজার আত্মা আল্লাহকে গিয়ে বলবে, “আমি বিল গেটসকে আমার বাবা হিসেবে চাই”।

প্রতি দিন সকালে বিল গেটসের স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস ঘুম থেকে উঠে দেখবেন, তার সামনে হাজার হাজার আত্মার বায়োডাটা পড়ে আছে এবং তাকে বলতে হবে কাকে তিনি আজকে জন্ম দিতে চান। তিনি যাদেরকে না বলবেন, তাদের আত্মার কাছে খবর চলে যাবে অন্য কোন বাবা-মা খুঁজে বের করতে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং যেই আত্মাগুলোর কপালে আফ্রিকার কোন গরিব বাবা-মা পড়বে, সে বলবে, “আমার কপালে এরকম বাবা-মা পড়ল কেন? কেন বিল গেটসকে আমার বায়োডাটা আগে দেওয়া হল না?” তখন আমাকে যিনি এই প্রশ্নগুলো করছিলেন বললেন, “আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানাল কেন? আমাকে তো অন্তত এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পারত?”

তাহলে শুধু আপনাকে না, আজকে যে লাখ খানেক মেয়ে বাচ্চা জন্ম নিবে, তাদের সবাইকে এই সুযোগ দিতে হবে। তখন দেখা যাবে আজকে সবগুলো ছেলে বাচ্চা জন্ম হল। কালকেও সব ছেলে হল। এভাবে এক বছর ধরে শুধুই ছেলে বাচ্চা জন্মাল এবং এক প্রজন্মের মধ্যেই পৃথিবীতে সব মেয়ে শেষ হয়ে গেল এবং মানব জাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আপনি যত ভাবেই চিন্তা করেন না কেন, যখনি আপনি স্বার্থপর চিন্তা না করে, সবার জন্য সমান ভাবে কাজ করে এরকম কোন নিরপেক্ষ ব্যবস্থা চিন্তা করে বের করবেন, দেখবেন আল্লাহ আমাদেরকে যেভাবে বানিয়েছেন, সেটাই সবচেয়ে নিরপেক্ষ ব্যবস্থা।

সুতরাং আল্লাহ যে সবচেয়ে নিরপেক্ষ, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ, সবচেয়ে সুবিচারক সত্তা এবং তিনি যে প্রতিটি মানুষকে তার প্রতিটি কষ্টের জন্য যথাযথ প্রতিদান দিবেন – আপনি সেটায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখুন। আপনি যদি মেয়ে হন, তাহলে আপনার মেয়ে হবার কারণে জীবনে যত জটিলতা হয়েছে, যা আপনি ধৈর্য ধরে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে, বিশ্বাসকে অটুট রেখে পার করেছেন, তার প্রত্যেকটার জন্য আপনার পরকালের হিসাব কম দিতে হবে এবং আপনি তত সহজে বেহেশতে যাবেন। ছেলেদের পরকালের হিসাব হবে আপনার থেকে অনেক অনেক কঠিন। তারা এই পৃথিবীতে যত আরামে থাকবে, যত সুযোগ সুবিধা পাবে, তাদেরকে তার জন্য বরং তত বেশি জবাব দিতে হবে। “‘আমি’ তোমাদেরকে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, এবং সম্পত্তি, জীবন ও ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। তবে (মুহম্মদ) ধৈর্যধারণকারীদের সুসংবাদ দাও। যাদেরকে দুর্ঘটনা/বিপর্যয়/কষ্ট আঘাত করলে বলে, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং তাঁর কাছেই আমরা ফেরত যাব।” [আরবিঃ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন] তাদের উপরেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং দয়া রয়েছে এবং তারাই সঠিক পথে আছে।” [২:১৫৫-১৫৭]

যারাই জীবনে পরীক্ষায় পড়ে আল্লাহকে দোষ না দিয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিবে এবং ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং চলুন আমরা বেশি করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো ধৈর্য নিয়ে পাস করার সামর্থ্য দেন।

আরেকটি ব্যপার মনে রাখবেন, আল্লাহ আপনার ভালোর জন্য অন্য কোন বৃহত্তর স্বার্থ ত্যাগ করবেন না, কারণ সেটা মানুষের দৃষ্টিতেই অন্যায় হয়ে যাবে। বরং তিনি বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ক্ষতি করবেন – যার একজন ভুক্তভুগি আপনি হতে পারেন। যেমন শেষ নবীর (সা) ছেলে সন্তান হয়ে মারা গিয়েছিল। একজন নবী, যাকে কিনা আল্লাহ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, তাকে কিভাবে তিনি সন্তান মারা যাবার মত ভয়ংকর কষ্ট দিতে পারেন? তিনি কি তার সন্তান হওয়াটা আটকাতে পারতেন না? তিনি কি তার ছেলে সন্তানটিকে অলৌকিকভাবে বাঁচাতে পারতেন না? কত নবীকে তিনি অলৌকিক ভাবে সাহায্য করেছেন! এধরণের ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ক্ষতি করেন, সেটা নবী হোক, সাধারণ মুসলমান হোক, আর কোন কাফির হোক। কু’রআনের সব অলৌকিক ঘটনাগুলো পড়লে দেখবেন যখনই মানব জাতির ব্যপক ক্ষতি হতে থাকে এবং সেটা না আটকালে মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তখনি আল্লাহ অলৌকিক ঘটনা ঘটান। যেন তেন কারণে তিনি তাঁর নিজের বানানো পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম, মহাবিশ্ব পরিচালনার আইন নিজেই যখন তখন ভাঙ্গেন না – আগুনকে ঠাণ্ডা হতে বলেন না, নদীর পানিকে রক্তাক্ত করে দেন না, আকাশ থেকে উল্কা বৃষ্টি করেন না। সুতরাং যখন আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, ধরে নিবেন এর একটা কারণ হতে পারে যে আল্লাহ বৃহত্তর স্বার্থে আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করেছেন এবং আপনার ক্ষতির যথাযথ প্রতিদান আপনি পাবেন। অথবা হতে পারে আল্লাহ আপনাকে কোন ভুল করার শাস্তি দিচ্ছেন, আপনার পাপ মোচনের সুযোগ করে দিচ্ছেন।

শেষে আবারো বলব, যারা এধরণের প্রশ্ন করে তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে তারা বুঝতে পারেনি প্রভুর সংজ্ঞা কি। আপনি প্রভু এবং দাস প্যারাগুলো বার বার পড়ুন। “আল্লাহর মানুষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে এতো কষ্ট দেবার কি দরকার ছিল? সরাসরি মানুষকে বেহেস্তে পাঠালেই তো হয়ে যেত?”

তাহলে যারা দোযখে যাবে তারা কি জিজ্ঞেস করবে না, “কেন আমাকে দোযখ দেওয়া হল? আমি কি অপরাধ করেছি?” যারা বেহেস্তে যাবে, তারা কি দাবি করবে না, “কেন আমাকে বেহেশতে ৫০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল, কেন ১,০০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল না?” মানুষকে যদি আল্লাহ কোন শাস্তি দেন, তাহলে এটা স্বাভাবিক যে আল্লাহ মানুষকে সেই শাস্তি পাবার কারণ কি সেটা দেখাবেন। তা না হলে মানুষ দাবি করবেই কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হল। আল্লাহ যদি মানুষকে পৃথিবীর জীবনের সুযোগটা না দিয়ে জাহান্নাম বানিয়ে, তাতে সরাসরি মানুষ ভরে দিতেন – তাহলে মানুষ কি সেটা মেনে নিত?

একই ভাবে মানুষ যখন বেহেশতে যাবে, তার দাবি থাকবে তাকে বেহেশতে যা দেওয়া হয়েছে তা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। কেন সে কম পেল তার বেহেশতের প্রতিবেশীর থেকে? কেন সে যা পেয়েছে তার থেকে অন্য কিছু পেল না? মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দাবি করবে আল্লাহ কিসের ভিত্তিতে তাকে বেহেশতে সেসব দিয়েছে। একারণেই মানুষকে পৃথিবীর জীবন দেওয়া হয়েছে যেন মানুষ বেহেশতে যা কিছু পাবে, তা সে নিজে পৃথিবীতে অর্জন করে যেতে পারে। এগুলো সবই হচ্ছে যুক্তি নির্ভর উত্তর। আল্লাহই ভালো জানেন তিনি কেন পৃথিবী বানিয়েছেন। যারা এধরনের প্রশ্ন করে তাদের প্রথম সমস্যাই হচ্ছে আল্লাহ এবং তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। আগে সেটা ঠিক করা দরকার।

আরেকটা ব্যপার হল, আপনি ধরেই নিচ্ছেন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে শুধুই কষ্ট করার জন্য। এটি কিছু জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করে প্রচলিত ভুল ধারণা। আল্লাহ তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে নিয়ে কু’রআনে অনেক গর্ব করেছেন। তিনি মানুষকে বার বার বলেছেন পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে উপভোগ করতে, পৃথিবীতে পরিমিত উপভোগ করে সুন্দর জীবন যাপন করে পরকালে আরও আনন্দের জন্য চেষ্টা করতে। আল্লাহ কতবার তাঁর সৃষ্ট সুস্বাদু ফলমূলের কথা কু’রআনে বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো উপভোগ করি। কতবার তিনি তাঁর সৃষ্ট অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো ঘুরে দেখি। কতবার তিনি পৃথিবীতে কত আনন্দের উপকরণের কথা বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো পাবার চেষ্টা করি। এমনকি আমরা কিন্তু নামাযে দোয়াও করিঃ “রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও,… ও আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, এবং আমাদেরকে আখিরাতেও কল্যাণ দিন।” [২:২০১]

আল্লাহ আমাদেরকে প্রথমেই দুনিয়াতে কল্যাণ চেতে বলেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য যদি থাকতো দুনিয়াতে একটা বন্দি, কষ্টের জীবন দেবার, তাহলে তিনি আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ চেতে না বলে শুধুই চুপ করে ধৈর্য ধরে থাকতে বলতেন। কু’রআনে বহু আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে দেশ বিদেশ ঘুরতে বলেছেন, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে উপভোগ করতে বলেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে বলেছেন। আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে শুধুই কষ্ট দেওয়াটা তার উদ্দেশ্য নয়। “আল্লাহ অনুগ্রহ করে যা দিয়েছেন তা নিয়ে যারা কিপটামি করে আর ভাবে সেটাই তাদের জন্য ভাল, না, বরং সেটা তাদের জন্য খুবই খারাপ। … “[৩:১৮০]

সুতরাং আপনি কিপটামি করে টাকা জমিয়ে রেখে একটা নিম্ন মানের জীবন যাপন করে যদি মনে করেন আপনি ভাল কাজ করছেন, তবে সেটা ভুল। কিয়ামতের দিন আপনার সেই জমানো সম্পদ আপনার ঘাড়ে পেছিয়ে দেওয়া হবে।

এখন আপনি মনে করেন, আপনার জীবনের সব কষ্টের জন্য আল্লাহ দায়ী। আপনার কষ্টের পেছনে আপনার, আপনার বাবা-মার, আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামা, চাচা, খালু, দেশের প্রধানমন্ত্রী কারও কোন হাত নেই। ভুল ধারণা। আপনি গরীব তার কারণ আপনার বাবা-মা তাদের জীবনে ভুল করেছে। আল্লাহর দেওয়া অনেক সুযোগ হেলা করে ছেড়ে দিয়েছে, কিপটামি করেছে। তারা আরেকটু বেশি চেষ্টা করলেই জীবনটা তাদের এবং আপনার জন্য অনেক সুন্দর করতে পারতো। কিন্তু তা না করে ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখেছে, প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে রাজনীতি আর শাড়ি নিয়ে গল্প করে আল্লাহর দেওয়া মূল্যবান সময়, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা, প্রতিভা এবং ক্ষমতা নষ্ট করেছে। একই ভাবে আপনার জীবনটা আজকে এত কঠিন এবং কষ্টের তার কারণ আপনার দাদা একটু চেষ্টা করলেই একটা জমি চাষ না করে আল্লাহ তাকে যে আরেকটা জমি চাষের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেটা করে তিনি নিজের জন্য একটা বাড়ি করে ফেলতে পারতেন এবং আপনার বাবা তখন পড়াশুনা করে, ভালো চাকরি করে, তার নিজের জন্য আরেকটা বাড়ি কিনতে পারতেন – তাহলে আপনার তখন কোন অভাব থাকতো না। বাংলাদেশের প্রাক্তন শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রীকে আল্লাহ দশ বছর আগে বিনামূল্যে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পাবার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার লোভের জন্য সেই সুযোগ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি যদি সেই সুযোগটা নিতেন, তাহলে আজকে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের চাকরি থাকতো এবং লক্ষ লক্ষ পরিবার সুখী, সচ্ছল জীবন পার করতে পারতো। তাদেরকে দোষ না দিয়ে আপনার জীবনের সব সমস্যা, দুঃখ, কষ্টের জন্য শুধু আল্লাহকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আল্লাহ তো আপনার বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, প্রধানমন্ত্রীকে বিবেক-বুদ্ধি, সুযোগ, সামর্থ্য সবই দিয়েছিলেন।

আপনার যদি মনে হয়, আমার বাবা-মার কোনই উপায় ছিলনা তাদের অবস্থার পরিবর্তন করার, আল্লাহ তাদেরকে এমন কঠিন অবস্থায় রেখেছিলেন যে তাদের সেখান থেকে বের হবার কোন উপায়ই ছিল না, তাহলে আপনি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা, স্টিফেন হকিং এর জীবনী পড়ে দেখেন। অসম্ভব অবস্থার মধ্যে থেকেও তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে গেছেন। আপনার বাবা-মা কু’রআন পড়ে আল্লাহর আদেশ মেনে চললেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারতেন। খুব সম্ভবত তারা জীবনে একবারও পুরো কু’রআন বুঝে পড়েন নি এবং আপনিও হয়তো এখনও পুরো কু’রআন বুঝে পড়ে তার ১০% নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন নি। আর আপনিই কিনা আল্লাহকে দোষ দিচ্ছেন আপনার দুরবস্থার জন্য!

আর আপনি যদি ভাবেন – “এখানে আমার দোষ কি? অন্যের ভুলের জন্য আমাকে কেন পস্তাতে হবে?” তাহলে আপনি কি আশা করেন – আল্লাহ আপনাকে জন্ম দিবে গাছের মত পাতা দিয়ে, যাতে করে আপনি সূর্যের আলো থেকে সালোক সংশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করতে পারেন,  আপনাকে খাবারের জন্য কষ্ট করে চাকরি করতে না হয়? নাকি আপনার কান থেকে ঘন তরল সোনা বের হবে যা বিক্রি করে আপনি বাড়ি, গাড়ি কিনে ফেলতে পারবেন? না কি আল্লাহর উচিৎ ছিল আপনার বাবা-মার প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার, যাতে করে তারা সন্তান না পাবার দুঃখে সারা জীবন আল্লাহকে দোষ দিতেন?

আরেকটা ব্যপার হচ্ছে, মানুষ স্বভাবতই অলস। তাকে অভাব, কষ্ট না দিলে, একটু ধাক্কা না দিলে সে সাধারণত কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। আর ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছু পাওয়া যায় না। আল্লাহ অনেক সময় আপনাকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কষ্ট, সমস্যা দেন আপনাকে সেই ধাক্কাটি দেবার জন্য যাতে করে আপনি যে ভুল দিকে যাচ্ছিলেন সেদিকে না গিয়ে সঠিক দিকে যান, নিজের জন্য এবং নিজের পরিবার, সন্তান, প্রতিবেশী, সমাজ, দেশের জন্য একটা বড় কিছু করেন। অনেক সময় আল্লাহ আপনাকে কষ্ট দেন আপনাকে সাবধান করার জন্য, যে আপনি একটা বড় পাপ কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছেন এবং আপনার নিজেকে সংশোধন করা উচিত।

————————————-

দ্বিতীয় পর্বে দার্শনিক ক্যাটাগরির জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হলঃ

  • “সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন?
  • মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি? সব টেররিস্টগুলো মুসলমান কেন?
  • কেন ধর্মের নামে এতো খুনাখুনি, যুদ্ধ?
  • আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম।
  • আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি?
  • আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি?
  • আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন?
  • এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়।”

পর্ব-১|পর্ব-২

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

12 COMMENTS

  1. এধরণের প্রশ্ন শুধু যে অমুসলিম, নাস্তিকরা করে তাই না, আজকাল মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক হারে এধরণের প্রশ্ন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে আমরা যখনি কোন জটিল শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক সমস্যায় পড়ি, তখনি আল্লাহর সম্পর্কে এই ধরণের অভিযোগ করা শুরু করে দেই।
    এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে প্রবন্ধে –
    http://www.quraneralo.org/why-1/

  2. * প্রতিদিন ১০০ বার “সুবহান আল্লাহ্” পাঠ করলে ১০০০ সাওয়াব লিখা হয় এবং ১০০০ গুনাহ মাফ করা হয় ।[সহীহ মুসলিম-৪/২০৭৩]

  3. “আল্লাহ যদি মানুষকে পৃথিবীর জীবনের সুযোগটা না দিয়ে জাহান্নাম বানিয়ে, তাতে সরাসরি মানুষ ভরে দিতেন – তাহলে মানুষ কি সেটা মেনে নিত?

    একই ভাবে মানুষ যখন বেহেশতে যাবে, তার দাবি থাকবে তাকে বেহেশতে যা দেওয়া হয়েছে তা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। …………একারণেই মানুষকে পৃথিবীর জীবন দেওয়া হয়েছে যেন মানুষ বেহেশতে যা কিছু পাবে, তা সে নিজে পৃথিবীতে অর্জন করে যেতে পারে।”

    – মাতৃগর্ভে যারা মারা যায় অথবা জন্মের পর সাবালক হওয়ার আগেই যারা মৃত্যুবরন করে তাদের ক্ষেত্রে “পৃথিবীর জীবনের সুযোগটা ” বা “পৃথিবীর জীবন দেওয়া হয়েছে” – এটা কীভাবে মেলানো যাবে – একটু ব্যাক্ষা করলে ভাল হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন